রিডার্স ডাইজেস্ট মাঝেমধ্যেই সেরা কৌতুক নির্বাচন করে থাকে। এবারও করেছে। তাদের কৌতুকের তালিকায় এই মুহূর্তে এক নম্বরে আছে:
দুই বন্ধু শিকারে গেছে জঙ্গলে। এর মধ্যে একজন হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেছে। তার মুখ থেকে ফেনা বের হচ্ছে। সুস্থ বন্ধু তাড়াতাড়ি ফোন করল ৯১১-এ। হ্যালো, আমার বন্ধু বোধ হয় মারা গেছে।
আপনি আগে শিয়োর হন যে সে মারা গেছে।
তখন লোকটা তার রিভলবার বের করল। বন্ধুকে গুলি করল। তারপর ফোনে বলল, এবার আমি শিয়োর যে সে মারা গেছে।
এই কৌতুকের মধ্যে রসিকতার কী হলো, আমি বুঝতে পারি না। এই রকম একটা নিষ্ঠুর কৌতুক! একটা লোক অবলীলায় আরেকজনকে মেরে ফেলল!
আমি কৌতুকটা আমার অফিসের সহকর্মীদের কাছে বললাম। বলো তো, এতে হাসার কী আছে?
কৌতুক বলা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে সবার হাসির শব্দ শুনতে পেলাম। সবাই বলছ, দারুণ হাসির তো! আমি বলি, কোনো কারণ ছাড়াই এক লোক আরেক লোককে মেরে ফেলল, আর তোমরা হাসছ।
রিডার্স ডাইজেস্টের ২ নম্বর কৌতুকটা আমি তখন তাদের বললাম। বলো তো, এই কৌতুকটাতে হাসির উপাদান কই!
একটা কচ্ছপের সঙ্গে এক শামুকের ধাক্কা লাগল। শামুক মারা গেল। পুলিশ ডাকা হলো। পুলিশ বলল, কীভাবে ঘটল ঘটনাটা?
কচ্ছপ বলল, আমি বলতে পারব না। ঘটনা এত দ্রুত ঘটল যে কিছুই বুঝলাম না।
এই কৌতুক শুনেও আমার সহকর্মীরা হা হা করে হেসে উঠল।
শুধু রনি হাসল না। আমি বললাম, রনি, হাসলে না যে?
আমি পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছি, বস।
রিডার্স ডাইজেস্টের মতে আরেকটা সেরা কৌতুক।
এক নারী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন হার্টের অপারেশনের জন্য। এই সময় যমদূত তাঁর পাশে এসে দাঁড়াল। ভদ্রমহিলা বললেন, আমি কি আজই মারা যাচ্ছি? যমদূত বলল, না। আরও ৩০ বছর পর।
ভদ্রমহিলা ভাবলেন, যদি ৩০ বছর বাঁচিই, ভালোভাবে বাঁচি। তিনি দাঁত বাঁধালেন। চুল ইমপ্ল্যান্ট করলেন। বাড়তি মেদও অপারেশন করে ঝেড়ে ফেললেন। নতুন হালফ্যাশনের পোশাক আনালেন। তারপর তিনি রাস্তা পার হয়ে তাঁর গাড়িতে উঠতে যাবেন, দ্রুত ছুটে আসা একটা গাড়ির নিচে পড়ে মারা গেলেন। মৃত্যুর পর তাঁর সঙ্গে দেখা হলো যমদূতের। তিনি বললেন, আপনি না বললেন ৩০ বছর আয়ু আছে। তাহলে আমি মারা গেলাম কেন?
আর বলবেন না। আমি আপনাকে চিনতে পারি নাই।
রিডার্স ডাইজেস্টের কৌতুক শেষ।
তাহলে এই গল্পটা বলে শেষ করতে হয়।
এই গল্পটা পুরোনো, তবে সমারসেট মম ১৯৩৩ সালে নিজের ভাষায় আবার বলেছিলেন।
গল্পের নাম: দেখা হওয়ার কথা সামারায়।
একজন ব্যবসায়ী ছিলেন বাগদাদে। তিনি তাঁর কাজের লোককে পাঠালেন বাজারে, কিছু কেনাকাটা করার জন্য। কাজের লোকটি একটু পরে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এল। তাকে খুব ভয়ার্ত দেখাচ্ছে। সে বলল, হুজুর, আমি বাজারে গিয়ে একজনকে দেখলাম, তারপর কাছে গিয়ে দেখলাম, যাকে দেখেছি, সে হলো মৃত্যু। মৃত্যু আমার দিকে যেন কেমন করে তাকাল। আমি খুব ভয় পাচ্ছি। আপনি তাড়াতাড়ি আপনার ঘোড়া দিন। আমি এই শহর ছেড়ে চলে যাব। এই শহরে মৃত্যু এসেছে। আমি আমার নিয়তি এড়াতে চাই। আমি সামারায় চলে যাব। মৃত্যু আর আমাকে খুঁজে পাবে না।
কাজের লোকটা ঘোড়া ছুটিয়ে চলে গেল সামারায়। তখন ব্যবসায়ী নিজেই বাজারে গেলেন। মৃত্যুর সঙ্গে তঁার দেখা হলো। তিনি মৃত্যুকে বললেন, তুমি কেন আমার কাজের লোককে ভয় দেখিয়েছ।
মৃত্যু বলল, আমি তো তাকে ভয় দেখাইনি। আমি শুধু বিস্মিত হয়েছি। কারণ, আমার সঙ্গে তার আজ রাতে দেখা হওয়ার কথা সামারায়। তাহলে সে বাগদাদে কী করছে?
আপনারা কি লক্ষ করেছেন যে প্রতিটি কৌতুকেই মৃত্যুর ঘটনা আছে। মৃত্যু কি আমাদের জন্য খুব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে গেল। আমাদের দেশে যখন ২০২০ সালের ৮ মার্চ কোভিড রোগী পাওয়া গেল, আমরা কিন্তু খুবই ভয় পেতাম। তখন আমি লিখতাম, ভাই, করোনা রোগীকে ভয় পাবেন না, কারণ এটা ঘরে ঘরে হবে। আপনার-আমার সবারই হবে। লাল পতাকা তোলারও কোনো মানে নেই। এখন তো দেখা যাচ্ছে, ঘরে ঘরে কোভিড রোগী। আমাদের দৈনিক আক্রান্ত এবং মৃত্যুর হার প্রতিদিন আগের দিনের রেকর্ড ভঙ্গ করছে। তারপরও আমরা হাসছি, চলছি এবং আগামীকালের, আগামী মাসের, আগামী বছরের, আগামী দশকের পরিকল্পনা করছি। হয়তো এই কারণেই পৃথিবী টিকে আছে, মানুষ কাজ করে যেতে পারছে। মৃত্যুর মতো অনিবার্য তো আর কিছু নেই, তবু মানুষ মনে করে যে আমি মরব না, অনন্তকাল মরব না।
নির্মলেন্দু গুণের একটা কবিতা আছে: আমি জন্মের প্রয়োজনে ছোট হয়েছিলাম, এখন মৃত্যুর প্রয়োজনে বড় হচ্ছি।
মৃত্যুকে ভুলে থেকে জীবনকে বড় করে দেখা ভালো। তবে বোকার মতো মৃত্যুকে ডেকে না এনে বুদ্ধিমানের মতো স্বাস্থ্যকে ধারণ করা ভালো। করোনার মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলা কোনো রকমেই বুদ্ধিমানের কাজ না।
সব সময় আমাদের বুদ্ধি কাজও করে না। আমরা যেমন বইমেলা খোলা রাখলাম, আর বললাম, লকডাউন, সবাই যঁার যঁার ঘরে থাকুন, ডাক্তারের কাছে যাওয়া ছাড়া আর কোনো প্রয়োজনে বের হওয়া যাবে না।
মৃত্যু ছাড়া একটা কৌতুক বলে শেষ করি। এক সরদারজি চোর ধরেছেন। চোরের পা বেঁধে তাকে বাড়িতে রেখে তিনি থানায় এসেছেন। পুলিশ বলল, আপনি শুধু পা বেঁধেছেন, হাত বাঁধেননি?
না।
সে তো হাত দিয়ে পায়ের বাঁধন খুলে পালাবে।
অনেক ভেবে সরদারজি বললেন, পালাবে না। কারণ, সেও সরদার। তার ওই বুদ্ধি হবে না।
লকডাউন দিয়ে আমরা বইমেলা খোলা রাখলাম কেন? আবার বইমেলা খোলা রেখে লকডাউন দিলাম কেন? এইটা বুঝতে সরদারজিকে ডাকতে হবে।
লেখক: আনিসুল হক প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: এপ্রিল ০৯, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,