লেখক: আলমগীর শাহরিয়ার
ভারত বিভক্তির পর ঢাকাকে কেন্দ্র করে জেগে ওঠে যে শিক্ষিত রাজনীতি, শিল্প ও সংস্কৃতি-সচেতন নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি তাদের নেতৃত্বে ছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। ‘কণ্ঠস্বর’কে ঘিরে ষাটের সাহিত্য আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্বই শুধু নন, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন-উত্তর সবচেয়ে বড় সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের মিছিলের অগ্রভাগেও ছিলেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। বিশেষ করে পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ উদযাপনে যে রাষ্ট্রীয় বাধা আসে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সহপাঠীদের নিয়ে তখন প্রবল সাহসী ভূমিকা পালন করে জন্মশতবর্ষ আয়োজন ও উদযাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ষাটের দশকে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকীর উৎসব নানা কারণে বাঙালির জীবনে একটি তাৎপর্যময় ঘটনা। স্বাধিকার আন্দোলনে জেগে ওঠার কালে এ অনুষ্ঠানকে ঘিরে বাঙালি লেখক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিকর্মীদের একটি ব্যাপক জাগরণ লক্ষ্য করা যায়। বাংলা ভাষার প্রধান লেখক ও শিল্পীকে বাতিল করার এ অপতৎপরতা তারা রুখে দাঁড়ান। অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এ প্রসঙ্গে এক ব্যক্তিগত আলাপচারিতা ও তার গ্রন্থ ‘বিদায় অবন্তী’তে বলেন, ‘পাকিস্তান যুগে বাঙালি সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন যে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, তাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার পর, দীর্ঘ এক দশকের ব্যবধানে পরোক্ষ ও অঘোষিত হলেও, রবীন্দ্র শতবার্ষিকীর আয়োজন ছিল ওই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে বাঙালিত্বের দ্বিতীয় প্রধান সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ।’
স্বাধীন বাংলাদেশে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের জীবনের সবচেয়ে বড় কীর্তির নাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা। মাত্র ১৫ জন সদস্যকে নিয়ে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি এখন এদেশের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক আন্দোলন। বইপড়া যার প্রধান কর্মসূচি। পাশাপাশি আরও অনেক উৎকর্ষ কার্যক্রমের মধ্য দিয়ে সম্পন্ন মানুষ তৈরি করা যার অভীষ্ট লক্ষ্য। কেননা, অনালোকিত ও ক্ষুদ্র মানুষ দিয়ে একটি বড় জাতি হয় না। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই এখন লাখো পাঠকের কাছে প্রতিদিন পৌঁছায়। কেন্দ্রের নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পাঠবিমুখ সমাজে বিপুল জনগোষ্ঠীকে তিনি বইপড়ায় উৎসাহিত করে চলেছেন। সর্বগ্রাসী প্রযুক্তি-বিস্তারের সময়েও পাঠকের দোরগোড়ায় নিয়মিত পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের বই। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন আলো ও আশা জাগানোর নিরন্তর প্রয়াসের ক্লান্তিহীন এক স্বপ্টম্ন-অভিযাত্রী যোদ্ধা। যার স্বপ্টম্ন ও লক্ষ্য আত্মমর্যাদাসম্পন্ন একটি জাতি ও জ্ঞানভিত্তিক একটি সমাজ বিনির্মাণ। বস্তুগত পরিবর্তন সহজেই চোখে পড়ে। কিন্তু অবস্তুগত পরিবর্তন বা উন্নয়ন সহজে দৃষ্টিগোচর হয় না। দীর্ঘমেয়াদি এক প্রক্রিয়া। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ সে অবস্থার দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তনের লক্ষ্যেই নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। মন্টেস্কু, ভলতেয়ার ও রুশোর লেখা যদি ফরাসি বিপ্লবের প্রেরণা দেয়; রামমোহন, বিদ্যাসাগরের কর্মতৎপরতা যদি উনিশ শতকের ঘুমন্ত বাঙালিকে জাগায়, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের এই বইপড়া আন্দোলনও নিশ্চয়ই আমাদের একদিন মাথা উঁচু করে বিশ্বদরবারে দাঁড়ানোর প্রেরণা দেবে।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বিশ্বাস করেন, বয়স একটি সংখ্যা মাত্র। আশি পেরিয়েও তাই তিনি অশীতিপর নন। একান্ত সান্নিধ্যে কাজ করার সুযোগ পাওয়ায় নানা সময় খেয়াল করেছি তার হৃদয়জুড়ে সবসময় ঝলমলে বসন্ত ও তারুণ্যের বাস। সবসময় উপভোগ করেন অপেক্ষাকৃত তরুণদের সান্নিধ্য। তাই হয়তো মননে কখনও বার্ধক্য তাকে কাবু করেনি। নজরুল তার ‘যৌবনের গান’-এ যথার্থই বলে গেছেন, ‘বার্ধক্যকে সবসময় বয়সের ফ্রেমে বেঁধে রাখা যায় না।’
জীবনভর আলোকিত মানুষ গড়ার কর্ম ও সংগ্রামের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৪ সালে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ পেয়েছেন এশিয়ার নোবেলখ্যাত র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার। পরের বছর একুশে পদক এবং প্রবন্ধে ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেলেও এখনও তাকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করা হয়নি। গুণীজনকে প্রাপ্য সম্মান দিতে বরাবরই একটা কার্পণ্য আছে আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতিতে। অনেক গুণীজনকেই আমরা এই মহামারি করোনাকালে হারিয়ে ফেলেছি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এখনও তার বিপুল কর্মযজ্ঞ ও সৃজনশীলতা নিয়ে আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন। এ আমাদের পরম সৌভাগ্য। তাকে যেন আমরা তার প্রাপ্য সম্মান দিতে কুণ্ঠিত না হই। নক্ষত্র ঝরে যাওয়ার কালে স্যার আপনি শতায়ু হোন। আজ জন্মদিনে এই আমাদের প্রার্থনা।
সূত্র: সমকাল
তারিখ: জুলাই ২৫, ২০২১
উইকিপিডিয়া, মুক্ত বিশ্বকোষ থেকে
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ (জন্ম ২৫ জুলাই ১৯৩৯) বাংলাদেশের একজন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক ও সমাজসংস্কারক। তিনি ষাটের দশকে একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি হিসেবে পরিচিতি পান। সে সময়ে সমালোচক এবং সাহিত্য-সম্পাদক হিসাবেও তিনি অবদান রেখেছিলেন। তাঁর জীবনের উল্লেখযোগ্য কীর্তি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, যা চল্লিশ বছর ধরে বাংলাদেশে ‘আলোকিত মানুষ’ তৈরির কাজে নিয়োজিত রয়েছে। ২০০৪ সালে তিনি রামোন ম্যাগসেসে পুরস্কার লাভ করেন।
বাংলাদেশে অ-প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারে অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০০৫ সালে দেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা একুশে পদকে ভূষিত করে। প্রবন্ধে অবদানের জন্য তিনি ২০১২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। ১৯৭০-এর দশকে তিনি টিভি উপস্থাপক হিসাবে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
প্রারম্ভিক জীবন
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ ১৯৩৯ সালে কলকাতার পার্ক সার্কাসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈতৃক নিবাস বাগেরহাট জেলার কচুয়া উপজেলার অন্তর্গত কামারগাতি গ্রামে। তাঁর পিতা আযীমউদ্দিন আহমদ ছিলেন একজন কলেজ শিক্ষক [৪]। ১৯৫৫ সালে তিনি পাবনা জিলা স্কুল থেকে মাধ্যমিক, ১৯৫৭ সালে বাগেরহাটের প্রফুল্লচন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৬০ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও ১৯৬১ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।
কর্মজীবন
আবু সায়ীদ ১৯৬১ সালে মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে খণ্ডকালীন প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। পরবর্তীতে তিনি কিছুকাল সিলেট মহিলা কলেজে শিক্ষকতা করেন। ১৯৬২ সালের পহেলা এপ্রিল তিনি রাজশাহী কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে সরকারি চাকুরিজীবন শুরু করেন। সেখানে পাঁচ মাস শিক্ষকতা করার পর তিনি ঢাকায় ইন্টারমিডিয়েট টেকনিক্যাল কলেজে যোগ দেন (বর্তমানে সরকারী বিজ্ঞান কলেজ)। এই কলেজে তিনি দু’ বছর ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র তেইশ। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগে খন্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে বাংলা পড়াতেন।
এরপর তিনি ঢাকা কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ জালালউদ্দিন আহমেদের আমন্ত্রণে সেখানে যোগদান করেন। আবু সায়ীদ যখন ঢাকা কলেজে যোগ দেন তখন কলেজের বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন কথাসাহিত্যিক ও গদ্য লেখক শওকত ওসমান৷
ষাটের দশকে বাংলাদেশে যে নতুন ধারার সাহিত্য আন্দোলন হয়, তিনি ছিলেন তাঁর নেতৃত্বে। সাহিত্য পত্রিকা কণ্ঠস্বর সম্পাদনার মাধ্যমে সেকালের নবীন সাহিত্যযাত্রাকে তিনি নেতৃত্ব ও দিকনির্দেশনা দিয়ে সংহত ও বেগবান করে রেখেছিলেন এক দশক ধরে। এ সময় কিছুকাল বাংলাদেশে টেলিভিশনে উপস্থাপনাও করেন।
রেটিং করুনঃ ,