Welcome to rabbani basra

আমার লেখালাখির খাতা

শুরু হোক পথচলা !

Member Login

Lost your password?

Registration is closed

Sorry, you are not allowed to register by yourself on this site!

You must either be invited by one of our team member or request an invitation by email at info {at} yoursite {dot} com.

Note: If you are the admin and want to display the register form here, log in to your dashboard, and go to Settings > General and click "Anyone can register".

রবীন্দ্রনাথ এবং লালন

Share on Facebook

ঠাকুর এবং সাঁই : আরশি নগরের দুই পড়শী।

লালন সাঁইয়ের আখড়ার জায়গা কুষ্টিয়া জেলায় বিরাহিমপুর পরগণার ছেউরিয়া গ্রাম যদি ঠাকুরবাড়ির জমিদারির মধ্যে না পড়তো, তাহলে লালন ফকিরকে আমরা চিনতাম কিনা – সে সন্দেহ থেকেই যায়। কারণ এই বাংলার বহু গুণী বাউল ফকিরদের,গম্ভীরা, ভাটিয়ালি আলকাপ ঝুমুর গানের রচয়িতাদের গান কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে, অথবা তাদের রচনা মুখে মুখে ফিরে হয়ত বেঁচে আছে, কিন্তু তাদের নাম কেউ জানেনা। প্রধানত রবীন্দ্রনাথের চেষ্টাতেই লালন ফকিরের নাম এবং তাঁর কাজের কথা দুনিয়ার সামনে উঠে আসে। একটা বিতর্ক যদিও অমীমাংসিত থেকে যায় যে, রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল কিনা।

এ বিষয়ে এখনও নিশ্চিত ভাবে বলার মতো কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এমনিতে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহের জমিদারির ভার নেন ১৮৯০ সালে। তার ঠিক এক বছর আগে লালন সাঁই দেহ রাখেন। তাই দুজনের সামনাসামনি না হওয়ারই কথা। তবে জমিদারির ভার পাবার আগেও দু’বার তিনি এসেছিলেন শিলাইদহতে। তখন কি তাঁদের সাক্ষাৎ হয়েছিল? লালনের প্রথম জীবনীকার বসন্ত কুমার পাল মহাশয় তাঁর বইতে সে রকম একটি ইঙ্গিত দিয়েছেন। পাল মহাশয়ের বই ‘মহাত্না লালন ফকির’ বইয়ের ভূমিকা লেখেন বঙ্গীয় পুরাণ পরিষদের সভাপতি শ্রী অজিত কুমার স্মৃতিরত্ন। তিনি এই ভূমিকায় লেখেন – ‘নিরক্ষর পল্লীবাসী হইতে আরম্ভ করিয়া আমরা শুনিয়াছি জ্ঞানবৃদ্ধ দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত ফকিরের সহিত ধর্মালাপ করিয়া পরিতৃপ্ত হইয়াছেন। শিলাইদহে মহাকবি রবীন্দ্রনাথের সহিত প্রথম যেদিন ভাবের বিনিময় হয় তাহা জাহ্নবী-যমুনা মহামিলনের ন্যায় রসোচ্ছ্বাসের সঙ্গম রচনা করে।’

এই বইতেই এক জায়াগায় শ্রী বসন্ত কুমার পাল নিজেও লেখেন – ‘সর্বজনবরেণ্য কবি রবীন্দ্রনাথও বহুবার ফকিরকে কাছারী বাড়িতে লইয়া ভাবময় সঙ্গীতের আলোচনায় মুগ্ধ হইয়াছিলেন। আমার ধারণা গুণগ্রাহী ঠাকুর পরিবারই প্রথমে ফকিরের অত্যুচ্চ ভাবধারা উপলব্ধি করেন।’

অবশ্য এই ‘ভাবময় সঙ্গীতের আলোচনা’র কোনও প্রতক্ষ্যদর্শীর বিবরণ তিনি উল্লেখ করেননি।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘মনের মানুষ’ এ লেখক একটু কায়দা করেই লালন ফকির এবং রবীন্দ্রনাথের দেখা হওয়ার ব্যাপারটি খোলসা করেননি। কারণ তিনি উপন্যাসে দেখাচ্ছেন যেবার শিলাইদহে গিয়ে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে লালন ফকিরের দেখা হয়, সে বারে যদিও জ্যোতিদাদার সঙ্গে কিশোর রবি শিলাইদহতে এসেছিলেন, কিন্তু ঠিক যে সময়ে লালন ফকির জ্যোতিরিন্দ্রনাথের বজরায় এসেছেন, সে সময় রবি নদীর চড়ায় বালি হাঁস দেখতে চলে যান। লালন ফকির আসার পর জ্যোতি দাদা তাঁকে ডাকাডাকি করেও পাননি। এখানে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে লালন ফকিরের কথোপকথনের একটি দীর্ঘ বিবরণ আছে। সেখানে বলা হয়েছে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এক বন্ধুর কাছে লালন ফকিরের গানের সুখ্যাতি শুনেছিলেন। তাই শিলাইদহতে এসে লোক পাঠিয়ে তাঁকে নিজের বজরায় নিয়ে আসেন। প্রথমে লালন ভেবেছিলেন তাঁকে বুঝি শাস্তি দেওয়ার জন্যে ধরে আনা হয়েছে। তারা যে জমিদারের জমিতে এক জঙ্গলের মধ্যে আখড়া করেছে এ বোধহয় তারই শাস্তি। জমিদারের সঙ্গে কথা বলে সে ভুল ভাঙ্গে। জমিদারকে তিনি গান শোনান। তার গানের দর্শন নিয়ে আলোচনা হয়। তারপর লালন ফকির জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে অনুরোধ করেন তাদের আখড়ার জায়গাটিকে নিষ্কর করে দেওয়ার জন্যে। সঙ্গে সঙ্গে নায়েব শচীনবাবুকে নির্দেশ দেন এই গ্রামটিকে নিষ্কর হিসেবে পাট্টা করে দেওয়ার জন্য। এই গোটা ব্যাপারটা চলাকালীন কিন্তু কিশোর রবি, যে বালি হাঁস দেখতে গেছলো সে ফিরে আসেনি।

এই উপন্যাসের শেষে অবশ্য লেখক বলে দিয়েছেন এই উপন্যাসটি লালন ফকিরের তথ্যভিত্তিক ঐতিহাসিক জীবনকাহিনী হিসেবে একেবারেই গণ্য করা উচিত নয়। আবার তিনি এও বলেছেন এই উপন্যাসে রবীন্দ্রনাথ চরিত্র হিসেবে আসেননি কারণ ‘পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যে’ প্রমাণিত হয় যে দুজনের সাক্ষাৎ ঘটেনি।

তবে একটি তথ্য জেনে খুব আশ্চর্য লাগে যে, বসন্ত কুমার পাল মশায় ‘মহাত্না লালনফকির’ ১৯৩৯ সালে এই বইটি লেখার সময় রবীন্দ্রনাথকে একটি চিঠি দিয়ে জানতে চান যে, তাঁর সঙ্গে লালন সাঁইএর দেখা হয়েছিল কি না। এই চিঠির উত্তর আসে রবীন্দ্রনাথের একান্ত সচিব সুধীর চন্দ্র কর মশাইয়ের কাছ থেকে। তিনি এই চিঠিতে কি এক অজানা কারণে ব্যাপারটা স্পষ্ট করেননি। চিঠির উত্তরে কর মশাই লেখেন – ‘ফকির সাহেবকে তিনি জানতেন বটে, কিন্তু সে তো বহুদিন আগে; বুঝতেই পারেন এখন সে সব সুদূর স্মৃতির বিষয় তাঁর মনে তেমন উজ্জ্বল নয়।’

বসন্ত কুমার পাল নামটির সঙ্গে সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ পরিচিত ছিলেন। কারণ এর আগে প্রবাসীতে বসন্ত কুমার পাল মশাই যখন লালনের উপর একটি প্রবন্ধ লেখেন রবীন্দ্রনাথ সেই প্রবন্ধের প্রসংসা করেন। এ ব্যাপারে বসন্তকুমার পাল লেখেন, ‘এবার অন্য কোথাও নহে, সাহসে ভর করিয়া অশরণের শরণ প্রবাসী সম্পাদক মহাশয়ের দ্বারস্ত হইলাম; আমি বাণীতীর্থের নবীন যাত্রী, অজ্ঞাত অখ্যাত হইলেও ভাবগ্রাহী জনার্দনের অনুকম্পা লাভে সক্ষম হইলাম। বিগত ১৩৩২ সাল ও তাহার পরবর্তী সময়ে আমার প্রবন্ধ প্রবাসী পত্রিকায় প্রকাশিত হইল; শুধু তাহাই নহে ফকিরের তত্ত্বকথা প্রকাশ সম্মন্ধে সেই সময় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ যে উক্তি করেন, তাহাও যে আমার উদ্যমের উপরই প্রযোজ্য, ইহা তিনি পাঠক পাঠিকাদের জানাইয়া দেন।’

যে লেখকের লেখা একদা তিনি প্রশংসা করেছিলেন সেই লেখকের চিঠি নিজে উত্তর না দেওয়া রবীন্দ্রনাথের স্বভাবধর্মী নয়। তাই রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিতে বিষয়টি অনুজ্জ্বল হয়ে যাওয়াটা একটু অদ্ভুত লাগে।

বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি যে তাঁর শেষ দিন পর্যন্ত কি রকম সজাগ ছিল তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি। আর তা ছাড়া এই ঘটনার ১৪ বছর আগেও ভারতীয় দর্শন কংগ্রেসে রবীন্দ্রনাথ লালনের গানের ইংরেজী অনুবাদ করে পড়ে ছিলেন। অর্থাৎ তখন পর্যন্ত তিনি লালন ফকিরের রচনা নিয়ে আগ্রহী ছিলেন।

রবীন্দ্রনাথের আগে যখন শিলাইদহের জমিদারি তাঁর জ্যোতিদাদার সেই সময় জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে যে লালন সাঁইয়ের দেখা হয়েছিল, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের আঁকা একটি লালনের স্কেচ।

পরে কিছুটা এই স্কেচ থেকে কিছুটা কল্পনা থেকে নন্দলাল বসু একটি ছবি আঁকেন। আমরা সাধারণত এই ছবিটি বা আর অন্যদের হাতে এর কিছু কপি ছবি দেখে থাকি। এটি না থাকলে লালন ফকিরের চেহারা সম্বন্ধে আমাদের কোনও ধারনা থাকত না।

রবীন্দ্রনাথের লালন সম্মন্ধে প্রথম আগ্রহ জন্মায় শিলাইদহ অঞ্চলের বাউলদের কাছে লালনের গান শুনে। এর মধ্যে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’ গানটি তাঁর বিশেষ প্রিয় ছিল। ‘গোরা’ উপন্যাসে এই গানটি কোলকাতার রাস্তায় এক বাউলের কণ্ঠে শুনে বিনয়ের মনে যে ভাবনার উদয় হওয়ার কথা রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেছিলেন, সেটি হয়ত তাঁর নিজেরই কোনও সময়ের ভাবনা। এই গানের মর্মবাণীর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নিজের জীবন জিজ্ঞাসার কিছু মিল খুঁজে পেয়েছিলেন।

‘গোরা’র সেই অংশটিতে একবার চোখ বুলিয়ে নেওয়া যাক।

‘আজ সকালবেলায় কী করিবে তাহা ভাবিয়া না পাইয়া তাহার মনটা চঞ্চল হইয়া উঠিয়াছিল। পাশের বাড়ির ছাতের উপরে গোটা-তিনেক কাক কী লইয়া ডাকাডাকি করিতেছিল এবং চড়ুই-দম্পতি তাহার বারান্দার এক কোণে বাসা-নির্মাণ-ব্যাপারে পরস্পরকে কিচিমিচি শব্দে উৎসাহ দিতেছিল– সেই সমস্ত অব্যক্ত কাকলি বিনয়ের মনের মধ্যে একটা কোন্ অস্পষ্ট ভাবাবেগকে জাগাইয়া তুলিতেছিল।

আলখাল্লা-পরা একটা বাউল নিকটে দোকানের সামনে দাঁড়াইয়া গান গাহিতে লাগিল–

খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কমনে আসে যায়,
ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতেম পাখির পায়

বিনয়ের ইচ্ছা করিতে লাগিল বাউলকে ডাকিয়া এই অচিন পাখির গানটা লিখিয়া লয়, কিন্তু ভোর-রাত্রে যেমন শীত-শীত করে অথচ গায়ের কাপড়টা টানিয়া লইতে উদ্যম থাকে না, তেমনি একটা আলস্যের ভাবে বাউলকে ডাকা হইল না, গান লেখাও হইল না, কেবল ঐ অচেনা পাখির সুরটা মনের মধ্যে গুন্ গুন্ করিতে লাগিল।’

আবার জীবনস্মৃতির একটি প্রবন্ধে একই গানের উল্লেখ করেছিলেন-

‘ইহার অনেকদিন পরে একদিন বোলপুরের রাস্তা দিয়া কে গাহিয়া যাইতেছিল–

খাঁচার মাঝে অচিন পাখি কম্নে আসে যায়
ধরতে পারলে মনোবেড়ি দিতেম পাখির পায়।

দেখিলাম বাউলের গানও ঠিক ঐ একই কথা বলিতেছে। মাঝে মাঝে বদ্ধ খাঁচার মধ্যে আসিয়া অচিন পাখি বন্ধনহীন অচেনার কথা বলিয়া যায়– মন তাহাকে চিরন্তন করিয়া ধরিয়া রাখিতে চায় কিন্তু পারে না। এই অচিন পাখির নিঃশব্দ যাওয়া-আসার খবর গানের সুর ছাড়া আর কে দিতে পারে!’

দুজনে সাক্ষাৎ হোক বা না হোক, রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে থাকাকালীন বিভিন্ন সময়ে লোক পাঠিয়ে লালনের আখড়া থেকে কিছু গান সংগ্রহ করেন। ১৩২২ সনে প্রবাসী পত্রিকায় এই সংগৃহীত গান থেকে কুড়িটি গান প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথ লালনের আখড়া থেকে দুটি খাতা সংগ্রহ করে তাঁর এস্টেটের কর্মচারী বামাচরণ ভট্টাচার্যকে দিয়ে গানগুলি কপি করিয়েছিলেন।

এই দুটি খাতা নিয়ে লালন ফকিরের শিষ্যদের মধ্যে প্রচুর ভুল ধারনা এখনও আছে। এমন কি অনেকে এও মনে করেন রবীন্দ্রনাথ লালনের লেখা চুরি করে নিজের বলে চালিয়েছেন।

এই খাতার হাতের লেখা কার এ নিয়ে দু’ রকম মত আছে। কেউ বলেন এ লেখা বামাচরণ ভট্টাচার্য মশায়ের, আবার কেউ বলেন এ লেখা মনিরুদ্দিন শাহ ফকিরের। তবে ১৯৫৮ সালে ডক্টর শ্রী মতিলাল দাস এবং শ্রী পীযূষ কান্তি মহাপাত্রের সম্পাদনায় কলকাতা বিশ্ববদ্যালয় থেকে প্রথম ‘লালন-গীতিকা’ নামে লালনের গানের সঙ্কলন প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের ভুমিকায় সম্পাদক লেখেন – রবীন্দ্রসদনে যে দুটি মূল খাতা রক্ষিত আছে তাতে দেখা যায় লেখা বাংলায় হলেও তা লেখা হয়েছে উর্দু ভাষার মতো উল্টোদিক দিয়ে, মানে ডান থেকে বামে। খাতার শেষ পৃষ্ঠাই আসলে প্রথম পাতা।

এতে মনে করা যেতে পারে লেখাটি মনিরুদ্দিন শাহ ফকিরের হওয়া সম্ভব।

তবে এই পাঠ নিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিজে সম্ভবত সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই তিনি পরে আবার শান্তিদেব ঘোষের বাবা কালীমোহন ঘোষকে ছেঁউড়িয়াতে পাঠান।

সব মিলিয়ে বিশ্বভারতীর সংগ্রহে ২৯৮টি গান পাওয়া যায়। ডাঃ মতিলাল দাশ কুষ্টিয়া মহকুমার মুন্সেফ থাকাকালীন নিজস্ব আগ্রহে ৩৭১ টি গান সংগ্রহ করেন।

লালন গীতিকার গানগুলি মোটামুটি ভাবে এই ভাবে পর্যায়ভুক্ত করা যায় –

১ ) বাউল গান, ২ ) বৈষ্ণব ভাব সম্পন্ন গান। বৈষ্ণব ভাব সম্পন্ন গানগুলির মধ্যে রাধা কৃষ্ণ লীলা বিষয়ক কিছু আবার গৌরাঙ্গ লীলাবিষয়ক।

আর বাউল পর্যায়ের গানগুলির মধ্যে দুটি ভাগ। একটিতে সেই mystic জগতের কথা, সহজিয়া রূপকের মধ্যে দিয়ে জীবনের গূঢ় তত্ত্বের কথা বলা। এই জায়াগাটিই রবীন্দ্রনাথকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষিত করেছিল।

বাউল গানের আর এক ভাগে আছে কিছু বাউলদের সাধন পদ্ধতির কথা বলা আছে।

লালনের গান মূলত তত্ত্ববহুল। মূল বিষয় দেহতত্ত্ব এবং আত্নতত্ত্ব। গানের ভাব অনেক সময় অস্পষ্ট। গানের ভাব এক আলো আঁধারির mystic জগতের মধ্যে চলা ফেরা করে। তাঁর গানে আমাদের বাউল দর্শনের সঙ্গে কিছুটা সুফি দর্শনের মিশ্রণ আছে। অনেকে তাঁর সঙ্গে পারস্যের কবি রূমির রচনার মিল খুঁজে পান। লালন ফকির শুধু গান লিখেই ক্ষান্ত হতেন না। তিনি ঘোড়ায় চড়ে পূর্ব বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেড়াতেন। অনেকটা ধর্ম প্রচারকের মতন।

রবীন্দ্রনাথ তাই ছাত্রদের কাছে বলেছিলেন – ‘মফস্বলে ভ্রমণ করিতে করিতে দেখিতে পাই যে হয়ত পল্লীর নিভৃত ছায়ায় কোন ব্যাক্তি এক নতুন ধর্মসম্প্রদায় সংগঠন করিতেছেন। তাঁহার ভদ্র সম্প্রদায়ে বিশেষ পরিজ্ঞাত নহেন, কিন্তু সমাজের মধ্যে তাঁহারা কি বলিতে এসেছেন, কি বলেছেন এটা জানা উচিত, এইগুলি সংগ্রহ করিতে পারিলে ভারতবর্ষের মধ্যে যে সমস্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ধর্মমত প্রচলিত হইতেছে, অজ্ঞাতে ও অলক্ষিতে, যে সকল শক্তি সমাজের মধ্যে কাজ করিতেছে তাহা অনেকটা বুঝা যাইবে। আমি এইরূপ এক ধর্মপ্রচারকের বিষয় কিছু জানি – তাঁহার নাম লালন ফকির। লালন ফকির কুষ্টিয়ার এক হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। … এই লালন ফকিরের মতে মুসলমান জৈন মত সকল একত্র করিয়া এমন একটি জিনিষ তৈয়ার হইয়াছে যাহাতে চিন্তা করিবার অনেক বিষয় হইয়াছে। এ বিষয়ে সকলের মন দেওয়া উচিত।’

এখানে বোঝা যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথ লালন ফকিরকে একজন ধর্মসম্প্রদায়ের সংগঠক হিসেবে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর একটি গান ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’র উপন্যাসে এবং স্মৃতিকথায় উল্লেখের কথা আগে লেখা হয়েছে। কিন্তু লালনের কোনও গান থেকে সুর নেওয়ার কথা শোনা যায়নি। বরং শিলাইদহের পোস্টম্যান গগন হরকরার দুটি গানের সুরের আদল নিয়ে দুটি বিখ্যাত গান রচনা করেন।

‘হরিনাম দিয়ে জগৎ মাতালে আমার এগলা নিতাই’ থেকে ‘যদি তোর ডাক শুনে কেও আসে’ এবং ‘আমি কোথায় পাবো তারে আমার মনে মানুষ যে রে’ থেকে আমার ‘সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।

তবে লালন ফকিরের গানের ভাবের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিতা বা গানের কিছু মিল অনেকে খুঁজে পান। লালনের গানে যে অপৌত্তলিক গূঢ় আধাত্নিকতার রহস্যময় ভাব আছে তার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ হয়ত ব্রাহ্মদর্শনের কিছু মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। সেটাই এক সময় তাঁকে লালন সম্মন্ধে উৎসাহিত করে। তবু কেউ কেউ যে দুজনের রচনায় কোথাও কোথাও মিল খুঁজে পান, সেটা হয়ত নেহাত সমাপতন। উদাহরণ স্বরূপ উল্লেখ করা যেতে পারে একটি লালন ফকিরের রচনা –

‘ মিলন হবে কতদিনে।
আমার মনের মানুষের সনে।
ঐ রূপ যখন স্মরণ হয়
থাকে না লোক লজ্জার ভয়
লালন ফকির ভেবে বলে সদাই
ও প্রেম যে করে সেই জানে।’

এর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের যে রচনার মিল আছে বলে কেউ কেউ মনে করেন, সেটা হলো –

‘আমার মিলন লাগি তুমি
আসছ কবে থেকে।
তোমার চন্দ্র সূর্য তোমায়
রাখবে কোথায় ঢেকে।
কত কালের সকাল-সাঁঝে
তোমার চরণধ্বনি বাজে,
গোপনে দূত হৃদয়-মাঝে
গেছে আমায় ডেকে।’

পঞ্চান্ন বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ ‘বাউল গান’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে এ দেশে হিন্দু-মুসলমানের বিরুদ্ধ ধারাকে যাঁরা মেলাবার চেষ্টা করে যথার্থ মানসতীর্থ হয়ে উঠেছেন, তেমন কয়েকটি নামের উল্লেখ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। সে নাম গুলি হলো রামানন্দ, কবীর, দাদু, রবীদাস এবং নানক। এখানে তিনি লালনের নাম উল্লেখ করেননি। একটু বেশি বয়সে রবীন্দ্রনাথ সম্ভবত এই বাংলার বাউল-ফকিরদের জীবনযাপনের ধরণ এবং তাদের কিছু মতবাদ নিয়ে নিরুৎসাহিত হয় পড়েন। তিনি এক জায়াগায় উল্লেখ করেছেন ‘বাউলের সুর ও বাণী কোনও এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে’। আমরা জানি, এ রকম অনেক কিছুই তাঁর মনে এসে মিশেছে কোনও এক সময়ে। কিন্তু সে সবের প্রভাব চিরস্থায়ী হয়নি। তাঁর যাত্রাপথের আনন্দগানের ভাব বদলে বদলে গেছে।

শিলাইদহের কুঠিবাড়ির অভিজাত মানুষজনদের তাঁদের জমিদারী এলাকার এক গ্রাম ছেউরিয়ার প্রজারা দূর থেকে একটু সম্ভ্রমের চোখেই দেখতেন। হুজুর বা মহারাজ বলে সম্বোধন করতেন। ঠাকুর বাড়ির শুধু জ্যোতিরিন্দ্রনাথই নয়, হয়ত সত্যেন্দ্রনাথ, জ্ঞানদানন্দিনী দেবী, সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গেও লালন ফকিরের সাক্ষাত হয়ে থাকবে । রবীন্দ্রনাথের ভাগনী সরলাদেবী ভারতী পত্রিকায় ‘লালন ও গগন’ বলে একটি প্রবন্ধ লেখেন। ভাইঝি ইন্দিরাদেবী বীণা-বাদিণী পত্রিকায় লালনের দুটি গানের স্বরলিপি প্রকাশ করেছিলেন। এতে বোঝা যায় কুঠিবাড়ির ঠাকুরদের জমিদারীর এক বিশেষ প্রজাকে নিয়ে সে বাড়িতে যথেষ্ট আগ্রহ ছিল।

তবুও এই দুই ব্যাক্তিত্বের মাঝে যে ‘কত শত কত মতো’ আবরণ ছিল সেটাও বোঝা যায়। সেটা চেষ্টিত, নাকি স্বাভাবিক – তা বলা মুসকিল।

ভেবে নেওয়া যেতে পারে রবীন্দ্রনাথ এবং লালন ফকির কোনও এক সময়ে ভৌগলিক ভাবে খুব কাছাকাছি এসেও তাঁরা সেই আরশিনগরের পড়শি হয়ে রয়ে গেছিলেন।

‘বাড়ির কাছে আরশি নগর সেথা এক পড়শি বাস করে।
আমি একদিন না দেখিলাম তারে।।
গিরাম বেড়ে অগাধ পানি
ও তার নাই কিনারা নাই তরণী পারে
মনে বাঞ্ছা করি দেখবো তারে
কেমনে সে গাঁইয়ে যাইরে।।’

তথ্য ঋণ –

মহাত্না লালনফকির – বসন্ত কুমার পাল
লালন সমগ্র – মোবারক হোসেন খান
মনের মানুষ – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
লালন সাঁই কুবির গোঁসাই – সুধীর চক্রবর্তী।। (সৌমেন দে।।)

সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ:

রেটিং করুনঃ ,

Comments are closed

বিভাগসমূহ

Featured Posts

বিভাগ সমুহ