দারাশুকো- এক শাহজাদার চরিত্র বিচার ও মূল্যায়ন।।
মুঘল সম্রাট শাহজাহানের জেষ্ঠ্য পুত্রের নাম ছিল দারা।পারস্যের সম্রাট দারিয়ুস এর নামানুসারে তার নাম রাখা হয় দারাশুকো।মুঘল রাজবংশে এই ধরণের নামকরণ করা ছিল এক প্রকার ধারা।মুঘল সম্রাজ্যের অন্যতম আলোচিত এবং সেই সাথে হতভাগ্য এই শাহজাদার চরিত্রবিচার ও তার মূল্যায়ন নিয়ে ঐতিহাসিকমহলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আলোচনা এসেছে।তবে আধুনিককালে সমস্ত ঐতিহাসিকগন সে সময় ভারতবর্ষে অবস্থানরত পর্যটক ও চিকিৎসক বার্নিয়ের এর মূল্যায়নকেই সবচেয়ে বেশি মূল্যায়ন করেছেন।তাঁর সমকালীন অন্যান্য পর্যটকদের দেখার সাথে তাঁর দেখার বা দৃষ্টিভঙ্গির একটা বিরাট পার্থক্য রয়েছে, সেগুলো তাঁর লেখা পড়লেই স্পষ্ট করে বোঝা যায়।
বার্নিয়ের এর লিখিত ভ্রমণ বৃত্তান্ত কে ভারতে মুঘল শাসনের একটি ঐতিহাসিক আকরগ্রন্থ বলা হয়। ফরাসি পর্যটক বার্নিয়ের ১৬৫৮ সালের শেষের দিকে ভারতে আসেন।তখন ছিল ভারতবর্ষে গৃহযুদ্ধকালীন অবস্থা।বার্নিয়ের এসে দেখেন যে আজমিরের কাছে দারার সাথে আওরঙ্গজেবের সেনাদলের যুদ্ধ চলছে। ১৬৫৯ সালে দারার সাথে তাঁর সাক্ষাৎ ও পরিচয় ঘটে।দারা স্বভাবতই তার পান্ডিত্যে মুগ্ধ হন।কিন্তু আওরঙ্গজেবের কাছে পরাজয়ের পর দারা সিন্ধুর দিকে পালান এবং পথেই বার্নিয়েরের সাথে সেখানেই তার যাত্রার সমাপ্তি ঘটে। পরে বার্নিয়ের ডাকাতের কবলে পড়ে সর্বশান্ত হয়ে দিল্লী পৌঁছে সম্রাট আওরঙ্গজেবের অধীনে গৃহচিকিৎসকের চাকরি নিতে বাধ্য হন।এছাড়াও কিছুদিন তিনি তৎকালীন মুঘল সাম্রাজ্যের প্রভাবশালী ওমরাহ দানেশমন্দ খাঁ’র অধিনেও করেছিলেন। তাঁর সান্নিধ্য লাভ করেই বার্নিয়ের মুঘল রাজদরবার ও বংশের অনেক গোপন কথা, আদব-কায়দা ইত্যাদি জানতে পেরেছিলেন। তিনি যখন মিসলিপত্তনম ও গোলকুন্ডা তে ছিলেন তখন তিনি শাহজাহানের মৃত্যু সংবাদ পেয়েছিলেন।
বার্নিয়ের মতে দারাশুকো যথেষ্ট সদগুনের অধিকারী ছিলেন। এমনকি তার মতো শাহজাদা খুব একটা দেখা যায় না এটাও তিনি বলেছেন।কথা-বার্তায়, আলাপ-আলোচনায়, আচারে-ব্যবহারে তাঁর মতন ভদ্র ও শিষ্ট আর কোনও রাজকুমার ছিলেন কিনা সন্দেহ। কিন্তু নিজের সম্বন্ধে তাঁর অত্যন্ত বেশি উচ্চ-ধারণা ছিল। তিনি ভাবতেন তাঁর মতন বুদ্ধিমান ব্যক্তি, আশেপাশে আর কেউ নেই এবং কোনও ব্যাপারে কারও সঙ্গে যে শলা-পরামর্শ করা যেতে পারে সেটা তিনি মনে করতেন না। এভাবেই তিনি তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু-বান্ধবদের কাছে অত্যন্ত অপ্রীতিভাজন হয়ে উঠেছিলেন। সিংহাসনের লোভে তাঁর ভাইদের গোপন চক্রান্তের কথা তাঁর বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে অনেকে জানলেও, তাঁর উদ্ধত স্বভাবের জন্য কেউ তাঁকে কিছু জানাতে সাহস করে নি। তবে কেবলমাত্র আত্ম-অহংকার ই না, এর সাথে যুক্ত হয়েছিল বদমেজাজও। হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে যাঁকে যা খুশি বলতে তিনি একটুও ইতস্ততঃ করতেন না, হোমড়াচোমরা আমির-ওমরাহদেরও না। কথায় কথায় তিনি সকলকে অপমান করতেন, গালাগালি পর্যন্ত দিতেন। যদিও তাঁর রাগের স্ফুলিঙ্গ দপ করে যেমন জ্বলে উঠত, তেমনি তাড়াতাড়ি নিভেও যেত। একজন মুসলমান হিসেবে তিনি নিজের ধর্মের ক্রিয়াকর্ম সবই করতেন, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবনে তাঁর কোনও ধরনের ধর্ম-গোঁড়ামি ছিল না। তিনি হিন্দুদের সাথে হিন্দুর মতন মিশতেন আবার খ্রিষ্টানদের সাথে খ্রিষ্টানের মতন। তাঁর আশেপাশে সবসময় হিন্দু পন্ডিত ও শাস্ত্রকাররা থাকতেন, এবং তাঁদের খোলা হাতে বৃত্তি দিতে তিনি কোনও কার্পণ্য করতেন না। জেসুইট ফাদারের সাথে তাঁর বিশেষ খাতির ছিল। শোনা যায়, রেভারেন্ড ফাদার বুজি’র ওপরে তাঁর প্রগাঢ় বিশ্বাস ছিল এবং তাঁর মতামত তিনি নাকি শ্রদ্ধাভরে শুনতেন।
তবে যাইহোক দারার এই ধর্মীয় সহনশীলতা কে সবাই ভালোভাবে নিয়েছেন তা কিন্তু নয়। একদল লোক আবার বলত যে দারা কোনো ধর্মেই বিশ্বাস করতেন না, সব ধর্মের প্রতি তিনি কেবলমাত্র কৌতূহলবশে আগ্রহ দেখাতেন এবং নিছক মজা করার জন্য সকলের সাথে মিশতেন। কেউ কেউ আবার বলেন যে সবটাই ছিল তাঁর রাজনৈতিক মতলব, কোনও উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য তিনি সুবিধা মতন হিন্দুপ্রীতি ও খ্রিস্টানপ্রীতি দেখাতেন। মানুচ্চি নামের এক পাদ্রী দারার খৃস্টানপ্রীতি দেখে বলেছিলেন যে, দারা রাজা হয়ে গেলে, তাঁর সাথে খ্রিস্টানরাও দেশের হিন্দুদের রাজা হয়ে যেত! আসলে মুঘল গোলন্দাজবাহিনী তে খ্রিস্টান সংখ্যা বেশি ছিল বলে, তিনি তাঁদের সাথে সৌহার্য বজায় রাখতেন, কারণ তাতে সামরিক বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকা যেত। তিনি হিন্দুপ্রীতি দেখাতেন দেশীয় নৃপতিদের ক্ষেত্রে, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু, এবং রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র ও বিদ্রোহে যাঁদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সাহায্য তাঁর দরকার ছিল। কিন্তু তাহলেও দারার এই ধর্ম-উদারতা কৌশল খুব বেশি কাজে লাগে নি, এবং তাতে তাঁর কোনো উদ্যেশ্যই চরিতার্থ হয় নি। উল্টে আওরঙ্গজেব তাঁর এই ‘ভণ্ডামির’ সুযোগ নিয়ে, তাঁকে ‘কাফের’ প্রতিপন্ন করে অনায়াসে তাঁর শিরচ্ছেদ করতে পেরেছিল।
বার্নিয়ের এর লেখনীতে মোটামুটি দারা শুকো সম্পর্কে এই চিত্রটি দেখা যায়।অন্যান্য আরো ঐতিহাসিকগন দারার চরিত্র বিশ্লেষণ করে আরো ভিন্ন ভিন্ন মতে পৌছেছেন।কারো মতে দারাশুকো যে দুর্ভাগ্যে পতিত হয়েছিলেন তার জন্য তিনি নিজেই দায়ী।আর আওরঙ্গজেব ভারতবর্ষের সম্রাট না হয়ে যদি দারাও হতেন তবুও মুঘল সম্রাজ্যে পতনের সুর বেজে উঠতো কারন দারার কূটনীতি,রাজনীতি,সমরনীতি জ্ঞান ছিল প্রায় শূন্যের কোঠায়।হাঁ ধর্মীয় সহনশীলতা দিয়ে অবশ্যই সকলের মন জয় করা যায় কিন্তু রাজ্য পরিচালনা করতে গেলে তার থেকেও অনেক বেশি কিছুর প্রয়োজন।একজন প্রকৃত সম্রাটের যা যা গুণাবলী থাকা প্রয়োজন তার অনেক কিছুই দারার ভেতর ছিল না তা একবাক্যে সবাই স্বীকার করেন।কান্দাহার অভিযানের সময় জয়সিংহের মতো উচ্চপদস্থ মদনবদারকে চটানো, গণকদের ভন্ডামিতে বিশ্বাস করা,আমির ওমরাহদের সাথে যা খুশি ব্যবহার করা কখনোই একজন যুবরাজের মানায় না।তথাপি দারা শুকো সত্যিই মানুষ হিসেবে যে অসাধারন ছিলেন তাতে কোন ঐতিহাসিক দ্বিমত পোষণ করেননি।
সূত্র: সংগৃহিত।
তথ্যসূত্র:
১/বাদশাহী আমল, বিনয় ঘোষ,প্রকাশ ভবন,কোলকাতা,চৈত্র ১৩৬৩,(পৃষ্ঠাঃ১৭-১৯)।
২/শাহাজাদা দারাশুকো, কালিকারঞ্জন কানুনগো, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ,কোলকাতা,১৯৮৬, (পৃষ্ঠাঃ২৫-২৬)।
৩/ শাহজাদা দারাশুকো,শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, দে’জ পাবলিশার্চ,কোলকাতা,১৯৯৩,(পৃষ্ঠাঃ৬৮৮-৬৮৯)।
তারিখ: ফেব্রুয়ারী ০৯, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,