এক বিদ্রোহী মুঘল শাহজাদা ও বাংলায় আগমনের ইতিহাস।।
জাহাঙ্গীরের চার পুত্রের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে উজ্জ্বল। রণকুশলী, তীক্ষ্ণবুদ্ধি এবং প্রশাসনিক দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। যদিও পিতার তৃতীয় পুত্র ছিলেন তিনি কিন্তু তারপরেও জাহাঙ্গীর তাকেই সিংহাসনে বসানোর স্বপ্ন দেখতেন।বড় দুই ভাই খসরু এবং পারভেজ নিহত হন তার ষড়যন্ত্রেই৷তার নাম হলো শাহজাদা খুররম।
পরবর্তীতে পুত্রস্নেহে পিতা জাহাঙ্গীর শাহজাদাকে উপাধি দিলেন শাহজাহান বা পৃথিবীর বাদশাহ।
মুঘল সম্রাজ্য এর আগে আমদরবারে কোন শাহজাদা সম্রাটের পাশে সিংহাসনে বসার সুযোগ পাননি। কিন্তু খুররম আমদরবারে সম্রাটের উপস্থিতিতে সিংহাসনের তার পাশে বসার অনুমতি পেয়েছিলেন এবং তাঁর বসার জন্য একটি আসন পাতা হয়েছিল। কোনো মুঘল শাহজাদা পিতার জীবদ্দশায় এহেন শাহি সম্মান এবং খেতাবের কথা কল্পনাও করতে পারেননি।
অথচ রাজসিংহাসন আর প্রাসাদরাজনীতির কী বিচিত্র গতি! পুত্রগর্বে যাঁকে অজস্র অনুগ্রহ বর্ষণ করেছিলেন, সেই পিতাই কদিন পর ক্রোধে, হতাশায় পুত্রের নামও উচ্চারণ করা থেকে বিরত হলেন। শাহজাহানের প্রসঙ্গ উঠলেই সম্রাট তাঁকে ‘বিদৌলত’ বা ভাগ্যহীন নামে সম্বোধন করেন।
দক্ষিণাত্যে সুবেদারি পাবার আগ পর্যন্ত সবকিছু ঠিক চলছিল।খসরু অন্ধ,পারভেজ মাতাল ও অসুস্থ,শাহরিয়ার না লায়েক।কিন্তু নূরজাহানের চক্রান্তে সম্রাট জাহাঙ্গীর খানিকটা শাহরিয়ারের দিকে ঝুঁকে পড়েন।অবশ্য এর পেছনে কারণও ছিল।নূরজাহান ক্রমাগত খুররমের নামে সম্রাটের কান ভারি করছিলেন।
শাহজাদা খুররম দক্ষিণাত্যে সুবাদার থাকাকালীন সময়ে বিদ্রোহ করেন এবং একসময় তাঁকে ভাগ্যহীন হয়ে কিছুদিন ঘুরে বেড়াতে হয়।সেসময় তিনি বাংলাতেও এসেছিলেন এবং হুগলিতে সপরিবারে আশ্রয় গ্রহন করেছিলেন।
জাহাঙ্গীর- তাঁর স্মৃতিকথা তুজুক-ই জাহাঙ্গীর-এ সম্রাট লিখেছেন, ‘এখন থেকে সকলে যেন তাকে “বি-দৌলত” বা ভাগ্যহীন বলে সম্বোধন করেন। এই বিবরণীতে যেখানেই বি-দৌলত কথাটি ব্যবহূত হবে তাতে তাকেই বুঝতে হবে।’
শাহজাহানের বিদ্রোহ পিতা জাহাঙ্গীরের কাছে শুধু অপ্রত্যাশিতই নয়, ছিল গভীর বেদনা ও হতাশাজনক। পুত্রের অবিমৃশ্যকারিতায় ক্ষুব্ধ জাহাঙ্গীর তুজুক-ই জাহাঙ্গীর-এ লিখেছেন, ‘কী পরিমাণ স্নেহানুরাগ তাকে ঢেলে দিয়েছিলাম, সে বিষয়ে সুষ্ঠু বর্ণনা দিতে আমার কলম শক্তিহীন হয়ে পড়েছে।’
বিমাতা নূরজাহানের চক্রান্তে সিংহাসনের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন সেই আংশকায় শাহজাহান বিদ্রোহ করেছিলেন। শাহি সৈন্যের সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধে পরাজিত হয়ে কোণঠাসা শাহজাদা উড়িষ্যায় আশ্রয় নিলেন। সহজেই উড়িষ্যা জয় করে এবার বাংলা জয়ের তোড়জোড়ে নেমে পড়লেন বিদ্রোহী যুবরাজ।
ড.বেণীপ্রসাদ এ প্রসঙ্গে বলেছেন,
“In a single empire there was no room for two such masterful spirits as Nur Jahan and Shah Jahan.”
তুজুক-ই জাহাঙ্গীর-এ সম্রাট দুঃখ করে লিখেছেন, ‘আমার নিজের দুঃখের কথা কী বলব—শরীরের ব্যথা-বেদনা ও দুর্বলতা সত্ত্বেও আমাকে অশ্বপৃষ্ঠে সেই অকৃতজ্ঞ ও কর্তব্যজ্ঞানহীন পুত্রের বিরুদ্ধে ধাবিত হতে হবে।’
বিদ্রোহী শাহজাদা অনেক ভেবেচিন্তেই বাংলা সুবাহ দখল করায় হাত দিয়েছিলেন। রণকুশলী শাহজাহানের এই সুবার ভূরাজনৈতিক সুবিধাগুলো চোখ এড়ায়নি। এর ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা, অজস্র নদীনালা ও বিশাল জলাভূমির কারণে একটি নিজস্ব নিরাপত্তা-বলয় গড়ে উঠেছে এই অঞ্চলে। এ ছাড়া এই প্রদেশের ভঙ্গুর রাজনৈতিক কাঠামো, দুর্বল শাসনব্যবস্থা, যোগাযোগের অভাব এবং কেন্দ্র থেকে বিশাল দূরত্ব যেকোনো বিচ্ছিন্নতাবাদীর জন্য বাড়তি সুবিধা এনে দেয়।
প্রয়োজন হলে বাংলার পরাজিত বারো ভুঁইয়া এবং জমিদারদের এই মোগলশাহির বিরুদ্ধে দলে টানা যাবে। মুসা খানের পুত্র মাসুম খান বশ্যতা স্বীকার করলেও যেকোনো সুযোগে মোগল-অধীনতা ছুড়ে ফেলতে যে আগ্রহী, তা শাহজাহান সহজেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। শাহি দরবারের শত্রু আরাকানের মগরাজার সঙ্গে মিত্রতা করে এগিয়ে আসা শাহি সৈন্যদের বিরুদ্ধে জোট তৈরি করার চিন্তাও তাঁর মাথায় ছিল।
কিন্তু খুররম খুব বেশিদিন বিদ্রোহী হয়ে বাংলায় অবস্থান করতে পারেননি।হুগলির পর্তুগিজ চার্চে অবস্থানকালীন সময়ে সেখানে অবস্থানরত পর্তুগিজদের মনে এই আশংকা জন্মায় যে একজন বিদ্রোহী রাজকুমারকে আশ্রয় দিলে হয়তো তারা সম্রাট জাহাঙ্গীরের কুনজরে পড়বেন এবং শেষপর্যন্ট তাদের উপমহাদেশ ছাড়তে হবে।তৎকালীন পর্তুগিজের গভর্নর মাইকেল রডড্রিগস শাহজাহানকে সাহায্যের প্রস্তাবে রাজি হননি।তাই তারা আর খুব বেশি ঝুঁকি না নিয়ে খুররমকে সেখান থেকে প্রস্থান করতে বলেন। পরবর্তীতে খুররম সম্রাট হবার পর কাসিম খাঁকে পর্তুগিজদের শায়েস্তা করতে নির্দেশ দেন।
তবে এ ব্যাপারটি শতভাগ সত্য বলে মনে হয় না কারণ
পর্তুগিজরা তাঁর সময় হুগলিতে বাণিজ্যিক কর্মকান্ডের নামে বিভিন্ন প্রকার অপকর্ম চালাতে থাকে যা মুগলদের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাদেরকে প্রদত্ত বিশেষ সুযোগ-সুবিধার যথেচ্ছ অপব্যবহার করে তারা স্থানীয় অধিবাসীদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার চালায়। অনেককে ধরে নিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করে। এমনকি তাদের ধর্মপ্রচারকগণও স্থানীয় জনগণকে বলপূর্বক ধর্মান্তরিত করতে শুরু করে। ফিরিঙ্গিরা আরাকান রাজার পক্ষে মুগলদের বিরুদ্ধে লড়াই করে। হুগলিতে দুর্গ নির্মাণ করে তারা নিজেদের বসতিকে সুরক্ষিত এবং বাংলার নদীগুলিতে, বিশেষ করে বঙ্গোপসাগরে অবাধে জলদস্যুতা শুরু করে। বিদ্রোহী যুবরাজ হিসেবে বাংলায় অবস্থানকালে এতদঞ্চলের পর্তুগিজ সমস্যা সম্পর্কে শাহজাহান অবগত ছিলেন। সম্রাটের নির্দেশক্রমে কাশিম খান ১৬৩২ খ্রিস্টাব্দে পর্তুগিজদের হুগলি থেকে বিতাড়িত করেন। কাসিম খান কামান দিয়ে পর্তুগীজদের চার্চ গুঁড়িয়ে দিয়েছিলেন।প্রথমে বিশাল বাহিনী পর্তুগিজ দুর্গ ঘিরে ফেলে। ভিতরে তখন আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত মাত্র ২০০ পর্তুগিজ সৈনিক। পর্তুগিজরা সেদিন জয়ী হয়নি নিজেদেরই একজনের বিশ্বাসঘাতকতায়।
১৬৩২-এর ২৪ জুন, সেন্ট জন দ্য ব্যাপটিস্ট-এর উৎসব।সেই দিন মুঘল সেনারা পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকে অস্ত্রভাণ্ডারের দখল নিয়ে বারুদখানায় আগুন লাগায়। গণনিধন হয় সাধারণ খ্রিস্টানদের। জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয় তৎকালীন পর্তুগিজ গভর্নরকে এবং নিহত হয় পাঁচ পাদ্রি। চার্চ সহ অন্যান্য ভবনগুলিও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। চার্চের সবচেয়ে প্রবীণ পাদ্রি ফাদার জোয়াও দ্য ক্রজ-সহ ৪০০০-এর বেশি পর্তুগিজ নরনারীকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় মুঘল রাজধানী আগ্রার দুর্গে।
এ সময় বহু সংখ্যক পর্তুগিজ প্রাণ হারায় এবং যারা বেঁচে ছিল তারা বন্দি হয়। পরে অবশ্য সম্রাট শাহজাহান গির্জা পুনর্গঠনের জন্য অর্থ প্রদান করেন। ১৬৩৩-এ ব্যান্ডেলের ৭৭৭ একর জমি নিষ্কর হিসাবে পর্তুগিজদের দান করার পাশাপাশি সেখানে কোনও বিষয়ে মুঘল হস্তক্ষেপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন এবং স্বাধীন ধর্মাচরণ-সহ আরও ১৫টি অধিকার পর্তুগিজদের দেন।বছর খানেক পর পর্তুগিজরা ফিরে আসার অনুমতি পেলেও এবারে তাদের শক্তি ছিল সীমিত।
তবে যাই হোক বিদ্রোহী খুররম থেকে পরবর্তীতে বিশ্ববিখ্যাত ‘prince of builders’ শাহজাহান তাঁর বিদ্রোহী জীবনের একটা সময় বাংলায় অবস্থান করেছিলেন তা বাংলা তথা উপমহাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
সূত্র: সর্গৃহিত।
তথ্যসূত্রঃ
১/ এম্পায়ার অফ দি মুঘল,( দ্য সারপেন্ট ট্রুথ),আলেক্স রাদারফোর্ড, রোদেলা প্রকাশনী,ঢাকা,২০১৪,(পৃষ্ঠাঃ৯৩,১৭৬-১৭৮)
২/মোগল সম্রাজ্যের সোনালী অধ্যায়,সাহাদাত হোসেন খান,আফসার ব্রাদার্স,ঢাকা,২০১৫,(পৃষ্ঠাঃ৪৩৪-৪৩৬)।
তারিখঃ ফেব্রুয়ারী ১০, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,