মজঃফরপুরের ক্লাবটিতে বসে ছিলেন একজন প্রমথনাথ ভট্টাচার্য। এমন সময় একজন সন্ন্যাসী এলেন। ধীর স্থির অনুপ্রবেশ। তীক্ষ্ণ ঋজু অঙ্গস্থিতি। পরিস্কার হিন্দীতে তিনি প্রমথনাথ আর তার বন্ধুদের কাছে দোয়াত কলম চাইলেন। প্রমথনাথ তাকিয়ে আছেন। সন্ন্যাসীকে দেখছেন। দোয়াত কলম দেয়া হল। কিন্তু প্রমথনাথের কৌতুহল গেল না। সন্ন্যাসীর পরিচয় জানতে আগ্রহী হলেন তিনি। বুঝতে চাইলেন নিরুদ্দেশ যাত্রার কারণ। ক্রমশ সন্ন্যাসীর চিঠি লেখা দেখে ধরে ফেললেন মানুষটা বাঙালী। পরিচয় হল। অন্তরঙ্গতা বাড়লো। কালক্রমে এই প্রমথনাথই সন্ন্যাসীকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এ্যাণ্ড সন্স এর কর্ণধার হরিদাস চট্টোপাধ্যায়ের সাথে। তারপর ‘ভারতবর্ষ’ এবং ‘গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এ্যাণ্ড সন্স’ থেকে সন্ন্যাসীর বহু গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল। এই প্রমথনাথকে চিঠি লিখতেন সন্ন্যাসী। একদিন লিখেছিলেন…
প্রমথ,
তোমার পত্র পাইয়া আজই জবাব লিখিতেছি, এমন ত হয় না। যে আমার স্বভাব জানে, তাহার কাছে নিজের সম্বন্ধে এর বেশী জবাব দিহি করা বাহুল্য।
অনেক সময়েই যে তুমি আমার কথা মনে করিবে, তাহা আমি জানি। কেন না, যাদের মনে করার কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই, তারাও যখন করে, তখন তুমি ত করিবেই।
আমার ভাগ্যবিধাতা আমার সমস্ত শাস্তির বড় এই শাস্তি জন্মকালেই বোধ হয় আমার কপালে খুদিয়া দিয়াছিলেন। আজ যদি আমি বুঝিতে পারিতাম, আমার পরিচিত আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবেরা সবাই আমাকে ভুলিয়া গিয়াছেন—আমি সুখী হইতাম, শান্তি পাইতাম! তা হইবার নয়। আমাকে ইঁহারা স্মরণ করিবেন, সন্ধান জানিতে চাহিবেন, বিচার করিবেন এবং অনবরত আমার অধোগতির দুঃখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া আমার মর্মান্তিক দুঃখের বোঝা অক্ষয় করিয়া রাখিবেন। লোকে যে আমার কাছে কি আশা করিয়াছিলেন, কি পান নাই, এবং কি হইলে যে আমাকে নিষ্কৃতি দিতে পারেন, এ যদি আমাকে কেহ বলিয়া দিতে পারিত, আমি চিরা কাল তাহার কাছে কৃতজ্ঞ হইয়া থাকিতাম। এত কথা বলিতাম না যদি তুমি গত কথা স্মরণ করাইয়া দিতে। আমি মরিয়া গিয়াছি—এই কথাটা যদি কোনো দিন কাহারো দেখা পাও—বলিয়ো।
তাই বলিয়া তুমি যেন দুঃখ পাইয়ো না। তোমাকে আমি ভয় করি না। কেন না, তুমি বোধ হয় আমার বিচার করিবার গুরু ভার লইতে চাহিবে না। তাই তোমার কাছে আরো কয়টা দিন বাঁচিয়া থাকিলেও ক্ষতি হইবে মনে করি না। তুমি আমার বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ী। বিচারক হইয়া আমার মর্মান্তিক করিবে না, এই আশাই তোমার কাছে করি।
আমার সম্বন্ধে কিছু জানিতে চাহিয়াছ—তাহা সংক্ষেপে কতকটা এইরূপ—
(১) শহরের বাহিরে একখানা ছোটো বাড়ীতে মাঠের মধ্যে এবং নদীর ধারে থাকি।
(২) চাকরি করি। ৯0 টাকা মাহিনা পাই এবং দশ টাকা এ্যালাউন্স পাই। একটা ছোটো চায়ের দোকানও আছে। দিনগত পাপক্ষয় কোনোমতে কুলাইয়া যায়, এই মাত্র। সম্বল কিছুই নাই।
(৩) ‘হার্ট ডিজিজ’ আছে। কোনো মুহূর্তেই—
(৪) পড়িয়াছি বিস্তর। প্রায় কিছুই লিখি নাই। গত দশ বৎসর ‘ফিজিওলজি, বাইওলজি, এ্যাণ্ড সাইকোলজি’ এবং কতক হিস্ট্রি পড়িয়াছি। শাস্ত্রও কতক পড়িয়াছি।
(৫) আগুনে পুড়িয়াছে আমার সমস্তই। লাইব্রেরী এবং চরিত্রহীন উপন্যসের ম্যানাস্ক্রিপট্—’নারীর ইতিহাস’ প্রায় ৪00/৫00পাতা লিখিয়া ছিলাম, তাও গেছে। ইচ্ছা ছিল যা হৌক একটা এ বৎসর ‘পাব্লিশ’ করিব। আমার দ্বারা কিছু হয়, এ বোধ হয় হইবার নয়, তাই সব পুড়িয়াছে। আবার সুরু করিব, এমন উৎসাহ পাই না। ‘চরিত্রহীন’ 500 পাতায় প্রায় শেষ হইয়াছিল—সবই গেল ।
তোমার ক্লাবের কথা শুনিয়া অত্যন্ত আনন্দ পাইলাম। কিরূপ হয় মাঝে মাঝে লিখিয়া জানাইয়ো। নিজেও কিছু করা ভাল—হুজুগের মধ্যে এ কথাও ভোলা উচিত নয়। তোমার যে রকম স্বভাব তাহাতে তুমি যে এতগুলি লোকের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হইয়া পড়িবে তাহা মোটেই বিচিত্র নয়।
আমাদের আগেকার ‘সাহিত্য-সভা’র এক মাত্র সভ্য নিরুপমা দেবীই সাহিত্যের চর্চা রাখিয়াছেন—আর সকলেই ছাড়িয়াছে—এই না ?
আমার আগেকার কোনো লেখা আমার কাছে নাই—কোথায় আছে, আছে কি না আছে কিছুই জানি না—জানিতে ইচ্ছাও করি না।
আর একটা সম্বাদ তোমাকে দিতে বাকী আছে। বছর তিনেক আগে যখন ‘হার্ট ডিজিজ’-এর প্রথম লক্ষণ প্রকাশ পায় তখন আমি পড়া ছাড়িয়া ‘অয়েল পেন্টিং’ সুরু করি। গত তিন বৎসরে অনেকগুলি ‘অয়েল পেন্টিং’ সংগ্রহ হইয়াছিল—তাহাও ভস্মসাৎ হইয়াছে। শুধু আঁকিবার সরঞ্জামগুলা বাঁচিয়াছে।
এখন আমার কি করা উচিত যদি বলিয়া দাও ত তোমার কথামত দিনকতক চেষ্ট করিয়া দেখি।
(১) নভেল, হিস্ট্রি, পেন্টিং
কোনটা ? কোনটা আবার সুরু করি বলত ।
তোমার স্নেহের শরৎ
আমার শৈশব ও যৌবন ঘোর দারিদ্র্যের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়েছে। অর্থের অভাবেই আমার শিক্ষালাভের সৌভাগ্য ঘটেনি। পিতার নিকট হতে অস্থির স্বভাব ও গভীর সাহিত্যানুরাগ ব্যতীত আমি উত্তরাধিকারসূত্রে আর কিছুই পাইনি। পিতৃদত্ত প্রথম গুণটি আমাকে ঘরছাড়া করেছিল—আমি অল্প বয়সেই সারা ভারত ঘুরে এলাম। আর পিতার দ্বিতীয় গুণের ফলে জীবন ভরে আমি কেবল স্বপ্ন দেখেই গেলাম। আমার পিতার পাণ্ডিত্য ছিল অগাধ। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা—এক কথায় সাহিত্যের সকল বিভাগেই তিনি হাত দিয়েছিলেন, কিন্তু কোনটাই তিনি শেষ করতে পারেন নি। তাঁর লেখাগুলি আজ আমার কাছে নেই—কবে কেমন করে হারিয়ে গেছে, সে কথা আজ মনে পড়ে না। কিন্তু এখনও স্পষ্ট মনে আছে, ছোটবেলায় কতবার তাঁর অসমাপ্ত লেখাগুলি নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দিয়েছি। কেন তিনি এগুলি শেষ করে যাননি, এই বলে কত দুঃখই না করেছি। অসমাপ্ত অংশগুলি কি হতে পারে, ভাবতে ভাবতে আমার অনেক বিনিদ্র রজনী কেটে গেছে।
এই কারণেই বোধ হয় সতের বৎসর বয়সের সময় আমি গল্প লিখতে শুরু করি। কিন্তু কিছুদিন বাদে গল্পরচনা অ-কেজোর কাজ মনে করে আমি অভ্যাস ছেড়ে দিলাম। তারপর অনেক বৎসর চলে গেল। আমি যে কোন কালে একটি লাইনও লিখেছি, সে কথা ভুলে গেলাম।
আঠার বৎসর পরে একদিন লিখতে আরম্ভ করলাম। কারণটা দৈব দুর্ঘটনারই মত। আমার গুটিকয়েক পুরাতন বন্ধু একটি ছোট মাসিকপত্র বের করতে উদ্যোগী হলেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠাবান্ লেখকদের কেউই এই সামান্য পত্রিকায় লেখা দিতে রাজী হলেন না। নিরুপায় হয়ে তাঁদের কেউ কেউ আমাকে স্মরণ করলেন। বিস্তর চেষ্টায় তাঁরা আমার কাছ থেকে লেখা পাঠাবার কথা আদায় করে নিলেন। এটা ১৯১৩ সনের কথা। আমি নিমরাজী হয়েছিলাম। কোন রকমে তাঁদের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যেই আমি লেখা দিতেও স্বীকার হয়েছিলাম। উদ্দেশ্য, কোন রকমে একবার রেঙ্গুন পৌঁছতে পারলেই হয়। কিন্তু চিঠির পর চিঠি আর টেলিগ্রামের তাড়া আমাকে অবশেষে সত্য সত্যই আবার কলম ধরতে প্ররোচিত করল। আমি তাঁদের নবপ্রকাশিত ‘যমুনা’র জন্য একটি ছোটগল্প পাঠালাম। এই গল্পটি প্রকাশ হতে না হতেই বাঙ্গালার পাঠকসমাজে সমাদর লাভ করল। আমিও একদিনেই নাম করে বসলাম। তারপর আমি অদ্যাবধি নিয়মিতভাবে লিখে আসছি। বাঙ্গালাদেশে বোধ হয় আমিই একমাত্র সৌভাগ্যবান লেখক, যাকে কোনদিন বাধার দুর্ভোগ ভোগ করতে হয়নি।
_________________
(‘বাতায়ন’, শরৎ স্মৃতি-সংখ্যা, ১৩৪৪)
ব্রহ্মাণ্ডে আছে কি? আছে আমার চৈতন্য এবং তদ্বিষয়ীভূত যাবতীয় পদার্থ। অন্তর্জগৎ এবং বাহ্যজগৎ। উভয়ে কি সম্বন্ধ এবং সে সম্বন্ধ সত্য কিংবা অলীক, সে আলাদা কথা। কিন্তু এই যে পরিচয় গ্রহণ, একের উপরে অপরের কার্য, ইহাই মানবের ভাব এবং চিন্তা। এবং এই পদার্থ নিশ্চয়ই মানবের চিন্তার বিষয়। এমনি করিয়াই সমস্ত স্থূল বিশ্ব একে একে মানবের ভাব-রাজ্যের আয়ত্ত হইয়া পড়ে। ঘর-বাড়ি, সমাজ, দেশ প্রভৃতি যাবতীয় পদার্থ এক-একটি চিন্তার জন্মদান করিয়া ইহারাই মানব-চিত্তে এক-একটি ভাব উৎপন্ন করে। অন্তর্জগৎ ও বাহ্যজগৎ উভয়েই বিচিত্র তথ্য ও ঘটনায় ভরিয়া উঠে। উভয় জগতের এইসব তথ্য ও ঘটনা ছাড়া মানুষ ভাবিতেই পারে না। অর্থাৎ ইহাদের দ্বারাই মানবচিত্ত আন্দোলিত হইয়া ইহাতেই পরিপূর্ণ হইয়া যায়। এক কথায় ইহারা ভাব ও ধারণার কারণও বটে, ইহারা তাহার বিষয়ও বটে।
এইবার মনের মধ্যে পদার্থের পরীক্ষা হইতে থকে। ভাব ও চিন্তার কাছে তাহাদের প্রকৃতি ও স্বরূপ ধরা পড়ে, ধর্ম ও গুণের হিসাবে নানা লক্ষণবিশিষ্ট হইয়া বাহ্যজগৎ এইবার ধীরে ধীরে সীমাবদ্ধ ও নির্দিষ্ট হইতে থাকে।
মানবের ভাব ও চিন্তাই যাবতীয় পদার্থে গুণের আরোপ করে। সে কি, আর একটার সহিত তাহার কি প্রভেদ স্থির করিয়া দেয়। তারপর পদার্থের সহিত পদার্থের তুলনা করিয়া সম্বন্ধ স্থাপন করিয়া লক্ষণ নির্ণয় করিয়া ধর্মবিশিষ্ট করিয়া আমরা তাহাদের ধারণা-কার্য সম্পূর্ণ করি।
বিভিন্ন দেশের ও বিভিন্ন সময়ের মানব-চিন্তা-প্রণালী পর্যালোচনা করিলে স্পষ্ট দেখা যায়, এই চিন্তা-প্রণালী কয়েকটা সাধারণ নিয়মের অন্তর্গত। একই নিয়মে মানবের চিন্তারাশি পরিপক্ক ও সম্পূর্ণ হইয়া উঠিয়াছে…
…তারপরে সাহিত্য। আমার মনে হয়, সর্বত্র এবং সকল সময়েই ভাষা ও সাহিত্য অচ্ছেদ্য বন্ধনে গ্রথিত। যেন পদার্থ ও তাহার ছায়া। অবশ্য প্রমাণ করিতে পারি না যে, পশুদের ভাষা আছে বলিয়া সাহিত্যও আছে। যাঁহারা ‘নাই’ বলেন, তাঁহাদের অস্বীকার খণ্ডন করিবার যুক্তি আমার নাই, কিন্তু আমার বিশ্বাস হয় না যে, ভাষা আছে কিন্তু সাহিত্য নাই।
ভাষা-বিজ্ঞানবিদেরা বলেন, মানবের কোন্ অবস্থায় তাহার প্রথম সাহিত্য-সৃষ্টি তাহা বলিবার জো নাই, খুব সম্ভব, যেদিন হইতে তাহার ভাষা, সেই দিন হইতে তাহার সাহিত্য। যেদিন হইতে সে তাহার হত দলপতির বীরত্ব-কাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র হইতে ফিরিয়া আসিয়া বলিয়াছিল, যেদিন হইতে প্রণয়ীর মন পাইবার অভিপ্রায়ে সে নিজের মনের কথা ব্যক্ত করিয়াছিল, সেই দিন হইতেই তাহার সাহিত্য।
তাই যদি হয়, কে জোর করিয়া বলিতে পারে পশু-পক্ষীর ভাষা আছে অথচ সাহিত্য নাই? আমি নিজে অনেক রকমের পাখি পুষিয়াছি, অনেক বার দেখিয়াছি তাহারা প্রয়োজনের বেশি কথা কহে, গান গাহে। সে কথা, সে গান আর একটা পাখি মন দিয়া শুনে। আমার অনেক সময় মনে হইয়াছে, উভয়েই এমন করিয়া তৃপ্তির আস্বাদ উপভোগ করে, যাহা ক্ষুৎপিপাসা নিবৃত্তির অতিরিক্ত আর কিছু। তখন, কেমন করিয়া নিঃসংশয়ে বলিতে পারি ইহাদের ভাষা আছে, গান আছে কিন্তু সাহিত্য নাই? কথাটা হয়ত হাসির উদ্রেক করিতে পারে, পশু-পক্ষীর সাহিত্য! কিন্তু সেদিন পর্যন্ত কে ভাবিতে পারিয়াছিল গাছপালা সুখদুঃখ অনুভব করে? শুধু তাই নয়, সেটা প্রকাশও করে। তেমনি হয়ত, আমার কল্পনাটাও একদিন প্রমাণ হইয়া যাইতেও পারে।
যাক ও কথা। আমার বলিবার বিষয় শুধু এই যে, ভাষা থাকিলেই সাহিত্য থাকা সম্ভব; তা সে যাহারই হোক এবং যেখানেই হোক। অনুভূতির পরিণতি যেমন ভাব ও চিন্তা, ভাষার পরিণতিও তেমনি সাহিত্য। ভাব প্রকাশ করিবার উপায় যেমন ভাষা, চিন্তা প্রকাশ করিবার উপায়ও তেমনি সাহিত্য। জাতির সাহিত্যই শুধু জানাইয়া দিতে সক্ষম সে জাতির চিন্তাধারা কোন্ দিকে কোথায় এবং কতদূরে গিয়া পৌঁছিয়াছে। দর্শন, বিজ্ঞান, আয়ুর্বেদ, এমন কি যুদ্ধবিদ্যার জ্ঞান ও চিন্তাও দেশের সাহিত্যই প্রকাশ করে…
______________
(সংগৃহীত অংশবিশেষ, মাতৃভাষা এবং সাহিত্য)
সংগৃহিত।
তারিখ : অক্টোবর ১৫, ২০২০
রেটিং করুনঃ ,