করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে সরকার বিধিনিষেধ আরোপ করায় সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন স্থানীয় বাজারের পণ্য উৎপাদকেরা। দোকানপাট সব বন্ধ করে দেওয়ায় রড, সিমেন্ট, বস্ত্র, আসবাবপত্র, পাদুকাসহ নানা ধরনের পণ্যের বাজার অনেকটা স্থবির হয়ে গেছে। এসব পণ্যের বাজারে স্থানীয় উৎপাদকদেরই একচেটিয়া আধিপত্য।
কঠোর বিধিনিষেধের মধ্যে সরকার কারখানা চালু রাখার সুযোগ দিলেও তা কাজে আসবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ আছে ব্যবসায়ীদের। তাঁরা জানান, যাঁরা পণ্য বিক্রি করবেন, তাঁদের দোকানপাট বন্ধ। তাই কারখানায় উৎপাদন করলেও তা বাজারে পৌঁছানো যাবে না, বিক্রিও হবে না। সে জন্য অনেকেই আগামী দু-এক দিন অপেক্ষা করে কারখানা বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তা করছেন।
রড-সিমেন্টের মতো নির্মাণসামগ্রীতেও দেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। এটি দেশের অন্যতম ভারী শিল্প খাতও। রড-সিমেন্টের প্রায় পুরো চাহিদাই পূরণ করেন স্থানীয় উৎপাদকেরা। বর্তমানে দেশে ৩৫টির মতো দেশি–বিদেশি সিমেন্ট কারখানা উৎপাদনে আছে। স্থানীয় বাজারের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি তারা সিমেন্ট রপ্তানিও করছে। এই শিল্পের সঙ্গে লক্ষাধিক শ্রমিক–কর্মচারী জড়িত। দেশে বছরে সিমেন্টের চাহিদা প্রায় চার কোটি টন, যার পুরোটাই স্থানীয় কারখানাগুলো সরবরাহ করে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও ক্রাউন সিমেন্ট গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান মো. আলমগীর কবির বলেন, ‘সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাদের প্রধান কার্যালয় বন্ধ থাকবে, তবে কারখানা চালু থাকবে। কারখানা চালু থাকলেও সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিপর্যায়ের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হলে আমাদের পণ্য মজুত করতে হবে। মজুত রাখার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ফুরিয়ে গেলে কারখানা বন্ধ করতে বাধ্য হব। আগামী দু–তিন দিন পণ্য পরিবহন ও সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হলে কারখানা বন্ধ করা হবে।’
নির্মাণ খাতের আরেক অপরিহার্য সামগ্রী রড। এই রডের বাজারও সংকটে পড়বে। উৎপাদকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, চাহিদা কমে যাওয়ার আশঙ্কায় বহু প্রতিষ্ঠান দুই শিফটের পরিবর্তে এক শিফট চালুর পরিকল্পনা করছে। পরিবেশক বা খুচরা পর্যায়ে দোকানপাট এক সপ্তাহের বেশি বন্ধ থাকলে কারখানাও বন্ধ রাখার বিকল্প নেই।
বর্তমানে দেশের প্রায় ২০০ প্রতিষ্ঠান বছরে ৬০ লাখ টনের মতো রড উৎপাদন করে। তারা স্থানীয় চাহিদার পুরোটাই পূরণ করে। আবার রপ্তানিও হয়।
বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা এ কে মাসাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সবকিছু বন্ধ থাকলে একদিকে রডের কাঁচামালের সংকট হবে, অন্যদিকে বাজারে চাহিদা কমে যাবে, বিক্রিও কমবে। খরচ কমাতে প্রথম কয়েক দিন কারখানা এক শিফটে চালাব, পরে পরিস্থিতি বুঝে সিদ্ধান্ত নেব।’
স্থানীয় বাজারে প্রায় শতভাগ কাপড়ের চাহিদা মেটায় দেশের বস্ত্রকলগুলো। সারা দেশে এখন ছোট-বড় তিন হাজার বস্ত্রকল আছে। এই খাতে কাজ করেন কয়েক লাখ শ্রমিক। সরকারঘোষিত বিধিনিষেধে দেশি বস্ত্রকলগুলো ভোগান্তিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ঈদের আগে এই সময়েই কাপড়ের সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকে। শুধু নরসিংদীসহ সারা দেশের বস্ত্রকলগুলো থেকে কাপড় প্রথমে নরসিংদীর বাবুরহাট, নারায়ণগঞ্জের গাউসিয়া, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন পাইকারি বাজারে যায়। সেখান থেকে সারা দেশে খুচরা পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের হাতে পৌঁছায়। দেশে মাথাপিছু কাপড়ের চাহিদা ২৫ মিটার। এর প্রায় পুরোটাই সরবরাহ করে এসব কারখানা।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সহসভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, ঈদের আগের এই সময়ে পাইকারি বাজারগুলো জমজমাট থাকে। কারখানাগুলো দিনরাত চলে, কিন্তু করোনার কারণে সবকিছু বন্ধ করে দেওয়ায় হয়তো আগামী দু-তিন দিন কারখানা চালানো যাবে। এরপরে বিক্রি করব কোথায়? তখন বাধ্য হয়েই কারখানা বন্ধ করতে হবে।’ তিনি মনে করেন, দোকানপাট সীমিত পরিসরে খোলা রাখা হলেও বস্ত্রকলের মালিকেরা পার পেয়ে যাবেন।
আসবাবপত্রের বাজারও স্থানীয় উদ্যোক্তাদের দখলে। আগে পাড়া-মহল্লায় দোকান থেকেই আসবাবপত্র বানানো হতো। নব্বইয়ের দশকে ব্র্যান্ড ফার্নিচারের যাত্রা শুরু হয়। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে তারা এখন রপ্তানিও করে। করোনা পরিস্থিতিতে এসব কারখানা বিপাকে পড়েছে।
খড়কুটো নামের একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী জাহিদ আকতার জানান, তাঁরা আসবাবপত্র তৈরি করে রাজধানীর পান্থপথের কয়েকটি শোরুমে সরবরাহ করেন। কারখানার ৩৫ জন মিস্ত্রি ও কর্মীর মধ্যে কয়েকজন বাড়ি চলে গেছেন। অর্ধেক লোকবল দিয়ে কারখানা চালু রাখা হয়েছে। কিন্তু সব আসবাবপত্রের শোরুম ও দোকান বন্ধ থাকায় তাঁরা বিপাকে পড়েছেন।
জাহিদ আকতার আরও বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে নতুন কোনো অর্ডার পাচ্ছি না। পুরোনো অর্ডারের আসবাবপত্র বানানো হচ্ছে। আগামী তিন-দিনের মধ্যে ওই সব আসবাবপত্র বানানো শেষ হবে। তখন কারখানা বন্ধ করে দেওয়া ছাড়া আমার আর কোনো বিকল্প নেই।’
একইভাবে পুরান ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ভৈরব, মাগুরাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার পাদুকাপল্লিগুলো সমস্যায় পড়েছে। তারা সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষের চপ্পল ও জুতা তৈরি করে। ছোট এই শিল্প খাতে লাখ লাখ মানুষের জীবিকা নির্ভর করে। এই খাতের ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদের আগে নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য তৈরি জুতার রমরমা ব্যবসা থাকে। লকডাউনের কারণে তা হচ্ছে না।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: এপ্রিল ১৪, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,