হাজার পাঁচেক বছর আগের কথা। একদিন ঘটনাক্রমেই চীনের সম্রাট শেননংয়ের গরম পানির পাত্রে উড়ে এসে জুড়ে বসে রং ছড়ায় একটি পাতা। সেই পাতার নির্যাসযুক্ত গরম পানিটুকু খেয়ে যেন তুড়িতেই উড়ে যায় শেননংয়ের ঘুম আর ক্লান্তি ভাব। তিনি বুঝতে পারেন, যেনতেন নয়, জাদুকরী গুণ ছিল পাতাটির। খোঁজ পড়ে পাতার। মিলে যায় সন্ধানও।
গ্রিক দেবী থিয়ার নামে পাতার নাম রাখা হয় ‘টি’; যা চীনে ‘চি’ উচ্চারিত হতে হতে একসময় হয়ে যায় ‘চা’। বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম জনপ্রিয় পানীয়গুলোর মধ্যে একটি এই ‘চা’। সকালের ভাঙা ঘুমের জড়তা কাটানো থেকে শুরু করে নাশতার টেবিল, দুপুরের মিটিং কিংবা বিকেলের আড্ডার ফাঁকে ধোঁয়া ওঠা এক কাপ গরম চায়েই যেন খুঁজে পাওয়া যায় চনমনে চাঙা ভাবের আস্বাদন। সুগন্ধি ও স্বাদযুক্ত এ পানীয় শুধু তৃষ্ণাই মেটায় না, শরীরজুড়ে এনে দেয় স্নিগ্ধ ও শান্তিদায়ক অনুভূতি; যা বেশ উপভোগ্যই বটে। তবে রোজকার স্বাস্থ্যরক্ষায় এর ভেষজ গুণ প্রাকৃতিক দাওয়াইয়েরই শামিল।
আড়াই বছর আগে চীনা মনীষী লাৎসে চা–কে আখ্যায়িত করেছিলেন মহৌষধ বা পরশমণি হিসেবে। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় গবেষকেরাও একই মত দিয়েছেন। চায়ে থাকে ফ্ল্যাভোনয়েড নামের একধরনের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট; যা দেহে প্রবেশ করামাত্রই বাড়ায় হৃদ্যন্ত্রের সক্রিয়তা। রক্তনালি সুস্থ রাখে। শরীরে দেয় তরতাজা ও উৎফুল্ল ভাব। ফলে হার্ট অ্যাটাক হওয়ার শঙ্কাও কমে যায়।
ফলমূল বা শাকসবজিতে যে পরিমাণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পাওয়া যায়, চায়ে তার চেয়ে বেশি পরিমাণে রয়েছে। চা অভ্যর্থনার পানীয় হিসেবে জনপ্রিয় হলেও এর ঔষধি গুণটি সমান্তরালভাবে স্বীকৃত। হরেক রকম চায়ের রয়েছে হরেক রকম ভেষজ গুণ। ব্ল্যাক টি বা কালো চায়ে থাকে প্রচুর পরিমাণে ক্যাফেইন, পটাশিয়াম ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট; যা শরীরের অবসাদ দূর করে। ফিরিয়ে আনে স্বাভাবিক প্রফুল্লতা।
গ্রিন টিও এখন ভীষণ জনপ্রিয়। সতেজ সবুজ পাতা রোদে শুকিয়ে তাওয়ায় সেঁকে গ্রিন টি তৈরি করা হয়। এতে এমন কিছু উপাদান আছে, যা ক্যানসার প্রতিরোধে সহায়তা করে। গবেষকেরা বলেন, নিয়মিতই এই চা পান করলে মূত্রথলি, পাকস্থলীর ক্যানসারসহ সব ধরনের ক্যানসারের ঝুঁকি ৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। গ্রিন টিতে থাকা পলিফেনল শরীরের অক্সিডেশন বাড়ায়; যা শরীরের বাড়তি ক্যালরি ক্ষয় করে ওজন কমাতে সাহায্য করে। এটি রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। গ্রিন টিতে ট্যানিক অ্যাসিড থাকে, যা মুখে ইনফেকশন সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া নষ্ট করে দাঁতের ক্ষয়রোধে সাহায্য করে এবং মাড়ি মজবুত করে।
গ্রিন টি সামান্য ফার্মেন্ট করলে হয় উলং টি। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার খাওয়ার পর উলং চায়ের লিকার খেলে কোলেস্টেরল বাড়ার আশঙ্কা কমে। এ ছাড়া রক্তে লৌহ-কণিকার প্রাধান্য থাকলে প্রধান খাবারের পর পরই চা পান করা শ্রেয়; এতে লৌহ শোষণের মাত্রা কমে যায়। বিশেষ করে থ্যালাসেমিয়ার ক্ষেত্রে।
এ ছাড়া শরীরের কোনো অংশ কেটে গেলে সেখানে গ্রিন টির লিকারে তুলা ভিজিয়ে লাগিয়ে দিলে রক্ত পড়া বন্ধ হয়। পোকামাকড় কামড়ানোর পর যদি ক্রমাগত চুলকাতে থাকে বা ফুলে যায়, তাহলে সেখানে ভেজা সবুজ চা-পাতা দিয়ে ঢেকে দিলে আরাম বোধ হয়।
চায়ে রয়েছে পর্যাপ্ত পরিমাণে পটাশিয়াম ও ক্যাফেইন। শরীরে আলস্য কাটিয়ে একটা ফুর্তি ভাব আনতে পটাশিয়াম ও ক্যাফেইনের জুড়ি নেই। যাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা রয়েছে, তাদের জন্যও পটাশিয়াম উপকারী। চায়ে রয়েছে জিংক, যা শরীর বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন। চা শুধু উদ্দীপকই নয়, এটা রক্ত জমাট বাঁধাও দূর করে। চা-পাতার সেদ্ধ পানি চুল পড়া বন্ধ করে। ২০-২৫টি কাঁচা চা-পাতা ও তুলসীপাতা একত্রে সেদ্ধ করে মাথায় মেখে ১৫ মিনিট পর ধুয়ে ফেললে উকুন দূর হয়। তবে অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন ও গর্ভবতীদের খুব বেশি চা খাওয়া উচিত নয়।
চায়ের সঙ্গে সামান্য পরিমাণে আদা ও হলুদ মিশিয়ে তৈরি হয় হলুদ চা। ১৫-২০ মিনিট পানিতে ফোটানোর পর ছেঁকে নিয়ে এর সঙ্গে লেবুর রস ও মধু মিশিয়ে তৈরি করা এ চা শরীরের কাটাছেঁড়া বা পোড়া ক্ষত সারাতে সাহায্য করে, যকৃৎকে বিষমুক্ত রাখে, ত্বকের ঔজ্জ্বল্যও বাড়ায়। আদা চা বমি বমি ভাব দূর করে। সর্দি, কাশি কিংবা গলাব্যথায় এ চা অব্যর্থ। হজমের সমস্যা মেটাতে কিংবা অ্যাসিডিটির বিরুদ্ধে লড়তে আদা চা সেরা। পিপারমিন্ট, ক্যামোমাইল, জিনসেং বা রোজমেরির মতো ভেষজ চা শরীরের জন্য বেশ উপকারী। এগুলো শরীরে ডি-টক্সিফিকেশনের কাজ করে। ফলে শরীরের অভ্যন্তরীণ দূষিত পদার্থ দূর হয় সহজেই। নিমেষেই শরীর ফিরে পায় হারানো সজীবতা।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: ডিসেম্বর ১৫, ২০২০
রেটিং করুনঃ ,