‘আন্দু’ সিলেটের আঞ্চলিক শব্দ। অনর্থক বা খামোখা অর্থেই ব্যবহৃত হয়। সিলেটে কথাকে বলা হয় মাত। কথাবার্তায় অনর্থক কিছু শোনা গেলে ভর্ৎসনা শুনতে হয় আন্দুমাত বলে। নদী বা গাঙের নাম কেন আন্দু? এ প্রশ্নের উত্তর জানতেই গত বৃহস্পতিবার আন্দুগাঙ যাওয়া।
সিলেটের দীর্ঘতম নদী সুরমা। কানাইঘাট থেকে গোলাপগঞ্জ, সিলেট শহর ঘুরে সুনামগঞ্জ জেলায় প্রবহমান। সুরমার ক্ষয়িষ্ণু রূপ উৎসমুখ এলাকা কানাইঘাটেও। শুষ্ককালের এই সময়ে সেতু থেকে নদীর উভয় দিকে তাকালে নদীর জল যেন তলানিতে গিয়ে ঠেকছে দেখায়। ফাল্গুন-চৈত্র মাসে সুরমার বুকে অনেক স্থানে হাঁটুজলও মেলে না। নাব্যতা হারানো এই সুরমার একটি অংশে বড় রকমের পরিবর্তন দেখা দেয় কানাইঘাট উপজেলার তিনটি ইউনিয়ন লক্ষ্মীপ্রসাদ, দিঘিরপাড় (পূর্ব) ও সাতবাঁকে। ১৮৯৭ সালে সিলেট অঞ্চলে ‘বড় ভৈসাল’ খ্যাত ভূমিকম্পের পর বদলে যায় সুরমার গতিপথ। জুলাই গ্রামের দিকে যাওয়া সুরমায় তখন সর্বপ্লাবী স্রোত। আশপাশের মানুষের নিরাপদ বসবাসে ব্যাঘাত ঘটে। বড় ভৈসালে সুরমা নদী নিয়ে বিপাকে পড়ায় বছর দুয়েক পর নদীর এপাড়-ওপাড়ে স্থায়ী বাঁধ দেওয়া হয়। সেই থেকে সুরমার একটি অংশের জলধারা বন্দী হয়ে পড়ে। গাঙের এই জলে কোনো তরঙ্গ নেই। যেন অনর্থক জলাধার। দেখা থেকে নাম পড়ে আন্দুগাঙ।
উত্তর-পশ্চিম তীরে গ্রাম্য হাট। ব্রিটিশ আমলে এই হাটের বেশ কদর ছিল। জমজমাট হওয়ায় নামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল গঞ্জ। কয়েকটি গঞ্জ মিলে একটি শহর হয়। সেটি সেকালে আর শহর হয়নি। এখন সাদামাটা ভবানীগঞ্জ বাজার। আন্দুগাঙে ভর করে চলে এই হাট। একটি খেয়া আছে পারাপারের। খেয়া পার হওয়ার সময় গাঙে বাঁধ দেওয়ার গল্পটি ব্রিটিশ আমলের বলে নির্দিষ্ট করে জানালেন ভবানীগঞ্জের বাসিন্দা ইয়াসিন মিয়া। তাঁর দাদাসহ এলাকার প্রবীণদের মুখে এখনো প্রচলিত আছে আন্দুগাঙের জন্মশতবর্ষ পেরোনোর কথা।
আন্দুগাঙের জন্মবৃত্তান্ত সন-তারিখ আর কিছু পুরোনো নথিপত্রের তত্ত্ব-তালাশ দিলেন সিলেট অঞ্চলের পুরাকীর্তির সংগঠক আবদুল হাই আল-হাদী। তিনি ‘সেভ দ্য হেরিটেজ’ নামের একটি সংগঠনের সমন্বয়ক। ইতিহাস ঘেঁটে আল-হাদী জানালেন, ভারতের মেঘালয় রাজ্যের কূলঘেঁষা কানাইঘাট ব্রিটিশ আমলে গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ছিল। এ জন্য ১৮৯৭ সালের বড় ভূমিকম্পের পর অবকাঠামোগত পরিবর্তনে ব্রিটিশ সরকার তাৎক্ষণিক অনেক পদক্ষেপ নিয়েছিল এই জনপদের মানুষের নিরাপদ বসবাসের সুবিধায়। সেই সব উদ্যোগের একটি দৃশ্যমান এই আন্দুগাঙে। ভূমিকম্পে গতিপথ হারানো সুরমার তীব্র স্রোত বন্দী করে রাখা হয়েছিল। নদীর জলকে বন্দী করে রাখার চিহ্ন বহন করছে আন্দুগাঙ।
ইতিহাস বলছে, আন্দুগাঙ তাহলে শুধু নামেই। অনর্থক নয়। দেখা গেছে, ব্রিটিশ আমলে দেওয়া বাঁধটি এখন স্থায়ী। স্থানটি সুরমা-লোভা নদীর মুখ হিসেবে পরিচিতি। বাঁধের কারণে সুরমার পানিপ্রবাহ বিপরীতমুখী। একটি ছোট হাট প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বাঁধের ওপর। বাঁধের মুখ নামে পরিচিত। সেখানকার বাসিন্দারা বলেছেন, অবস্থা এখন এমন যে বাঁধটি ভেঙে দিলেও সুরমার জল আর ওদিক অর্থাৎ আন্দুগাঙে গড়াবে না। বাঁধ এলাকা থেকে ছয় কিলোমিটার পর্যন্ত নদীর জল বন্দী হয়ে আছে। এই হিসাবে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ আন্দুগাঙ। প্রস্থ প্রায় ৪০০ মিটার।
আঠারো শতকের পর কেটেছে পুরো আরেকটি শতক। এতকাল পর আন্দুগাঙ কেন আবার আলোচনায়? এ প্রশ্নের উত্তরে এসেছে পর্যটন-সম্ভাবনা। করোনাকালে দীর্ঘ লকডাউন কাটিয়ে একদিন আন্দুগাঙে চোখ পড়ে আশপাশ মানুষের। গাঙজুড়ে লাল শাপলা ফুটেছে। চোখের সামনে পুরোনো স্থানকে যেন আবার নতুন করে দেখা। এমুখ-ওমুখ করে ছড়িয়ে পড়ে আন্দুর নতুন রূপ। আশপাশ এলাকা থেকে মানুষ আসতে থাকেন। শহুরে মানুষজনও ছুটির দিন ভিড় করেন। তাঁদের যাতায়াত সুবিধায় গঠন করা হয় আন্দুগাঙ সংরক্ষণ কমিটি। তিন ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধিরা কমিটির উপদেষ্টা। নদীর জল বন্দী করে রাখা, তাই আদি নাম ‘আন্দু’র সঙ্গে ‘গাঙ’ শব্দটি বাদ দিয়ে সংরক্ষণ কমিটি প্রচার করছে আন্দু লেক।
এই সংগঠনের উদ্যোগে গত ১৬ ডিসেম্বর গাঙে ৫০টি নৌকা দিয়ে শোভাযাত্রা হয়েছে। আগামী মার্চ মাসে স্বাধীনতা দিবসের সুবর্ণজয়ন্তীতে গণগোসল ও গণসাঁতারের আয়োজন করার প্রস্তুতি রয়েছে। এই সব আয়োজন করার মূলে সংগঠনের পক্ষ থেকে একটি দাবিও রয়েছে। সংরক্ষণব্যবস্থা জোরদার করে পর্যটনকেন্দ্র ঘোষণার। ১৭ সদস্যের সংরক্ষণ কমিটির সভাপতি আশরাফুল হক। সিলেটের মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির এলএলবি সম্মানের ছাত্র আশরাফুলের সঙ্গে কথা হয় নৌকায় বসে। হাতে বাওয়া নৌকা নিয়েই প্রথম কথা তাঁর। এতকাল ধরে ধীরস্থির পানির এই গাঙ, কিন্তু বাইরে থেকে কেউ দেখতে আসেনি কখনো। করোনার লকডাউনের পর প্রথম কিছু মানুষ আসতে থাকেন। মানুষজন আসছেন দেখে তাঁরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবি দিয়ে প্রচারও করেন। মানুষের আগমন বাড়ছে, গাঙের যাতে ক্ষতি না হয়, এ জন্য ইঞ্জিনচালিত নৌকা চলাচল নিষিদ্ধ করে হাতে বাওয়া ১০টি নৌকা ঘাটে রেখে একটি মুঠোফোন নম্বর সাঁটিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই নম্বরে কল করলেই গাঙ ঘুরে দেখান নৌকার মাঝিরা।
কানাইঘাটের সড়কের বাজার দিয়ে জুলাই গ্রাম হয়ে সেখানে যাওয়া। ফেরা হয় আরেক পথ কানাইঘাট হয়ে প্রবহমান সুরমা নদী পেরিয়ে পৌর শহর দিয়ে। যাতায়াতের দুই সড়কপথই সুন্দর। কোনো যাতায়াত বিড়ম্বনা ছাড়াই ঘণ্টা দুয়েকে পৌঁছানো যায়। আন্দুর জলবন্দি রূপ দেখতে হলে সকাল কিংবা বিকেলটা সবচেয়ে সুন্দর মুহূর্ত। ভরদুপুরে ঘুরতে গেলে গোসল করার ইচ্ছা জাগে। সুনসান জল, অধিকাংশ গভীর। এই গভীরতা চৈত্র মাসেও ১০০ ফুট থাকে। শান্ত-সুমন্ত জলধারায় তিন ইউনিয়নের ব্যবহারের পানি নিয়ে কোনো হাহাকার নেই। শুষ্ককালে জমির সেচসংকট ঘোচায় আন্দুগাঙ।
দুই তীরে বসতি এলাকার গাছগাছালিতে ঝাঁকে ঝাঁকে পানকৌড়িসহ নানা প্রজাতির পাখি। এসব পাখির নির্বিঘ্নে ওড়াউড়ি নজর কাড়ে। একাংশে জলমহাল চিহ্নিত। চাতল হাওরের সঙ্গে একটি সংযোগ থেকে মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন হয়। কানাইঘাট উপজেলা প্রশাসনের ইজারা ব্যবস্থাপনায় প্রতিবছর মাছ আহরণও হয়। দেশীয় নানা প্রজাতির মাছের মধ্যে আন্দুর চাপিলা মাছের বাজারে আলাদা কদর আছে।
সিলেট অঞ্চলে সুরমা, কুশিয়ারাসহ বড় বড় নদী-নদীর প্রধান সমস্যা নাব্যতা হারানো। প্রতিবছর আন্তর্জাতিক নদী দিবস ও নদীকৃত্য দিবসে মরা নদীর ভরা অতীত ফেরাতে নানা কর্মসূচি পালন হয়। সিলেটে প্রায় এক যুগ ধরে এসব কর্মসূচির আয়োজক নদীসংগ্রামী আবদুল করিম চৌধুরী। ওয়াটারকিপার অ্যালায়েন্স নামের আন্তর্জাতিক সংগঠনের সদস্য হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে নদী সম্মেলনে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতায় তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে সেখানকার সুদীর্ঘকাল জলবন্দি অবস্থা। পানির আকালের এই যুগে বারো মাস পানি সংরক্ষণ নিয়ে পানিবিশেষজ্ঞ কিংবা পানি অধিকারকর্মীদের গবেষণার বিষয়বস্তু হতে পারে আন্দুগাঙ।’
সূত্র এবং ছবি : প্রথম আলো
তারিখ: ফেব্রুয়ারী ০৩, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,