কড়াইটির এক পাশ থেকে আরেক পাশের ব্যাস ৮ দশমিক ৬ ফুট। মানে কয়েকজন মানুষ কড়াইয়ের ভেতরে টান টান হয়ে শুয়ে ঘুমাতে পারবেন। লোহার এ কড়াইয়ের ওজন এক টন। আর এতে এক হাজার কেজির বেশি রান্না করা যাবে। রান্নার সময় খাবার নাড়া দেওয়ার জন্য জন্য কড়াইয়ের প্রায় সমান সিমেন্টের চুলার চার পাশে পাকা টুল বসানো হয়েছে। কড়াইয়ের নিচে দাউ দাউ করে জ্বলছে চারটি আলাদা আলাদা গ্যাসের চুলা। কড়াইসহ এই অবকাঠামো তৈরিতে খরচ হয়েছে দুই লাখ টাকা।
এই হলো বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের মেগা কিচেনের চিত্র। বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবকেরা বলছেন, এটি দেশের সবচেয়ে বড় কড়াই বলেই মনে করা হচ্ছে। এ কড়াইয়ে একসঙ্গে চার হাজার মানুষের রান্না করা যাবে। তবে এখন পর্যন্ত দেড় হাজারজনের রান্না একসঙ্গে করা হয়েছে। রান্না শুরু এবং শেষে এই কড়াই ধোয়ার কাজটিও কঠিন। একজন স্বেচ্ছাসেবক কড়াইয়ের ভেতরে ঢুকে তা পরিষ্কার করেন। পরে তিনি কড়াই থেকে বের হলে বাঁশে কাপড় পেঁচিয়ে তা আবার ধোয়া হয়।
ঢাকার কেরানীগঞ্জে ১৩ জানুয়ারি থেকে এ কড়াইতে রান্না শুরু হয়েছে। কড়াইটির পাশেই বড় করে লেখা, ‘সেরা সম্পর্কগুলো খাবার শেয়ার থেকে সৃষ্টি হয়’।
বৃহস্পতিবার সকাল আটটায় কেরানীগঞ্জের মেগা কিচেনে গিয়ে দেখা যায়, কড়াইয়ে মাংস রান্না চলছে। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান কিশোর কুমার দাস দুজন স্বেচ্ছাসেবককে নিয়েই রান্নার আয়োজনে ব্যস্ত। পাশের রুমেই ঘুমাচ্ছিলেন অন্য স্বেচ্ছাসেবকেরা।
মেগা কিচেনে রান্নার বিশাল কর্মযজ্ঞ। রান্না হচ্ছিল বিদ্যানন্দের এক টাকায় আহার প্রকল্পের এক হাজার ছিন্নমূল পথশিশু ও নিম্ন আয়ের ভাসমান মানুষের জন্য। বুধবার রাতেই মাংস কিনে পাঠিয়েছেন একজন দাতা। অন্য দাতাদের কাছ থেকে পাওয়া ১০০ কেজির বেশি চাল, ১ হাজার ১০০ সেদ্ধ ডিম, ১৫০টি ফেটানো ডিম, টুকরা করে কাটা আলু দিয়ে রান্না হচ্ছে স্পেশাল শাহি খিচুড়ি। এ খিচুড়ির জন্য পেঁয়াজ-রসুনসহ মসলাই লেগেছে ৩০ কেজি। লবণের বড় প্যাকেট খুলে তা ঢেলে দেওয়া হচ্ছে কড়াইয়ে। বড় কড়াইয়ের পাশে তিনটি বড় বড় গ্যাসের চুলায় বিশাল হাঁড়িতে ডিম সেদ্ধ ও হলুদ দিয়ে ভাত রান্না করা হচ্ছে। মাংস সেদ্ধ হলে মাঝখানে রেখে তার চারপাশে হলুদ ভাত স্তূপ করে রাখা হয়। তারপর আস্তে আস্তে পেঁয়াজকুচি, ছেঁচা রসুন, ফেটানো ডিম মিশিয়ে তা আস্তে আস্তে ভেজে এ রান্না করছিলেন স্বেচ্ছাসেবকেরা।
কিশোর কুমার দাস বিশাল কড়াই প্রসঙ্গে বলেন, ‘দেশের বাইরের মেগা কিচেন, আজমির শরিফসহ বিভিন্ন আশ্রমে বড় কড়াইয়ে রান্না হয়। তা দেখেই এ চিন্তা মাথায় আসে। তবে কড়াইটি দেশে সব থেকে বড় কি না, এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামাইনি। আমাদের মূল চেষ্টা কাজটা সহজ করা। এক হাজার মানুষের রান্নার জন্য কম করে হলেও ছয় থেকে সাতটি চুলায় রান্না করতে হতো। গ্যাস বেশি খরচ হতো। জনবল বেশি লাগত। অথচ এ কড়াইয়ে কম জনবল দিয়েই দ্রুত রান্না করা সম্ভব। আজ আমিসহ মাত্র তিনজনে চার ঘণ্টায় শাহি খিচুড়ি রান্না করলাম।’
কড়াই কীভাবে বানানো হয়েছে, সে প্রসঙ্গে কিশোর কুমার দাস হাসতে হাসতে বলেন, ‘বাণিজ্যিকভাবে যাঁরা রান্না করেন, তাঁরা বিদেশ থেকে বড় কড়াই নিয়ে আসেন। আমরা দেশের একজন কারিগরকে কোনোভাবে রাজি করিয়েছিলাম এটি বানিয়ে দিতে। পরে ওই কারিগর কান্নাকাটি করেছেন এটি বানাবেন না বলে। তাঁর মেশিনই কয়েকবার ভেঙে যায়। তবে এখন সেই কারিগর খুব খুশি।’
কেরানীগঞ্জের মেগা কিচেনের আয়তন তিন হাজার বর্গফুটের বেশি। রান্নাঘরের জায়গাটি অনুদান দিয়েছেন স্থানীয় প্রিন্টিং ব্যবসায়ী এমদাদুল হক। তিনি নিজেও বিদ্যানন্দের একজন স্বেচ্ছাসেবক ও দাতা।
কিশোর কুমার দাস পেরুতে থাকেন, বর্তমানে দেশে এসেছেন। তিনি নিজেই স্বেচ্ছাসেবকদের বিশাল কড়াইয়ে রান্নার বিভিন্ন কৌশল শেখাচ্ছেন কিছুদিন ধরে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকে কিশোর কুমারের সঙ্গে কাজ করছিলেন বান্দরবান থেকে আসা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ডিগ্রিপড়ুয়া সমিতা তঞ্চঙ্গ্যা। রান্না শেষে তিনি বলেন, তিনি বাড়িতে সেভাবে রান্না করেন না। আর জীবনে এত বড় কড়াই চোখেও দেখেননি। খিচুড়ি নাড়তে বেশ কষ্ট হয়েছে। তবে রান্নার পর খুব ভালো লাগছে।
সূত্র : প্রথম আলো
তারিখ: জানুয়ারী ২২, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,