অ্যানা কুইন্ডলেন একজন মার্কিন লেখক ও সাংবাদিক। ১৯৯২ সালে তিনি পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছেন। ২০১৭ সালের ১৯ মে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির সমাবর্তনে বক্তা ছিলেন তিনি।
লেখক: মো. সাইফুল্লাহ
সমাবর্তন বক্তৃতা দেওয়া খুব কঠিন কাজ। কারণ আর যা-ই হোক, এখানে আমার কথা শুনতে কেউ আসেনি। সবাই আসে নিজের নাম কিংবা প্রিয়জনের নাম শুনতে। আমার সমাবর্তনে বক্তা ছিলেন বিখ্যাত নৃবিজ্ঞানী মার্গারেট মিড। তবু আমার তেমন কিছু মনে নেই। সেদিনের কথা স্মরণ করলে আমার শুধু তিনটা শব্দই মনে পড়ে—‘অ্যানা ম্যারি কুইন্ডলেন’, সঙ্গে চোখে ভাসে অনুষ্ঠানে উপস্থিত আমার বাবার মুখ। তোমাদের মতো তরুণদের জন্য কোনো বার্তা দেওয়া আরও কঠিন। কারণ, তোমরা ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি থেকে ডিগ্রি নিচ্ছ। আমার দাদির ভাষায় তোমাদের বলা হয় ‘দ্য স্মার্ট ওয়ানস,’ অর্থাৎ চৌকস।
স্মার্ট হওয়া ভালো। স্মার্ট ও কঠোর পরিশ্রমী তো হতেই হবে। স্মার্ট, পরিশ্রমী আর নির্ভীক যদি হতে পারো, তবে তো ‘হ্যাটট্রিক’। তুমি যা হতে চাও, তুমি কি তা হওয়ার মতো যথেষ্ট দৃঢ় ও স্মার্ট? নাকি তুমি ভীত? সমস্যাটা এখানেই, তাই না? সতর্কতা আদতে ‘কমন সেন্স’–এর ছদ্মবেশে হাজির হওয়া ভয়। ‘দ্য রোড লেস ট্রাভেলড’ কেবল কবিতা হিসেবে জনপ্রিয়, জীবনের বেলায় অজনপ্রিয়। যে পথে বেশি মানুষ হেঁটেছে, সেটাই তো নিরাপদ। কিন্তু জানো? আমি জীবনে যত ভয়াবহ সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যেসব সিদ্ধান্তকে মানুষ ‘বোকার মতো’ বলে আখ্যায়িত করেছে, সেগুলোই আমার জীবনে বড় পুরস্কার বয়ে এনেছে। মানুষ পায় না, এমন অনেক চাকরি আমি ছেড়ে দিয়েছি সেই সব নতুন সুযোগের জন্য, যা হয়তো আরও ভয়াবহ, ঝুঁকিপূর্ণ এবং সম্ভাবনাময় ছিল। আমি আমার সবচেয়ে বড় পদক্ষেপটা নিয়েছি তখন, যখন পাঁচ বছরের মধ্যে আমি তিন সন্তানের মা হয়েছি, আর পেশাজীবনেও তখন সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিলাম।
.
নিউইয়র্ক টাইমস–এর সম্পাদকীয় পাতাটা আমি ছেড়ে দিয়েছিলাম একজন পুরোদস্তুর ঔপন্যাসিক হব বলে। প্রকাশক বলেছিলেন, আমিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি স্বেচ্ছায় টাইমসে কলাম লেখা ছেড়েছি। একজন লিখেছিলেন, আমার সিদ্ধান্ত থেকে প্রতীয়মান হয় যে নারীরা সফল হতে ভয় পায়। কিন্তু আমি ভীত নই। আমার বরং ভয় করে যে জীবনটা একটা রোমাঞ্চকর গল্পের বদলে না জানি স্রেফ চাকরির জীবনবৃত্তান্তের মতো হয়ে যায়। তোমরা কেউই তেমন জীবন চাও না। অতএব ভয় যেন তোমাদের পেয়ে না বসে। আমাদের সংস্কৃতি, সমাজ, আমাদের চরিত্র, সবকিছুকেই দূষিত করে ফেলেছে ভয়। যদি অফিস ছেড়ে দিতে হয়, সেই ভয়ে আমাদের রাজনৈতিক নেতারা সত্যিকার অর্থে নেতৃত্ব দিতে পারেন না। আমাদের বড় বড় প্রতিষ্ঠান সত্যিকার উদ্ভাবনকে স্বাগত জানাতে পারে না, কারণ তারা ঝুঁকি নিতে ভয় পায়।
আমার সাবেক কর্মক্ষেত্রে, যা নিয়ে আমি গর্ব করি, যাকে এখনো আমি বলি আমার ‘ঘর’, সেই সংবাদ ব্যবসার জন্যও সবচেয়ে বড় শত্রু হলো ভয়। কোনো ভয় বা পক্ষপাত ছাড়া পাঠক, শ্রোতা, দর্শকের কাছে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন পৌঁছে দেওয়াই তো সংবাদ ব্যবসার কাজ। ক্ষমতাবানেরা যদি সেই সংবাদ বিশ্বাস না করে বা প্রকাশিত হোক সেটা না চায়, এমনকি সেই সংবাদ যদি আমার পাঠককে আঘাত করে, কষ্ট দেয়, তবু তাঁকে জানানো আমার কর্তব্য।
যদি মুক্তভাবে কথা বলতে না-ই পারি, যদি আমার কথা প্রতিধ্বনিত হয়ে আমার কাছেই ফিরে আসে, তবে বাক্স্বাধীনতার আর কী মানে থাকল?
জীবনের চেকলিস্ট নিয়ে যখন বসবে, একটা একটা করে টিক চিহ্ন দেবে; দেখবে চাকরি—পেয়েছি, জীবনসঙ্গী—পেয়েছি, নিজের একটা ঘর—পেয়েছি, তখন নিজেকে প্রশ্ন কোরো, জীবনে কি তুমি সত্যিই এসবই পেতে চেয়েছ, নাকি এগুলো চাও বলে ধরে নিয়েছ? জীবিত থাকা আর বেঁচে থাকার মধ্যে পার্থক্য এটাই।
টি এস এলিয়ট বলেছেন, ‘যারা সাধ্যের চেয়েও বেশি দূর যাওয়ার চেষ্টা করে, তারাই আবিষ্কার করতে পারে আদতে তার পক্ষে কত দূর যাওয়া সম্ভব’। (সংক্ষেপিত)
ইংরেজি থেকে অনুদিত
সূত্র: স্পিকোলা ডট কম
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: এপ্রিল ১১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,