সময়কাল ১৫৯১ সাল, স্থান ভেনিস ইতালি।
জিওভাননি মচেনিগো নামে এক ভদ্রলোক ইতালিয়ান দার্শনিক জিওর্দানো ব্রুণোর বিরুদ্ধে ধর্ম ও ঈশ্বর বিরোধীতার অভিযোগ আনলেন। ঐ বছরই ব্রুনোকে গ্রেপ্তার করে তাঁকে ভেনিশিয়ান ইনকুইজিশনের মুখোমুখি করা হয়। ইনকুইজিশন হলো রোমান ক্যাথলিক গির্জার একটি বিচার ব্যবস্থা, যেখানে ধর্ম অবমাননা কারীদের বিচার করা হতো। তার বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ, তিনি প্রচার করে বেড়ান, এই মহাবিশ্বের মতো আরো মহাবিশ্ব আছে এবং পৃথিবী গোল। সূর্য এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয় বরং এটি একটি নক্ষত্র, পৃথিবী তাকে প্রদক্ষিণ করে ।
ব্রুনো খুব দক্ষতার সাথে তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ খণ্ডন করেন। প্রমাণ করে দেন, তিনিই সঠিক। এরপর তাঁকে রোমে পাঠানো হয়। সাত বছর ধরে সেখানে চলে বিচারকাজ। ততদিন তাঁকে নোনা টাওয়ারে বন্দী করে রাখা হয়।
অবশেষে রোমান ইনকুইজিটর কার্ডিনাল বেলারমাইন ব্রুনোকে তাঁর ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চাইতে বলেন। কিন্তু তিনি তা করতে অস্বীকার করেন। ১৬০০ সালের ২০শে জানুয়ারি পোপ অষ্টম ক্লেমেন্ট ব্রুনোকে মৃত্যুদণ্ড দেন। ১৭ই ফেব্রুয়ারি তাঁকে রোমের কেন্দ্রীয় বাজার Campo de’ Fiori তে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর হাজারো জনতার সামনে প্রকাশ্যে খুঁটির সাথে বেঁধে পুড়িয়ে মারা হয়। দেহভস্ম ছড়িয়ে দেয়া হলো টাইবার নদীতে।
এ কাহিনী তো শুনেছেন অনেকেই, কিন্তু এটা কি জানেন এর বহু আগে আরো একজনকে খ্রীষ্টান যাজকেরা পুড়িয়ে মারে ? সম্ভবত তিনি ছিলেন বিশ্বের প্রথম #মহিলা_গণিতজ্ঞ!
৩৭০-৪০০ খ্রিস্টাব্দের আলেকজান্দ্রিয়া। শহরের সব মহিলারা যখন সংসার আর সন্তান সামলাতে ব্যস্ত, ঠিক সেই সময় এক অসামান্যা সুন্দরী মেয়ে সাদা পোশাক পরে দর্শন, গণিত, বিজ্ঞান বিষয়ে বলে বেড়াতেন রাস্তায় রাস্তায়। শত শত লোক মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনত তার বক্তৃতা। তিনি #হাইপেশিয়া। ইতিহাস বলে তিনিই প্রথম মহিলা গণিতজ্ঞ, দার্শনিক, জ্যোতির্বিজ্ঞানী এবং আলেকজান্দ্রিয়ান লাইব্রেরির গবেষক। যার মৃত্যুর পর মিশরের জ্ঞানের আলো নিভে গিয়েছিল প্রায় হাজার বছরের জন্য।
হাইপেশিয়া গণিত শেখাতেন। চেষ্টা করতেন বিষয়ের বাস্তব প্রয়োগ বের করা এবং সেগুলো সহজভাবে বোঝানো। এছাড়া তিনি জল নিষ্কাশন, জলের স্তর পরিমাপ যন্ত্র এবং তারা, গ্রহ ও সূর্যের অবস্থান পরিমাপের জন্য অ্যাস্ট্রোলোব তৈরি করেছিলেন। তরলের ঘনত্ব মাপের জন্য তামার তৈরি একটি হাইড্রোমিটারও তৈরি করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন প্রত্যকের মুক্ত চিন্তা করার অধিকার রয়েছে।
তখনকার আলেকজান্দ্রিয়া খ্রিস্টান ও ইহুদি দুটি ধর্মেরই সমান বিশ্বাসী থাকলেও, সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে খ্রিস্টানদের প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। তারা আলেকজান্দ্রিয়াকে সম্পূর্ণ চার্চের অধীনে নিয়ে আসার চেষ্টা করে। অসংখ্য ইহুদিকে শহর থেকে তাড়িয়ে তাদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
শহরের গভর্নর অরিস্টিস নিজে খ্রিস্টান হয়েও খ্রিস্টান এবং ইহুদিদের ভেতর সমঝোতা করানোর জন্য ইহুদিদের পক্ষ নিলে চার্চের বিশপ সেরিল এবং শহরের অন্যান্য খ্রিস্টানরা চরম ক্ষেপে ওঠে। অরিস্টিস পরবর্তীতে খুন হন। হাইপেশিয়ার সঙ্গে অরিস্টিসের বন্ধুত্ব ছিল। রাজনৈতিক নানা ব্যপারে অরিস্টিস তার সাথে আলোচনা করতেন। এই সম্পর্কই হাইপেশিয়ার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
হাইপেশিয়া সেই পুরুষ শাসিত সমাজে মাথা উঁচু করে ঘুরে বেড়াতেন এবং প্রকাশ্যে নিওপ্লেটনিজম ও প্যাগানিজম নিয়ে আলোচনা করতেন। বক্তৃতায় নির্ভীকভাবে খ্রিস্টধর্মের অসারতা তুলে ধরেন, এবং প্রত্যেককে স্বাধীনভাবে চিন্তা করার জন্য উৎসাহ দেন। স্বভাবতই হাইপেশিয়ার জনপ্রিয়তা চার্চের সুনামের পরিপন্থী হয়ে ওঠে। তিনি বিশপ দের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলেন। সিরিল খ্রিষ্টানদের মধ্যে গুজব ছড়ায় যে, হাইপেশিয়াই অরিস্টিসকে কুবুদ্ধি দিচ্ছে খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে যাওয়ার জন্য। তিনি অরিস্টিসকে জাদু করেছেন। তিনি ডাইনি ও চার্চের শত্রু। দাবানলের মতো এই গুজব চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
৪১৫ সালের এক দুপুরে হাইপেশিয়া যখন লাইব্রেরির দিকে যাচ্ছিলেন, তখন পিটারের নেতৃত্বে একদল ধর্মোন্মাদ জনতা হাইপেশিয়াকে তার ঘোড়ার গাড়ি থেকে টেনে হিচড়ে বের করে। তাকে বিবস্ত্র করে টানতে টানতে রাস্তায় নিয়ে আসে। ভাঙ্গা টাইলস এবং শামুকের খোলস দিয়ে খুবলে খুবলে তার মাংস ছিড়ে ফেলে তাকে হত্যা করে। এরপর তারা ক্ষত বিক্ষত হাইপেশিয়াকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে। 🔥🔥
এভাবেই শেষ হয় বিশ্বের প্রথম মহিলা গণিতবিদ, দার্শনিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীর জীবন। হাইপেশিয়ার মৃত্যুর কয়েক দিন পরই আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির যা কিছু অবশিষ্ট ছিল, সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে ফেলা হয়, সেই সঙ্গে হাইপেশিয়ার সব কাজও। এরপর আলেক্সান্দ্রিয়ার লাইব্রেরী, জাদুঘর এবং সোনালী সভ্যতার ইতিহাস ফিরে পেতে লেগেছিল কয়েক হাজার বছর।
সেই ট্রাডিশন চলছে আজও। ভেড়ার পালের মতো যেদিকে সব মানুষ যায়, সেদিকে যায় না এমন মানুষ খুব কম। স্রোতের বিপরীতে দাঁড়াতে শিরদাঁড়ায় জোর থাকতে হয়, সেটি হাতে গোনা ক’জনেরই বা আছে!
সূত্র: সংগৃহিত।
লেখক: স্বপন সেন
তারিখ: ফেব্রুয়ারী ০৪, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,