Welcome to rabbani basra

আমার লেখালাখির খাতা

শুরু হোক পথচলা !

Member Login

Lost your password?

Registration is closed

Sorry, you are not allowed to register by yourself on this site!

You must either be invited by one of our team member or request an invitation by email at info {at} yoursite {dot} com.

Note: If you are the admin and want to display the register form here, log in to your dashboard, and go to Settings > General and click "Anyone can register".

পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের মধ্যে ভয়-উদ্বেগের পাশাপাশিই আছে মেরুবিভাজনের রাজনীতি(২০২১)

Share on Facebook

পশ্চিমবঙ্গে মুসলিমদের মধ্যে ভয়-উদ্বেগের পাশাপাশিই আছে মেরুবিভাজনের রাজনীতি বদলানোর সম্ভাবনাও
লেখক: মানিনী চট্টোপাধ্যায়

রমজান মাসের তৃতীয় দিন। ফরিদা এবং তাঁর স্বামী সদ্য ইফতার সেরেছেন। দিল্লি থেকে আসা অতিথিদের বোন চায়নার রেকাবিতে জলখাবার সাজিয়ে পরিবেশন করেছেন। বসার ঘরে স্নিগ্ধ শান্ত পরিবেশ। লাল রঙের শান বাঁধানো মেঝে আর কালো আবলুশি রঙের শো-কেসের কাচের ভিতর রুপোলি গিল্টির সামগ্রীর আভায়, আসবাবপত্রের মৃদু উপস্থিতিতে, মেঝেয় বিছানো গালিচার অনুচ্চার বর্ণে একটা হারিয়ে যাওয়া দিনের বাতাবরণ, যা পার্ক সার্কাসের মতো কর্কশ শব্দময় এলাকার নৈকট্যকে বুঝতেই দেয় না।

ফরিদার স্বামীর (ধরা যাক তাঁর নাম ফারুক) পরিবার কোনও এক সময় অযোধ্যা থেকে এসেছিল। কিন্তু সারা জীবন তিনি কলকাতাতেই কাটিয়েছেন। এই শহরকে তিনি নিঃশর্তে ভালবাসেন। এখানে তাঁর ধর্ম বা ভাষার কারণে কখনও নিজেকে বিচ্ছিন্ন বলে মনে হয়নি। ফারুক জানালেন, রমজানের প্রথম দিন প্রতিবেশী এক পঞ্জাবি হিন্দু পরিবার ইফতারের জন্য খাবার পাঠিয়েছে। পরের দিন এক শিখ বন্ধু পাঠিয়েছেন হালিম। এ বছরের রমজান তাঁদের কাছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তাঁদের ছোট মেয়ে এই বছরই প্রথম রোজা রাখছে। মুসলমান পরিবারে কোনও মেয়ের রোজার প্রথম দিনটি ‘রোজা খুশাই’ নামে পরিচিত। এদিন সূর্যাস্তের পর উপবাসভঙ্গের থালায় বিশেষ আয়োজন থাকে। কোভিড অতিমারির কারণে এই সব উদ্‌যাপনে এ বছর অনেকটাই কাটছাঁট কতে হয়েছে। কিন্তু ফারুক জানালেন, এর মধ্যেও তাঁর এক ‘বাঙালি হিন্দু’ বন্ধু এই উপলক্ষে বাঙালি মিষ্টি পাঠিয়েছেন।

ফারুক বলছিলেন, “ভালবাসা আর স্নেহ দিয়ে এ শহর আমাকে লালন করেছে।” কিন্তু এটাও বললেন যে, কতদিন এমন থাকবে বলা কঠিন। যদিও এ কথা তিনি অতি মৃদু স্বরে, বিনীত ভাবে জানালেন, যদিও তাঁর উচ্চারণে ক্রোধের আঁচটুকুও ছিল না, তিনি নম্র ভাবেই বলে গেলেন হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে “যে পরিমাণ বিষ, যে পরিমাণ মুসলিম-বিরোধী গরল” প্রচারিত হচ্ছে, আর যাঁদের তিনি কোনও দিন এ বিষয়ে সন্দেহটুকুও করেননি, সে সব সহকর্মীরা এই সব প্রচারে প্রভাবিত হচ্ছেন, তাতে এই সহনশীল আর সাহচর্যের পারস্পরিকতা কতদিন থাকবে, বলা দুরূহ।

এ রাজ্যে বিজেপি-র ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা তাঁর মধ্যে একটা ভয় আর হতাশার জন্ম দিচ্ছে, সে কারণে তিনি আর ফরিদা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তৃণমূলের একান্ত ভক্ত না হয়েও তাঁর দলকে ভোট দিতে বাধ্য হচ্ছেন। কারণ এ ছাড়া আর ‘কোনও উপায়’ তাঁদের সামনে খোলা নেই।

নাসির আলি আর জামাত আলি একবারেই ভিন্ন এক জগতের বাসিন্দা। ফারুকের পরিশীলিত আভিজাত্য বা বিপন্নতার শান্ত অভিব্যক্তি তাঁদের কণ্ঠে নেই। তাঁদের আতঙ্ক অনেক বেশি, তাঁদের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ অনেক বেশি সোচ্চার। উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়া বিধানসভার হরিবাড়ি এলাকার মোড়ের মাথায় একটা খুপরি ঘরে পান-বিড়ির দোকান চালান। তিনি বললেন, “এখানে আমরা এক থালায় ভাত খাই।” হাড়োয়ায় ‘দিদি’ একটা কারণেই এবং একমাত্র কারণেই জিতবেন, কেন না, “বিজেপি বিভাজনের রাজনীতি করে, সেখানে দিদি হলেন ঐক্যের প্রতীক।” জামাত আলির বয়স বেশ খানিকটা বেশি। আলোচনায় যোগ দিতেই তাঁর কণ্ঠে উপচে উঠল ক্রোধ। এই এলাকার বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা হল সংলগ্ন ভেড়িতে মাছ ধরা। বাকিরা চাষবাস করেন। “বংশ পরম্পরায় আমরা এখানে বাস করছি। এ মাটি আমাদের। এ পানি আমাদের”, তিনি বললেন। তাঁর মতে, বিজেপি জিতলে তাঁদের জীবন, তাঁদের রুজি-রোজগার সঙ্কটে পড়বে। জামাত জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি দিলীপ ঘোষের বক্তৃতা শোনেননি?” এর পরেই ভেঙে পড়লেন, “ওরা যদি আসে, এনআরসি করে আমাদের তাড়াবে, তাড়াবে, তাড়াবে।”

ফারুক আর নাসেরের সামাজিক অবস্থানের মধ্যে সাযুজ্য খুব সামান্য। কিন্তু বিধানসভা নির্বাচনে রাজনৈতিক নেতা আর গণমাধ্যমের তাড়নায় তাঁরা আজ একই পঙক্তিতে। সমস্ত মুসলমানকে একটা একতরফা বর্গ হিসেবে দেখা শুরু হয়েছে। যেখানে স্থানীয় এবং বহিরাগত বিজেপি নেতাদের বিদ্বেষপূর্ণ, বিভাজনমূলক বক্তৃতা সংখ্যাগুরুর সামনে মুসলমানদের নির্বিচারে একটা ‘অন্যত্ব’য় পর্যবসিত করছে, সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেকে কিছুটা ‘রক্ষক’ ভাবমূর্তিতে নিয়ে আসতে সমর্থ হয়েছেন এবং তৃতীয় বারের জন্য ক্ষমতায় আসতে একটা ‘সম্মিলিত’ মুসলিম ভোটের উপর নির্ভর করছেন।

কিন্তু যদি রাজ্যের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলি ঘুরে দেখা যায়, তো দ্রুত বোঝা যাবে যে, ভোটপণ্ডিতরা বিভাজনের বিষয়ে যা ভাবছেন, বাস্তবের ছবিটা আসলে তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল। ভয় আর উদ্বেগ অতিক্রম করে একটা নতুন আলোড়ন রাজ্যের মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, যা হিন্দু-মুসলমান বা বিজেপি-তৃণমূলের জোড়া দ্বন্দ্বকে টপকে অন্য এক চ্যালেঞ্জের সামনে নিয়ে যায়।

হরিবাড়ির সেই মোড়ের কাছেই আরও এক বার ফিরে যাওয়া যাক। হাড়োয়া বিধানসভার আমিনপুর বাজারের রাস্তার ধারের এক চায়ের দোকানের আড্ডায় এক দল মানুষ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে গুলতানি করছিলেন। বিজেপি-কে তুলোধনা করার পাশাপাশি তাঁদের আক্রমণের আরও বড় লক্ষ্য দেখা গেল ‘ভাইজান’ ওরফে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের (আইএসএফ) নেতা আব্বাস সিদ্দিকি। যিনি বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের ‘সংযুক্ত মোর্চা’ বা চলতি ভাষায় ‘জোট’-এ রয়েছেন।

চায়ের দোকানের আড্ডাধারীদের রাগের কারণ স্পষ্ট। হাড়োয়ায় লড়াইটা তৃণমূল আর বিজেপি-র মধ্যে নয়, বরং তা তৃণমূল আর আইএসএফ-এর মধ্যে। যত জন মানুষের সঙ্গে কথা বললাম, তাঁদের অধিকাংশই বিজেপি প্রার্থীর নামটুকুও জানেন না। তাঁরা বর্তমান তৃণমূল বিধায়ক হাজি নুরুল ইসলাম এবং তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আইএসএফ-এর কুতুবুদ্দিন ফতেহির বিষয়েই কথা বলছিলেন। হাড়োয়ার ছবি এই রকম হলে পাশের বিধানসভা কেন্দ্র বসিরহাট উত্তরের ছবিটা আবার অন্য। সেখানে প্রায় প্রতিটা ল্যাম্পপোস্ট আর গাছে শোভা পাচ্ছে আইএসএফ-এর নীল-সবুজ-সাদা পতাকা আর তাতে আঁকা বড় এক খাম চিহ্ন।

ওই একই বিধানসভায় স্বরূপনগর বাজারের শোনা গেল আইএসএফ প্রার্থী বায়াজিদ আমিনের পক্ষে কলরব। এর একটা কারণ এই যে, তৃণমূল রফিকুল ইসলাম মণ্ডলকে তাঁরা ‘পাল্টিবাজ’ হিসেবেই চেনেন। এর আগের বার সিপিএম প্রার্থী হিসেবে তিনি খুব কম ব্যবধানে তিনি জিতেছিলেন এবং পরে তৃণমূলে যোগ দেন। কিন্তু এমন অবস্থায় তৃণমূল আর আইএসএফ-এর ভোট কাটাকাটি কি বিজেপি-র পালে বাতাস দেবে না? দলের এক বয়স্ক মুখ বোঝালেন, তেমন কোন সম্ভাবনাই সেখানে নেই। “এখানে কোনও বিজেপি নেই। আপনি বিজেপি-র কোনও পোস্টার দেখেছেন? পোস্টার সাঁটার জন্য কোনও লোক পর্যন্ত পায়নি ওরা। এখানে রফিকুল আর বায়াজিদের মধ্যেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে।”

‘হাড্ডাহাড্ডি লড়াই’-এর কথা এই জেলার আর একটা বিধানসভাতেও শোনা গেল। দেগঙ্গার আসনে তৃণমূলের রহিমা মণ্ডল এবং আইএসএফ-এর করিম আলির মধ্যেও ‘হাড্ডাহাড্ডি লড়াই’ হবে— এমনটাই মত সেখানকার মানুষের। লড়াইয়ের তৃতীয় মুখ হাসানুজ্জামান চৌধুরী। কিন্তু তিনি বিজেপি-র প্রার্থী নন, ফরওয়ার্ড ব্লকের। কিন্তু এখানেও মুসলিম ভোটের ত্রিধাবিভাজন বিজেপি প্রার্থী দীপিকা চট্টোপাধ্যায়ের পালে বাতাস দেওয়ার একটা সম্ভাবনাকে জিইয়ে রেখেছে।

ভাইজানকে তৃণমূল সমর্থকরা যতই ‘বিজেপি-র দালাল’ বলে বর্ণনা করুন, যতই তাঁকে ‘ভুঁইফোঁড়’ বলে চিহ্নিত করুন, সাধারণ ভোটদাতাদের একটা অংশ কিন্তু তৃণমূল থেকে তাঁদের বিচ্ছিন্নতার কারণেই আইএসএফ-এর দিকে ঢলছেন। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার আমফান-বিধ্বস্ত মুসলমান প্রধান এলাকাগুলিতে ত্রাণ তহবিল নিয়ে অব্যবস্থা ও যথেচ্ছাচার একটা দগদগে ক্ষত তৈরি করে রেখেছে, যা সহজে সেরে ওঠার নয়। রাজ্যের অন্যান্য জায়গার মতোই এখানেও তৃণমূলের ‘গুন্ডাগিরি’ আর ‘কাটমানি সংস্কৃতি’ নিয়ে সমালোচনা আছে। দেগঙ্গার এক দোকান মালিক আজিজুল ইসলাম নৈর্ব্যক্তিক ভাবে বললেন, “যদি সিপিএম এক নম্বরের চোর হয়ে থাকে, এরা হল দশ নম্বরের চোর।” ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে এই অভিযোগ কিন্তু জেলা থেকে জেলায় ধর্মীয় বিভাজন নির্বিশেষে লক্ষণীয়। তবে এর মধ্যে একটা পার্থক্য রয়েছে। যদি অন্যত্র তৃণমূলের সমালোচনা ‘পরিবর্তন’ (সাধারণ ভাবে বিজেপি-কে ভোটদানের অর্থে)-এর পক্ষে হয়ে থাকে, এই সমস্ত এলাকায় তা বোঝাচ্ছে আইএসএফ-কে সমর্থন।

দেগঙ্গা, বসিরহাট উত্তর, বাদুড়িয়া, ভাঙ্গড় এবং ক্যানিং পূর্বের মতো বিধানসভা কেন্দ্রগুলির মুসলমান বাসিন্দাদের বহুধাবিভক্ত রাজনৈতিক সংবেদ আরও একটা বিষয়কে স্পষ্ট করে তুলল। তারা এমন ৩১টি বিধানসভা কেন্দ্রের বাসিন্দা, যেখানে মুসলিম ভোট মোট ভোটের ৬০ শতাংশ। এমন একটা মেরুবিভাজিত নির্বাচনে এই কেন্দ্রগুলি তৃণমূলের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে দাঁড়ালে আশ্চর্যজনক ভাবে দেখা যাচ্ছে, যে সব এলাকায় মুসলমান সংখ্যাধিক্য, সেখানে বিজেপি-ভীতি তুলনামূলক ভাবে কম। নির্বাচন এখানে অনেকটাই স্বাভাবিক, জীবন ও জীবিকার প্রশ্ন, প্রশাসন ও পরিষেবা সংক্রান্ত ইস্যুই এখানে সামনে। এর বিপরীতে সেখানে মুসলমান জনসংখ্যা তুলনামূলক ভাবে কম (২০ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে), সেই সব এলাকায় বিজেপি-র অন্ধ মেরুকরণের প্রচার বড় সংখ্যক মুসলমানকে তৃণমূলে ভোট দিতে প্রাণীত করছে।

নির্বাচনে আইএসএফ ভাল ফল করুক বা না করুক, এই নতুন এবং অপরীক্ষিত শক্তি কিন্তু মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বিগত কয়েক বছর ধরে চলে আসা এক বৃহত্তর পরিবর্তনের হাওয়ার চিহ্নায়ক। এখনও পর্যন্ত যদিও বিষয়টা খুব বেশি নজর কাড়েনি, যতটা বিজেপি ও তার ‘নিম্নবর্গের হিন্দুত্ব’-এর বাচন কাড়তে পেরেছে।

পশ্চিমবঙ্গের মুসলমান জনসংখ্যা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ (সর্বভারতীয় নিরিখে কাশ্মীর এবং অসমের পরেই) হলেও এ রাজ্যের রাজনীতিতে ‘মুসলিম ফ্যাক্টর’ সে অর্থে কখনও দেখা যায়নি। সর্বোপরি, ভারতের অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় এ রাজ্যের মুসলমানরা মূলত গ্রামবাসী। কয়েক বছর আগে ‘দ্য লিভিং রিয়্যালিটি অব মুসলিমস ইন ওয়েস্ট বেঙ্গল’ শিরোনামের এক শ্রমসাধ্য প্রতিবেদনে জানানো হয়েছিল, তাঁদের এই গ্রামীণ শিকড়ের কারণে তাঁরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সরকারি চাকরি, গণমাধ্যম, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র ইত্যাদি নাগরিক পরিসরগুলিতে প্রায় অদৃশ্য’। গ্রামবাংলায় তাঁরা রয়েছেন ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষিজীবী হয়ে, যাঁরা এক সময়ে সিপিএমের দুর্ধর্ষ ‘গণভিত্তি’ ছিলেন।

মুসলমান সমাজকর্মী এবং গবেষকরা জানান, ২০০৬-এর সাচার কমিটির রিপোর্ট প্রকাশ এই সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে একটা বিশেষ বাঁকবদল ছিল। ইউপিএ সরকার কর্তৃক নিযুক্ত এই কমিটির প্রধান ছিলেন রাজিন্দর সাচার। এই কমিটির কাজ ছিল ভারতে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের আর্থ-সামাজিক এবং শিক্ষাগত অবস্থার পর্যালোচনা। এই রিপোর্টে বাংলার ক্ষেত্রে যা জানা যায়, তা বিস্ময়কর। বাম আমলে যদিও মুসলমানরা এ রাজ্যে এক রকম নিরাপত্তাবোধের মধ্যে বাস করছিলেন, তবুও এই রিপোর্ট অনুযায়ী, তাঁরা দেশের সব থেকে দরিদ্র এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও অন্যান্য জরুরি পরিষেবা থেকে সবচেয়ে বেশি মাত্রায় বঞ্চিত ছিলেন।

কিন্তু এই রিপোর্ট বিশ্লেষিত হওয়ার ও সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ করার আগেই গ্রামবাংলায় বামফ্রন্টের তরফে শিল্পের জন্য কৃষিজমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত অশান্তি শুরু হয়। জমি হারানো ক্ষুদ্র কৃষকদের মধ্যে একটা বড় অংশের মানুষ ছিলেন কলকাতার পূর্ব প্রান্তে এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনার রাজারহাটে নগরায়নের উদ্দেশ্যে জমি অধিগ্রহণের ফলে বিপর্যস্ত মুসলমান। সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রামের আন্দোলন তাঁদের আরও বেশি পরিমাণে বাম-বিদ্বেষী করে তোলে। এবং তাঁরা তৃণমূলের পাশে এসে দাঁড়াতে শুরু করেন, যার ফল ২০১১-এর বিধানসভা নির্বাচনে রীতিমতো দৃশ্যমান হয়।

ক্ষমতায় আসার পরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজিন্দর সাচারের নেতৃত্বে এক উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করেন বাংলার মুসলমানদের পরিস্থিতি বোঝার জন্য এবং সেই অনুযায়ী তাঁদের উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেন। সাবির আহমেদ নামের এক গবেষক বাংলার সামাজিক ভাবে বঞ্চিত মুসলমানদের অবস্থা নিয়ে বিস্তারিত ক্ষেত্র সমীক্ষা করেছেন। সাবির সখেদে জানিয়েছেন, মমতা সেই কমিটি তৈরি করেননি। তার বদলে ‘গোলমেলে উলেমা’দের উপর তিনি আস্থা রাখতে শুরু করেন।

কিন্তু এর পাশাপাশি সাবির এ কথাও স্বীকার করেছেন যে, তৃণমূল সরকারের বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক নীতি এ রজ্যের মুসলমান সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রায় কিছু বস্তুগত পরিবর্তন আনতে সমর্থ হয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক তরুণ অধ্যাপক আবদুল মতিন ফুরফুরা শরিফের উপর গবেষণা করেছেন। মতিন কিন্তু সাবিরের তুলনায় তৃণমূলের দিকে একটু বেশি সমালোচনার দৃষ্টিতেই তাকিয়েছেন। কিন্তু তিনিও এ কথা মেনে নিয়েছেন যে, ২০১১-২০১৬ সালের প্রথম দফার শাসনে তৃণমূল মুসলমান সম্প্রদায়ের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কিছুটা সচেষ্ট ছিল। এর মধ্যে রাজারহাটে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় গঠন, মুসলমানদের ওবিসি সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা (রাজ্যের ৯৫ শতাংশ মুসলমানই ওবিসি-র অন্তর্ভুক্ত), শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, পুনরায় জমি অধিগ্রহণ স্থগিতকরণ এবং সম্প্রদায়ের নিচের দিকের মানুষদের রাজনীতিতে তুলে নিয়ে আসার বিষয়গুলি অন্যতম।

কিন্তু মমতার দ্বিতীয় দফার শাসনকালে বিষয়গুলো বদলে যায়। কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর এ রাজ্যেও তারা তাদের আগমনের রাস্তা তৈরি শুরু করে। মমতাও মুসলমানদের মন জয়ে খোলাখুলি ধর্মীয় এক ভঙ্গিমাকে সামনে আনেন। রেড রোডে ইদের নমাজে উপস্থিত থেকে, হজ যাত্রীদের এবং হজ প্রত্যাগতদের উদ্দেশে সুবিশাল হোর্ডিং টাঙিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়ে, মুসলমান মেয়েদের কায়দায় মাথা ঢেকে, কাওয়ালি ও মুশায়রার আসর বসিয়ে, ইমাম ও মোয়াজ্জিমদের মাসিক ভাতা দিয়ে তিনি “শুধুমাত্র হিন্দুদের সামনে এটা বোঝাতে সমর্থ হন যে, তৃণমূল মুসলমান তোষণ করছে”— এমনই জানালেন নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক মুসলিম শিক্ষাজীবী। সেই সঙ্গে তিনি আরও বললেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এটা ভুলে গিয়েছিলেন যে বাংলার ইতিহাসে দেশভাগের মতো ব্যাপার রয়েছে। এটা কেরল নয়। এই সব করে তিনি এই সম্প্রদায়কে আরও বেশি করে সমালোচনার মুখে ঠেলে দিলেন।”

তবে শুধু এই বিষয়গুলিই নয়। মতিনের মতে, গত তিন-চার বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধীদের জন্য কোনও পরিসর ছাড়েননি। সে কংগ্রেসই হোক বা বামফ্রন্ট। অন্যদিকে, গোটা রাজ্যে দিকে দিকে আরএসএস-এর শাখার বাড়বাড়ন্ত হয়েছে।’’

এই প্রেক্ষিতেই আইএসএফ-এর জন্মকে বুঝতে হবে। বিধানসভা নির্বাচনের প্রাকমুহূর্তে আইএসএফ গঠিত হয়েছে। কিন্তু এর শিকড় অনেক দূরের অতীতে প্রোথিত। ফুরফুরা শরিফের প্রতিষ্ঠাতা পির আবু বকর ১৯ শতকের শেষ দিকে এবং ২০ শতকের গোড়ায় মুসলিম সংস্কার আন্দোলনের কুশীলব ছিলেন। কিন্তু দেশভাগের পর মধ্যবিত্ত মুসলমানদের বেশিরভাটাই যখন পূর্ব পাকিস্তানে চলে গেল, তবে থেকে সমাজ ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে শরিফের প্রতিপত্তিও কমতে লাগল। দেশভাগ-উত্তর বাংলায় বামপন্থী রাজনীতির প্রবাহ বাড়তে থাকায় ধর্মীয় বা জাতপাতকে আশ্রয় করে রাজনৈতিক নেতৃত্বে উঠে আসার বিষয়টাও দমে এল।

কিন্তু ১০ বছর আগে বামেদের পরাজয়ের পর রাজ্যের সামাজিক-রাজনৈতিক পটে এক বড় পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। ‘শ্রেণি’-ভিত্তিক রাজনীতির নিগড় জাত ও সম্প্রদায়গত আত্মপরিচয়ের রাজনৈতিকতার উত্থানে ভেঙে পড়েছিল। এক বাম নেতা দেখিয়েছেন যে, মমতা রাজবংশী, কোচ, নেপালি, লেপচা, ভুটিয়া এবং মুসলমানদের নিয়ে আত্মপরিচয়ের রাজনীতির সূত্রপাত করেন। ২০১৬-এর পর থেকে বিজেপি তথাকথিত নিচু জাতের উপরে জোর দেয় তাদের তৃণমূল স্তরে সামাজিক কাজকর্মকে কাজে লাগিয়ে।

অন্যান্য রাজ্যের মতোই বাংলাতেও বিজেপি-র উদ্দেশ্য বিভিন্ন জাত এবং বর্ণকে একটা হিন্দুত্বের কাঠামোয় বেঁধে ফেলা। এই প্রকল্পের কেন্দ্রে রয়েছে মুসলমানদের ‘শত্রু’ হিসেবে প্রতিপন্ন করা। এর দ্বারাই সম্ভবত অমিত শাহের ‘অনুপ্রবেশকারী’ তত্ত্বকে ব্যখ্যা করা যায়, নির্বাচন থাক বা না থাক।

আইএসএফ নিজেকে শুধুমাত্র মুসলমান কৃষকের প্রতিনিধি হিসেবে ব্যক্ত করে না। তার দাবি সে একই রকম ভাবে বঞ্চিত দলিত, আদিবাসী এবং ওবিসি সম্প্রদায়েরও অভিমুখ। তারা হিন্দুত্বের প্রতিস্পর্ধা হিসেবে বাংলায় একটা ‘বহুজন সমাজ’ (সুবিধাহীন বর্গের সমঝোতা মঞ্চ)-এর মতো পরিবর্ত মঞ্চ গড়ে তুলতে চায়। বাম ও কংগ্রেসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেই সম্ভাবনাকেই দৃঢ় ভিত্তি দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।

চার দশক আগে কাঁসিরাম ‘বহুজন সমাজ’ শব্দবন্ধটির এবং বহুজন সমাজ পার্টির জন্ম দিয়েছিলেন। সেই রকমই আব্বাস সিদ্দিকির প্রয়াসও ক্ষমতার রাজনীতির ঘোলাজলে মাছ ধরতে চাওয়া। কিন্তু এই মুহূর্তে আইএসএফ-এর মতো আন্দোলনকে এক গ্রামভিত্তিক, মাতৃভাষা কেন্দ্রিক, কৃষিভিত্তিক এবং একই সঙ্গে গণতান্ত্রিক ও চরম ভাবাপন্ন আবেগের বহিঃপ্রকাশ বলে মনে হতে পারে। যা উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া ‘বাম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ’ আদর্শ, যা এক দশক আগেও এই রাজ্যের রজনীতিকে শাসন করেছে, তার চেয়ে আলাদা।

এই নির্বাচন থেকে এটা বোঝা যাচ্ছে যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর পক্ষে মুসলমান ভোটের একটা বড় অংশ পেতে সমর্থ হবেন। কিন্তু সামনে যে আদর্শগত এবং রাজনৈতিক যুদ্ধ বাকি পড়ে রয়েছে, সেখানে বাংলার রাজনীতিতে উত্থিত এই নতুন তরঙ্গ একটা বড় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে।

লেখক: মানিনী চট্টোপাধ্যায়
সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা
তারিখ: এপ্রিল ২৪, ২০২১

রেটিং করুনঃ ,

Comments are closed

বিভাগসমূহ

Featured Posts

বিভাগ সমুহ