লেখক: মৃদুল কান্তি বিশ্বাস
আফগানিস্তান বিশ্লেষণ করার মতো সহজ একটি দেশ নয়। এখানে বিশ্বব্যাংক, ইইউ, ইসি, ডিএফআইডিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে কাজ করার আমার প্রায় ১০ বছর হলো। কখনো কখনো আমি টিম লিডার, প্রকল্প পরিচালক, আন্তর্জাতিক প্রোগ্রাম উপদেষ্টা, বিশেষায়িত বিশেষজ্ঞ এবং আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছি। প্রায় সব দাতা সংস্থার প্রকল্প, উচ্চপর্যায়ের দাতা কর্মকর্তা, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, পরিচালক এবং অন্য উচ্চপর্যায়ের সরকারি, বেসরকারি খাত এবং এনজিও কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমার মতবিনিময় করার সুযোগ হয়েছিল। উচ্চ স্তরের আন্তযোগের কারণে আমি দেশের নীতিনির্ধারণের অনেকগুলো গোপনীয় নথিও পেতাম। এটি এমন একটি দেশ, যেখানে অনেক আন্তধর্মীয় গোষ্ঠী রয়েছে, যাদের মধ্যে মতাদর্শগত গুরুতর পার্থক্য রয়েছে।
এনএসআইএর তথ্য অনুসারে (জাতীয় পরিসংখ্যান ও তথ্য কর্তৃপক্ষ) আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখ। বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ মনে করেন, এ তথ্যও সঠিক নয়। আমি এনএসআইএর আন্তর্জাতিক প্রকল্প সমন্বয়ক হিসেবে দুই বছরের বেশি সময় ধরে কাজ করেছিলাম।
আফগানিস্তানের প্রধান শহর হলো কাবুল, হেরাত, জালালাবাদ, মাজার-ই-শরিফ, কান্দাহার ও কুন্দুজ। আফগানিস্তানের জাতিগত গোষ্ঠীগুলো হলো পশতুন, তাজিক, হাজারা, উজবেক, আইমাক, তুর্কমেন, বালুচ, পাশাই, নুরস্তিনি, গুজ্জর, আরব, ব্রাহুই, কিজিলবাশ, পামিরি, কিরগিজ, সাদাত প্রভৃতি। এর মধ্যে পশতুন মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫০ শতাংশ। বেশির ভাগ তালেবান হয় আফগান এবং পাকিস্তানের পশতুন অথবা বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ভাড়াটে সৈন্য।
এমন নয় যে তালেবান কোনো বড় ধর্মীয় দায়বদ্ধতা বা জাতীয়তাবাদী দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে উদ্বুদ্ধ। তাদের বেশির ভাগই নিয়মিত বেতনের কাজ করে এবং এদের মধ্যে মাদকাসক্তও রয়েছে। ব্যয়ের প্রধান উৎসগুলো হলো তাদের দখল করা অঞ্চলে উৎপাদিত পপি, আফিম ও অন্যান্য ড্রাগ বিক্রি করে আয়, যা তাদের নিয়ন্ত্রিত।
আমেরিকানরা এসব অঞ্চল পপি ও আফিমের পরিবর্তে বিকল্প ফসলের জন্য কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছিল। তবে অঞ্চলগুলোর মানুষের নোংরা মানসিকতার কারণে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের নেতাদের অনেক সন্তানের সঙ্গে অনেক স্ত্রী রয়েছেন এবং তাঁরা তাঁদের পরিবার ও বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিয়েও সংকটে রয়েছেন। তাঁদের বাচ্চারাও বর্তমানে স্কুলে পড়াশোনা করছে এবং মুঠোফোন, টেলিভিশন ও আধুনিক পোশাকে অভ্যস্ত হয়ে সাধারণ জীবন যাপন করছে।
তালেবানদের বেশির ভাগই পশতুন, আফগানিস্তান বা পাকিস্তানের। তাজিক, হাজারা বা উজবেক জনবহুল অঞ্চল তালেবানদের অধিকার নেই এবং তারা যদি কাউকে খুঁজে পায়, তবে সাধারণ জনগণ তাদের হত্যা করবে। তালেবানরাও তাদের সঙ্গে একই কাজ করে। অন্যদিকে পশতুন পরোক্ষভাবে তালেবানদের সমর্থন করে। এটি মারাত্মক বিদ্বেষের এক রাজনীতি।
এটি জাতীয় রাজনীতি, ব্যবসা, কাজের বাজার এবং এমনকি সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। এর কোনো তাৎক্ষণিক ও চূড়ান্ত সমাধান নেই। অতীতে কেউ এটা অর্জন করতে পারেনি এবং অদূর ভবিষ্যতেও হবে বলে মনে হয় না। পশতুন দেশের রাজনীতিসহ পুরো দেশকে নিয়ন্ত্রণ করছে। আমার প্রজেক্টের প্রকিউরমেন্ট বিশেষজ্ঞ হিসেবে একজন হাজারাকে নিয়োগ দেওয়ার পর আমার যে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল, তা আমি খুব সুন্দরভাবে মনে করতে পারি।
আমার উপলব্ধি অনুসারে, তালেবান আফগানিস্তানের কোনো বড় শহর, এমনকি কাবুল, হেরাত, জালালাবাদ, মাজার-ই-শরিফ, কান্দাহার এবং কুন্দুজও দখল করতে সক্ষম হবে না। তালেবানরা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধেও অনেক ক্লান্ত। তারাও শিগগিরই ফলাফল পেতে চায়। অন্যথায় যদি খুব শিগগির কিছু না ঘটে, তবে তাদের অনেকেই যুদ্ধের মাঠ ছেড়ে চলে যাবে। তারা সবাই জানে যে তারা ইরান ও পাকিস্তান বাদে এখন মধ্যপ্রাচ্যের সমর্থন পাবে না। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট অনুসারে বিভিন্ন ফ্রন্টে মারাত্মক যুদ্ধ চলছে এবং প্রতিদিনই শত শত তালেবান সেনা নিহত হচ্ছে।
বর্তমানে আফগানিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার এবং তাদের রয়েছে পর্যাপ্তসংখ্যক আধুনিক অস্ত্র, গোলাবারুদসহ বিমানবাহিনী। এ ছাড়া রয়েছে প্রায় ১৫ হাজার সদস্যের স্পেশাল অপারেশন ফোর্স। আমেরিকানরা অত্যাধুনিক রসদ, সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছে। তালেবান সেনার সংখ্যা নিয়ে প্রচুর বিভ্রান্তি রয়েছে। অনেকের মতে, এই সংখ্যা ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার হতে পারে। একটি বিশেষ শহর দখল করতে এসব বাহিনীকে এক করা তাদের জন্য কঠিন হবে। এটি একটি সত্য যে আমেরিকানরা আফগানিস্তান ছাড়ার পরও তারা তালেবানকে যুদ্ধের মাধ্যমে পুরো দেশ দখল করতে দেবে না।
তাহলে তালেবানরা কীভাবে ক্ষমতায় আসবে? তালেবানরা তাদের এবং কিছু স্বতন্ত্র অংশীদারের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে। আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। আশরাফ গনি তাঁর মেয়াদ শেষে সাধারণ নির্বাচনের জন্য তাদের কাছে প্রস্তাব করেছিলেন। তালেবানরা তা প্রত্যাখ্যান করেছে। তারা জানে যে সাধারণ জনগণ তাদের ভোটও দেবে না।
সুতরাং, এটা হতে পারে ৬০/৪০-এর মতো ক্ষমতার ভাগাভাগি, যেখানে বর্তমান সরকারের ৬০ শতাংশ এবং তালেবানদের ৪০ শতাংশ থাকবে। ক্ষমতা ভাগ করে নেওয়ার মধ্যে কিছু মন্ত্রণালয়, প্রাদেশিক গভর্নরের পদ এবং কিছু সংস্থার পরিচালনা অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
অন্যদিকে আফগানিস্তানে তালেবানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া, রাশিয়ানদের জন্য তাজিকিস্তান, চীনের জন্য উইঘুর, ভারতের পক্ষে কাশ্মীর এবং অন্য অনেক দেশের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ যুদ্ধ পরিচালনা তালেবানদের পক্ষে সম্ভব হবে না এ কারণে যে আফগানিস্তান পুরোপুরি পশ্চিমা অর্থের ওপর নির্ভরশীল, যেখানে সমস্ত উন্নয়ন সংস্থা তাৎক্ষণিকভাবে তহবিল বন্ধ করে দেবে।
আবার নারীদের পড়াশোনা এবং কাজ বন্ধ করা কি সম্ভব হবে? আফগান জনগণের সঙ্গে আলোচনা করে বুঝতে পেরেছি যে তারা আর পেছনে ফিরতে চায় না। আফগানিস্তানকে তার ভবিষ্যতের দিকে তাকাতে হবে অথবা বহু মানুষকে হত্যা করতে হবে, যা সম্ভব নয়। আবার তরুণ প্রজন্ম পুরোপুরি তালেবানের বিরুদ্ধে এবং তারা তাদের বর্তমান স্বাধীনতার অধিকার হরণ করার বিষয়টি মেনে নেবে না। এসব বিষয় বিবেচনা করে তালেবানকে হয় পরিবর্তিত হতে হবে অথবা আধুনিক হতে হবে।
আর কী করা যেত? আফগানিস্তান কমপক্ষে দুই বছর আগেই জাতিসংঘকে অন্তর্ভুক্ত করে আমেরিকান সৈন্য প্রত্যাহারের মক অনুশীলন শুরু করতে পারত। শান্তি রক্ষার বেশ কয়েকটি মডেল বিশ্বে রয়েছে। দক্ষিণ সুদান, লাইবেরিয়া, কঙ্গো, মালি, দারফুর এবং শান্তি রক্ষার অন্যদের অভিজ্ঞতাগুলো পরিকল্পিতভাবে এবং খুব কার্যকরভাবে ব্যবহার করা যেতে পারত। যেসব দেশ এই বিরোধের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত নয় বা স্বার্থের সংঘাত নেই, এমন দেশ থেকে শান্তি রক্ষাকারী বাহিনী নিযুক্ত করা যেতে পারত। এই শান্তিরক্ষী বাহিনী দেশের সব গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র, বিমানবন্দর ও গুরুত্বপূর্ণ বিরোধপূর্ণ অঞ্চলগুলোয় নিযুক্ত থাকতে পারত এবং আফগানিস্তানের সব বিরোধী দল এবং সরকারের একটি চুক্তির মাধ্যমে শান্তি বজায় রাখতে পারত।
প্রচারযন্ত্র ব্যবহারে আফগান সরকার অত্যন্ত দুর্বল। তবে তালেবান একেবারে বিপরীত। যেখানে তালেবানরা শূন্য থেকে ১০০ দেখায়, সেখানে সরকার প্রায় নীরব। তালেবানদের সঙ্গে তাদের লড়াইয়ের ফলাফল প্রতিদিন সংবাদমাধ্যমে আসছে না। জনগণের জন্য তারা যে যথাসম্ভব সবকিছুই করছে, সেটা সরকারকে জানাতে হবে। সেনাবাহিনীর প্রধান প্রধান যানবাহন এবং কাফেলা আজকাল আর কাবুলে চলাচল করছে না। ফলে সাধারণ জনগণ বুঝতে পারছে না, যেকোনো আক্রমণ সম্পর্কে সরকার সজাগ রয়েছে। কৌশলগত সম্পদের ১০ শতাংশ সংস্থানও যে তালেবানদের হাতে নেই এবং সরকারের কাছে যে সমস্ত আধুনিক অস্ত্র, সরঞ্জাম এবং উচ্চ প্রশিক্ষিত সেনাবাহিনী রয়েছে, সেটা তারা জনগণকে বোঝাতে পারছে না। তবে সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি। এখনো সব দল একসঙ্গে বসে সম্মিলিত হওয়ার বিষয়ে একমত হলে আফগানিস্তানের আশার আলো রয়েছে।
****মৃদুল কান্তি বিশ্বাস বর্তমানে আফগানিস্তানে একটি বিশ্বব্যাংক অর্থায়িত প্রকল্পের আন্তর্জাতিক প্রোগ্রাম উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: জুলাই ২৫, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,