আজ ৫ মে, অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের জন্মদিন .. তাই এই আনন্দের দিনে শুধু তাঁর বাবা, মা, তাঁর মানসিক প্রস্তুতি, স্কুল ও কলেজের কথা ..
চট্টগ্রাম শহরের আস্কারখান দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম ঘেঁসে এক সরু গলির শেষপ্রান্তুে দুটি দোতলা বাড়ী, সামনে খুব সুন্দর ফুলবাগান। মাটির ঐ দোতলা বাড়ীতে বসবাস করেন ওয়াদ্দাদার বা ওয়াদ্দেদার পরিবার। মিউনিসিপ্যালিটির হেডক্লার্ক জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার ও তাঁর স্ত্রী প্রতিভাদেবী।
ছোটবেলায় খুব কষ্টে কাটে জগদ্বন্ধুবাবুর। বাবা’কে হারিয়ে দুই ভাই ও মা’য়ের সাথে পিতৃভিটে ডেঙ্গাপাড়া ছেড়ে ধলঘাটে মামার বাড়ীতে আসেন। সেখানে মেট্রিক পাশ করার পর মা-মামারা তাঁর বিয়ে দিয়ে দেন। এরপর কলকাতার রিপন কলেজ থেকে আই.এ পাশ করার পর ধলঘাটে ফিরে চট্টগ্রাম মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুলে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন। যদিও ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময়ে স্কুলের সাহেব কর্তার আচরণে প্রতিবাদ করে তাঁর চাকরিটি যায়। কিছু বছর পরে তিনি হেডক্লার্কের চাকরি পান। খুব স্বচ্ছল ঘরের আদুরে মেয়ে ছিলেন প্রতিভাদেবী। কিন্তু বিয়ের পরে স্বামীর সংসারের দারিদ্র মোকাবিলা করেছেন নিজের বুদ্ধিতে। তিনি শাকসব্জীর ক্ষেত ও ফলের বাগান করেছিলেন। দুধ ও ডিম বিক্রির জন্য পুষে ছিলেন গরু, ছাগল ও হাঁস। এমনকি শেষদিকে মেয়ের জন্য ইংরেজ শাসকের অত্যাচারে যখন জগদ্বন্ধুবাবুর হেডক্লার্ক চাকরিও যায়, তখন তিনি ধাত্রীবিদ্যা শিখে সংসার চালিয়েছেন। ১৯১১ সালের ৫ মে ধলঘাটের বাড়ীতেই প্রীতিলতার জন্ম, আদর করে প্রতিভাদেবী নাম রেখেছিলেন – রাণী। তাঁরা ছিলেন ছয় ভাইবোন- মধুসূদন, প্রীতিলতা, কনকলতা, শান্তিলতা, আশালতা ও সন্তোষ। এই পরিবারের পদবী ছিল দাশগুপ্ত। শোনা যায়, এক পূর্বপুরুষ নবাবী আমলে ‘ওয়াহেদেদার’ উপাধি পান, সেই থেকে হয়ে গেল ‘ওয়াদ্দাদার’ বা ‘ওয়াদ্দার’ বা ‘ওয়াদ্দেদার’। পরবর্তীকালে ধলঘাট ছেড়ে জগদ্বন্ধুবাবু চট্টগ্রাম শহরের আস্কারখান দীঘির দক্ষিণ-পশ্চিম পাড়ে টিনের ছাউনি দেওয়া মাটির দোতলা বাড়িতে পরিবার নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করতেন।
আদরের রাণী ১৯১৮ সালে ডা. খাস্তগীর সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শুরু করেন। তিনি প্রতি পরীক্ষায় প্রথম হতেন। এইসময় তাঁর প্রিয় শিক্ষিকা হয়ে ওঠেন ইতিহাসের ঊষা দিদিমণি। রাণীর শিশুমনে স্বদেশ ভাবনায় শিক্ষিকা ঊষাদির এক বিরাট প্রভাব আছে। আর প্রভাব ছিল সম্পর্কে দাদা পূর্ণেন্দু দস্তিদারের। একবার চারিদিকে হৈ হৈ কাণ্ড, ১৯২৩ সালের ১৩ ডিসেম্বর, সরকারি রেলওয়ে কারখানার বেতনের গাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। যে ঘটনা কিশোরী প্রীতিলতার মনে অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। কিছুদিন পরে আবার উত্তেজনা, ডাকাতরা সবাই ধরা পড়েছে। বাবা বলেছিলেন, একজন মাস্টারমশাই আছেন। রাণী জিজ্ঞাসা করে, ‘মাস্টার মশাই ডাকাত কেন বাবা ?’ বাবা বলেন, ‘ওরে.. ওঁরা সেই ডাকাত নয়, ওঁরা স্বদেশী, ওঁরা বাঘা যতীন, ক্ষুদিরামের দলের লোক .. দেশের কাজ করছেন তাই ইংরেজ ওদের ডাকাত বলে।’ রাণী শুনেছে বাবা মা’কে বলছেন মাস্টারমশাইয়ের নাম ‘সূর্য সেন’ – পরবর্তীকালে যে নামের মোহ রাণী এজন্মে আর ছাড়তে পারেনি।
অন্তর্মুখী, লাজুক ও মুখচোরা স্বভাবের মেয়েটি ঘর ঝাঁট দেওয়া, বাসন মাজা সহ প্রায় সমস্ত কাজে মা’কে সাহায্য করতেন ঠিক অন্য দশটা বাঙ্গালী কিশোরীদের মতোই। আবার সবাই ঘুমিয়ে গেলে রাত্রে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তেন পূর্ণেন্দুদার এনে দেওয়া ‘ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মীবাঈ’, ‘শহীদ ক্ষুদিরাম’, ‘বাঘা যতীন’, ‘দেশের কথা’ বইগুলো। আর ভগিনী নিবেদিতার লেখা বিভিন্ন বই, যা পড়ে রাণী ক্রমশ সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের সমর্থক হয়ে উঠলেন।
১৯২৬ সালে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ‘সংস্কৃত কলাপ’ পরীক্ষায় বৃত্তি লাভ করেন। ১৯২৮ সালে তিনি প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন। প্রণাম করতে যান ঊষা দিদিমণিকে। দিদিমণি জানান, ‘এখানেই থেমে থেকো না .. এমন কিছু করো যা অন্য কেউ ভাবে না।’ পরীক্ষার ফলে বাবা খুব খুশি, মা ভালো ভালো খাবার করেছে .. তবু রাণীর বুক কাঁপে .. মাঝে পরীক্ষা দেওয়ার পরে রাণী দেখেছে বাড়ীতে ঘটকের আনাগোনা .. জানতে পারে বাবা তার বিয়ে প্রায় ঠিক করে ফেলেছেন .. কারা যেন দেখতে আসবে তাকে। শেষে মনের জোরে মা’কে বলে, আমি আরো পড়ব। মা হেসে বলেন, ‘যা গিয়ে বাবা কে বল।’ জগদ্বন্ধুবাবু শোনার পর ভাবেন, তাইত .. এত তাড়াতাড়ি যদি বিয়েই দেব তবে পড়ালাম কেন! অনেকটা এগিয়েও সম্বন্ধ ভেঁঙে দেন তিনি, মুখে বলেন, ‘বেশ তাই হোক .. রাণী আরো পড়বে।’
এরপর আই.এ. পড়ার জন্য প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন। যেখানে তাঁর এক নতুন জীবন শুরু হয়। সেখানে ‘শ্রীসংঘ’ নামে একটি বিপ্লবী সংঘঠনের ‘দীপালী সংঘ’ নামে একটি মহিলা শাখা ছিল। প্রীতিলতা দীপালী সংঘে যোগ দেন, যা ছিলো এক ধরনের মহিলা বৈপ্লবিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। এই দীপালী সংঘে যোগদানের মূলে ছিলেন লীলাদি, লীলা নাগ রায়। এই লীলাদি একদিন এক কাগজ দেয়, কাগজটিতে লেখা আছে ‘স্বরাজ সাধনায় নারী’ – লেখক শ্রীসুভাষচন্দ্র বসু। “.. প্রত্যেক নারীকে নিজের ক্ষমতা চিনতে হবে, বলতে হবে হ্যাঁ আমিও পারি, ভারতের তথা বাংলার মেয়েদের আর শুধু বাইরে থেকে নয়, সরাসরি একই সারিতে পুরুষদের সাথে দেশের এই স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশ নিতে হবে ..” – এই ছিল লেখার বিষয় .. লোহা যেমন চুম্বককে আকর্ষণ করে, এই কাগজ ঠিক তেমনি টেনে নিয়ে গেল প্রীতিলতা’কে। ১৯২৯ সালে চট্টগ্রামে জেলা রাজনৈতিক সম্মেলন হয়। সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু। সেই সম্মেলনের মধ্যে মহিলা পরিচালিত একটি আলাদা মহিলা কর্মী সভা হয়, হয়েছিল জেলা ছাত্র-ছাত্রী সম্মেলন। সেসময় প্রীতিলতা পুজোর ছুটিতে বাড়ীতে আসেন এবং সম্মেলনে যোগ দেন, সুভাষচন্দ্র বসুর সাথে পরিচয় হয় তাঁর, পেয়েছিলেন আশির্বাদ।
১৯৩০ সালে আই.এ. পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সবার মধ্যে (বাংলা প্রদেশ) পঞ্চম স্থান লাভ করেন। এই ফলাফলের জন্য তিনি মাসিক ২০্ টাকার বৃত্তি পান এবং কলকাতার বেথুন কলেজে বি.এ. পড়তে যান। সেখানে হস্টেলে থাকতেন। কলকাতায় ‘ছাত্রী সংঘে’র মাধ্যমে নিজের পথ ক্রমশ দেখতে পায় রাণী। ফাঁসির আদেশ পাওয়া বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সাথে আলিপুর জেলে তাঁর বোন পরিচয়ে দেখা করেছেন, বহু দিন। একদিন রামকৃষ্ণ বিশ্বাস’কে জিজ্ঞাসা করেন, ‘দাদা, বলতে পারেন বিপ্লবী জীবনের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন কী .. একজন বিপ্লবী কিভাবে গড়ে তুলবে নিজেকে ?’ উত্তরে বিপ্লবী রামকৃষ্ণ বলেছিলেন, ‘এই প্রশ্নের উত্তর যিনি দিতে পারবেন তাঁর দেখা তুমি হয়ত একদিন পাবে রাণী .. তিনি আমাদের মাস্টারদা।’ বেথুন কলেজের হস্টেলে প্রীতিলতার সাথে প্রথম পরিচয় হয় কল্পনা দত্তের। পরে বন্ধু কল্পনাই প্রীতিলতাকে প্রথম নিয়ে আসেন মাস্টারদার সামনে।
১৯৩২ সালে ডিসটিংশান নিয়ে তিনি বি.এ. পাশ করেন প্রীতিলতা। ১৯৩২ সালের ১৯ এপ্রিল প্রীতিলতা কালকাতা থেকে চট্টগ্রামে ফেরেন, ঠিক তার আগের দিন ঘটে গেছে বিখ্যাত চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখল।
প্রীতিলতার বি.এ. তে অন্যতম বিষয় ছিল দর্শন। এই বিষয়ে তিনি অনার্স করতে চেয়েছিলেন কিন্তু বিপ্লবের সাথে যুক্ত হবার তীব্র আকাঙ্ক্ষার কারণে অনার্স পরীক্ষা তাঁর আর দেওয়া হয়নি। ডিসটিংশান নিয়ে তিনি বি.এ. পাশ করেছিলেন। কিন্তু, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত থাকায় কৃতিত্বের সাথে স্নাতক পাস করলেও তিনি এবং তাঁর সঙ্গী বীণা দাসগুপ্তের পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়। অবশেষে দীর্ঘ প্রায় আশি বছর পরে ২২ মার্চ, ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে তাঁদের মরণোত্তর স্নাতক ডিগ্রী প্রদান করা হয়।
শৈশবে তাঁকে সবাই ডাকতো ‘রাণী’ বলে। তিনি ২১ বছর ৪ মাস ১৮ দিনের একটি জীবনযাপন করে গেলেন .. আর ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে অমরত্বের ফলকে নিজের নামটি লিখে রাখলেন। আজ ৫ মে প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের শুভ জন্মদিন .. তাঁকে জানাই আমাদের অন্তরের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও হাজার হাজার প্রণাম।
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ: মে ০৫, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,