অঙ্কের সঙ্গে আমার প্রেম (প্রেম-দিবস স্পেশাল)
________________________________________
১। অঙ্কের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় রাম আর শ্যামের মাধ্যমে। দুজনেই গোপালের চেয়েও বেশি সুবোধ বালক। রাম চারটে লজেন্স নিয়ে খই ভাজছিল, শ্যাম এসে আরও পাঁচটা লজেন্স দিল তাকে। সব মিলিয়ে কটা হল? ৯টা। বন্ধুপ্রীতি দেখে আমার চোখে জলও এসে গেল। অঙ্কও মিলল।
২। একটু বড় হলাম। রাম-শ্যামও। এখন তারা আর অতো সহজ সরল নয়। সামান্য বালখিল্য দুষ্টুমি এসে জুটেছে। মার্বেল চুরি করা, তিনের পাঁচ অংশ পরোটা খেয়ে বাকিটা ফেলে দেওয়া, মাটির ঘড়াকে ১৯ টুকরো করে ভেঙে তার যে সাতের উনিশ অংশ আয়তক্ষেত্রে ভেঙেছে, সে দিয়ে ঘর কেটে কিতকিত খেলতে গিয়ে প্রতি তিন ঘর অন্তর এক ঘর করে পিছিয়ে আসা.. ইত্যাদি। প’ড়ে খুব কষ্ট পেতাম। দুটো সুবোধ বালক কেমন মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে গেল। অবসাদে আমারও অঙ্ক ভুল হতে শুরু করলো।
৩। ইতিমধ্যে কিছু শ্রমিক এসে ভিড় করেছে। ১৯ জনে হেসে খেলে কাজটা ২৫ দিনে করে দিতেই পারত, কিন্তু করবে কেন! করলে তো আমি পরীক্ষায় পাশ করে যাব। কাজেই, ১০ দিনের মাথায় তাদের ৮ জন হাওয়া খেতে চলে গেল। এবার তাহলে বলো তো বাবু, বাকি ১১ জন বাকি কাজটা কদিনে করবে? – আরে তার আমি কি জানি রে ভাই! এর পিছনে প্রোমোটার থাকলে কাজটা আর শেষ নাও হতে পারে! তাতে আমার কি দোষ?
৪। আরেকটু বয়স বাড়ল। একদম ঘেন্না ধরে গেল মানুষের ওপর। ক্লাস নাইন নাগাদ বুঝলাম, ওই রাম-শ্যাম হলো দুটো আস্ত পিশাচ। পাশের বাড়ির চৌবাচ্চা ফুটো করা তো ছেড়েই দিলাম, একে অন্যের বাঁশে তেল মাখাতেও ছাড়ে না এরা!
৫। আর এই এক হয়েছে, প্রত্যেক পুজোর ছুটির আগে হাফ-ইয়ারলি পরীক্ষায় একটা ট্রেন কাশ্মীর আর আরেকটা ট্রেন কন্যাকুমারী থেকে ছেড়ে ঘণ্টায় ৮১.৩৯৭১ কিমি বেগে একে অপরকে ইন্দোরে পেরিয়ে গেল, আর আমি মুখে পেন গুঁজে বসে রইলাম, কারণ আমাদের বেড়াতে যাওয়ার টিকিট তখনও RAC!
৬। এর সঙ্গে এসে জুড়েছিল থিওরেম, বাংলায় যাকে বলে উপপাদ্য, এবং যার প্রতিপাদ্য বিষয় আমার আজও অধরা। কি, না একটা ত্রিভুজ, যার বাস্তবে কোনও অস্তিত্বই নেই, তার যদি দুটো বাহু সমান হয়, সেটা আমার কোন কাজে লাগবে শুনি! থিওরেমের সঙ্গে একটা লেজুড় থাকতো, ‘এক্সট্রা’ বলে। আমি বরাবরই সেটাকে এক্সট্রা হিসেবেই ধরতাম। একবারও হাত দিইনি ওতে। এক্সট্রা তো।
৭। এবার এল ক্যালকুলাস। এতদিন অব্দি টিনটিনের সঙ্গী, আমার প্রিয়। এবার অঙ্ক বই সামনে ধ’রে, সোজা করে ধ’রে, উল্টো করে ধ’রে, আয়নার সামনে ধ’রে, প্রতি মঙ্গলবার নিরামিষ খেয়ে – কোনওভাবেই ওই উৎকট চিহ্নগুলোকে ধরতে পারলাম না। ইন্টিগ্রেশনের চিহ্নকে (∫) আমি বরাবরই এফ (f) পড়তাম [আমার ভাষাপ্রেমটা একবার ভেবে দেখুন]।
৮। আর তেমনই লাগতো অঙ্ক স্যরদের। ঠাণ্ডা চাহনি। চোয়াল শক্ত। টেবিল থেকে চকটা তুলতেন, যেন চাকু। তারপর বোর্ডের দিকে ফিরে একের পর এক অঙ্ক, খাতায় টুকে নেবার আগেই ধুলো উড়িয়ে বোর্ড মুছে চলে যাচ্ছেন পরের অঙ্কে। অঙ্ক শেষ করে তলায় চক দিয়ে একটা দাগ টেনে দিচ্ছেন, আমার গলা দিয়ে চাকুটা যেন স্যাট্ করে চলে যাচ্ছে।
৯। বুক ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসতাম। আমার টিমে শচীন-সৌরভের সঙ্গে ১০-১১ নম্বরে দুজন বিশ্বের-ত্রাস বোলার হিসেবে রাখতাম কে সি নাগ আর এস এন দে-কে। ম্যাকগ্রা-আক্রম-ওয়ালশ খেলা যায়। এদের দুজনকে খেলবে, কার সাধ্যি!
১০। এত সব দুর্বিষহ স্মৃতি, তাও অঙ্ককে মনে রেখেছি। কেন? কারণ, পরীক্ষাহলে অঙ্ক টোকার স্মৃতিতে আমার বন্ধুরাও জড়িয়ে আছে। সময় ক’মে আসছে, স্টেপ জাম্প করে শুধু উত্তরটা বল্। আমি কে সি নাগের ফাদার, প্রশ্ন পড়ে জাস্ট উত্তরটা লিখি। বাকিটা মাথায় থাকে।
আরও মনে রেখেছি কেন?
কারণ, বড় হয়ে সাহিত্য পড়েছি।
সাহিত্য বলেছে, দুঃখ ভোলার নয়।
তাই, আমার অঙ্ক প্রেমের দুঃখ আজও ভুলিনি।
সূত্র: সংগৃহীত।
ছবি: নেট থেকে
তারিখ: ফেব্রুয়ারী ১৪, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,