গত বছর মার্চের মাঝামাঝি নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী এরনা সোলবার্গ শুধু শিশুদের উপস্থিতিতে একটি প্রেস কনফারেন্স করেন। তাঁর সঙ্গে দুজন মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। তিনি কোভিড-১৯ নিয়ে শিশুদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সারা দেশ থেকে শিশুদের প্রশ্ন সংগ্রহ করা হয়েছিল।
‘আমি কি জন্মদিনের অনুষ্ঠান করতে পারব?’
‘ভ্যাকসিন পেতে কত দিন লাগবে?’
‘আমি কীভাবে সহায়তা করতে পারি?’
এ ধরনের অনেক প্রশ্ন ছিল। প্রধানমন্ত্রী তথ্য-প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে উত্তর দেন। তিনি এ–ও বলেন যে যখন এত কিছু একসঙ্গে ঘটছে, তখন উদ্বিগ্ন হওয়া স্বাভাবিক।
কোভিড-১৯ নিয়ে শুধু শিশুদের জন্য প্রেস কনফারেন্স করে নরওয়ের প্রধানমন্ত্রী সবাইকে মনে করিয়ে দিলেন যে কোনো দুর্যোগে শিশুদের উদ্বেগ বড়দের থেকে আলাদা। তাদের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে সততা ও আন্তরিকতার সঙ্গে উত্তর দিয়ে তাদের আশ্বস্ত করা সব স্তরের বড়দের দায়িত্ব। আমরা বেশির ভাগ সময়ে নিজেদের নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকি। এই মহামারিতে শিশুরা কেমন আছে, তা জানার চেষ্টা করছি কি? তাদের প্রতি কি মনোযোগ দিচ্ছি?
আলফ্রেড হিচককের বার্ডস চলচ্চিত্রের এক দৃশ্যে দেখা যায়, একটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা অসংখ্য পাখির দ্বারা আক্রান্ত। এক প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় রেস্তোরাঁয় এসে ফোনে খবরটা জানানোর পর উপস্থিত সবার মধ্যে এ নিয়ে আলোচনা শুরু হয়ে যায়। আরও কোথায় এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে, পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক চলতে থাকে। সেখানে এক মা দুই সন্তান নিয়ে খাবার খাচ্ছিলেন। তিনি রেস্তোরাঁর কর্মীকে বলেন সবাইকে একটু আস্তে কথা বলতে, কারণ শিশুরা ভয় পাচ্ছিল। কোনো সংকটে শিশুদের সঙ্গে বড়দের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, সেই বিষয়টি নিয়ে আমরা কি সচেতন?
পৃথিবীতে প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের সংখ্যা অনেক। খবর পরিবেশিত হয় বড়দের কথা চিন্তা করে, শিশুদের জন্য নয়। যেকোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে মা-বাবাসহ সংশ্লিষ্ট বড়দের দায়িত্ব হলো শিশুদের কাছে তাদের উপযোগী করে কী ঘটেছে ব্যাখ্যা করা। এ জন্য আমাদের দক্ষতা থাকা দরকার। কীভাবে সন্তানদের বড় করতে হবে এবং তাদের সঙ্গে কেমন আচরণ তাদের বিকাশে সহায়ক, তা শেখার বিষয়।
গত ৩০ বছরের কার্যকর প্যারেন্টিংসংক্রান্ত গবেষণা থেকে জানা যায় যে মা–বাবাকে সন্তানের বয়স উপযোগী ভালোবাসা ও নির্দেশনা দিতে হবে। বিভিন্ন বয়সে শিশুদের অনুভূতি ও চিন্তাভাবনা বোঝা প্রয়োজন। যেমন চার–পাঁচ বছর বয়সী শিশুরা চঞ্চল হতে পারে। কারণ, তাদের মস্তিষ্ক অনেক বেশি সক্রিয় থাকে। সব বিষয়েই তারা আগ্রহী এবং স্বাধীনচেতা স্বভাবের হয়। তারা বিভিন্ন বিষয়ে শিখছে এবং এমন কিছুর প্রতি গুরুত্ব দেয়, যা হয়তো আমাদের কাছে একেবারেই মামুলি মনে হয়। যেমন পোশাকের রং, তাড়াহুড়োর সময় ছবি আঁকা বা অন্য কিছুতে ব্যস্ত থাকা, খাবারের সময় খেলাধুলা করা ইত্যাদি। এই বিষয় না বুঝলে মা-বাবা সন্তানদের বকাঝকা করতে পারেন। কিন্তু তারা যদি শিশুদের বেড়ে ওঠার পর্যায়গুলো নিয়ে জানেন, তাহলে বুঝতে পারবেন যে দুষ্টুমি করে শিশুটি কাউকে বিরক্ত করার চেষ্টা করছে না। সে তার কৌতূহলের বিষয়গুলো নিয়ে পরীক্ষা করছে এবং এটিই তার শেখার জন্য স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তখন মা-বাবা তার নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে কিংবা উত্তর খুঁজতে সাহায্য করতে পারেন। এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, যখন বড়রা শিশুদের ভাবনাচিন্তা এবং অনুভূতি সম্পর্কে সংবেদনশীল হলে তাদের জীবনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারবেন। এ জন্য শিশুদের সময় দিতে হবে। সেই সময় কি আমাদের আছে? অঞ্জন দত্তের গান যেন সে প্রশ্নই করছে ‘জামার মাপটা তার জানেন ভালোই, মনের খবর কি রাখেন?’
কোভিড-১৯ স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষায় ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। অনেক দিন ধরে স্কুল বন্ধ থাকার কারণে শিশুরা তাদের শৈশব হারিয়েছে। পরিচিত জীবন ও বন্ধুদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের মানসিক চাপ বাড়ছে। কঠিন পরিস্থিতিতে অনেক শিশুই দ্রুত মানিয়ে নেয়। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে রাগ, উদ্বেগ, দুঃখ ও ভয় বাড়তে থাকে। বর্তমান মহামারি এবং বিভিন্ন দুর্যোগে এ বিষয়গুলো মনে রাখা প্রয়োজন:
—মা-বাবা শিশুদের করোনাভাইরাসের লক্ষণ, কীভাবে এই ভাইরাস ছড়ায়, কীভাবে নিজেকে এবং অন্যদের রক্ষা করা যাবে—সে–সংক্রান্ত তথ্য দিতে পারেন। পাশাপাশি তাকে এটাও জানাতে হবে যে পুরো বিশ্ব কীভাবে এই মহামারি মোকাবিলায় কাজ করছে। শিশুদের কাছ থেকে যেকোনো প্রশ্নের জন্য তৈরি থাকা প্রয়োজন। সততার সঙ্গে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হবে, কিন্তু তা যেন শিশুর বয়স উপযোগী হয়। শিশুকে মিথ্যা বলা যাবে না, তবে সব সময় সবকিছু বলারও প্রয়োজন নেই। কোনো সন্ত্রাসী হামলায় যদি কিছু মানুষ নিহত হয়, তাহলে তার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া শিশুদের জন্য ক্ষতিকর।
—শিশুদের প্রতিক্রিয়ার দিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে অনুভূতি নিয়ে বেশি প্রশ্ন করা উচিত নয়। তবে তাকে আস্থাপূর্ণ একটা পরিবেশ দেওয়া প্রয়োজন, যাতে সে বুঝতে পারে যে বলতে চাইলে তার কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনা হবে।
—শিশুরা বড়দের দেখেই শেখে। শিশুর সামনে মা-বাবার অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা প্রকাশ করা উচিত নয়। তাদের সামনে মহামারির খবর বারবার দেখা এবং এ নিয়ে আলোচনা করার দরকার নেই। কারণ, এতে তাদের অহেতুক উদ্বেগ বাড়বে। খবর পরিমিত পরিমাণে এবং বিশ্বস্ত সূত্র থেকে পাওয়ার গুরুত্ব শিশুদের শেখানোর একটা সুযোগ এসেছে এই মহামারির সময়।
—কোনো কোনো শিশু সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। কিছু উপসর্গ দেখা যায়, যার মাঝে আছে অমনোযোগিতা, ঘুমের অসুবিধা, আচরণগত পরিবর্তন, দুঃস্বপ্ন, একা ঘুমাতে ভয় পাওয়া, নিজ বয়সের তুলনায় ছোট শিশুদের মতো আচরণ ইত্যাদি। যদি এই সমস্যা শিশুর প্রতিদিনের জীবনযাপনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
লেখক: লায়লা খন্দকার উন্নয়নকর্মী।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: এপ্রিল ১৩, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,