…এই পঞ্চাশ ষাট বছরের এবারকার মতো জীবনেই কি সারা সারা জীবন ফুরিয়ে গেল? এই দুপুর, এই প্রথম বসন্তের আবেশ, এই নীল আকাশ, এই বাঁশের শুকনো পাতা ও খোলার আহবান, তেলাকুচোলতার দুলুনি – এসব যে বড় ভাল লাগে।
কোথায় লেখা থাকবে তার তিন হাজার বৎসর পূর্বের এক বিস্মৃত অতীতের সেসব আনন্দভরা জীবনযাত্রা, বহুদিন পরে বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে বেলেরপানা খাওয়া মধুময় অপরাহ্নটি, বাঁশবনের ছায়ায় অপরাহ্নের নিদ্রা ভেঙ্গে পাপিয়ার সে মনমাতানো ডাক, গ্রাম্য নদীটির ধারে শ্যাম তৃণদলের উপর বসে বসে কত গান গাওয়া, কত আনন্দকল্পনা, এক বৈশাখের রাত্রিতে প্রথম বর্ষণসিক্ত ধরণীর সেই মৃদুসুগন্ধ যা তার নববিবাহিতা তরুণী পত্নীর সঙ্গে সে উপভোগ করেছিল?…
…তাই এই মাত্র অন্ধকারে কাছারীর পথ দিয়ে বেড়াতে বেড়াতে ভাবছিলাম, ভগবান আমি তোমার অন্য স্বর্গ চাই না – তোমার দেবলোক পিতৃলোক বিষ্ণুলোক – তোমার বিশাল অনন্ত নক্ষত্রজগৎ তুমি পুণ্যাত্মা মহাপুরুষদের জন্যে রেখে দিও। যুগে যুগে তুমি এই মাটির পৃথিবীতে আমাকে নিয়ে এস, এই ফুলফল, এই দুখদুঃখের স্মৃতি, এই মুগ্ধ শৈশবের মায়াজগতের মধ্যে দিয়ে বার বার যেন আসাযাওয়ার পথ তোমার আশীর্বাদে অক্ষয় হয়।…
…আমি এই যাওয়া-আসার স্বপ্নে ভোর হয়ে বড় আনন্দ পাই। আবার যে আসতে হবে তার পর, তাও আমি জানি।…আবার বহুদূর জন্মান্তরে হয়তো ফিরতে হবে। পাঁচশো বছর পরের সূর্যের আলোকে একদিন অসহায় অবোধ শিশু-নয়ন দুটি মেলবো। পাঁচশো বছর পরের পাখীর গান, ফুলবন, জ্যোৎস্না আবার আমাকে অভ্যর্থনা করে নেবে। কোন্ অজানা দেশের অজানা পর্ণ-কুটিরে কোন অজ্ঞাত দেশের অজ্ঞাত ছায়াঝোপের তলে মাঠে বনে মুগ্ধ শৈশব কাটিয়ে – অনাগত মা-বাবার স্নেহের সুধায় মানুষ হবো।…
…মানুষকে শুধু চলতে হবে, চলাই তার ধর্ম। পথের নেশা তোমাকে আশ্রয় করুক। যুগে যুগে তোমাকে আসতে যেতে হবে – পথের বাঁকে বাঁকে ডালি সাজিয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে – অনন্ত জীবনপথে কতবার তুমি তাদের পাবে, আবার পেছনে ফেলে চলে যাবে – আবার পাবে।…চরণ বৈ মধু বিন্দতি।…জীবনে অনন্তকে চিনতে হবে…গতির মধ্যে দিয়ে অনন্তের স্বরূপ চোখে ধরা দেবে। হে জীবন পথের পথিক পথের ধারে ঘুমিয়ে পড়ো না।…
…নির্জন গ্রহের নির্জন পর্বতে যুগ যুগ অক্ষয় তরুণ দেবতার কথা মনে পড়ে…সম্মুখে তার বিশাল অজানা বিশ্ব। দেবতা হয়েও সব জানে নি।…
…অশান্ত প্রাণ-পাখী আর মানে না – সব দিকের বন্ধনহীন, নিঃসঙ্গ, উদাস, অনন্ত, অকুল নীলব্যোমে মুক্তপক্ষে ওড়বার জন্যে ছটফট করছে – উড়তে চায় উড়তে চায় – পরিচিত বহুবারদৃষ্ট একঘেয়ে গতানুগতিক গণ্ডীর মধ্যে আর নয়,…হয়তো দূরে দূরে কত শ্যামসুন্দর অজানা দেশ সীমা – তুহিন শীতল ব্যোমপথে দেবলোকের মেরু পর্বত। আলোর পক্ষে ভর দিয়ে শুধু যেখানে পাওয়া যায়, অন্যভাবে নয়।…জীবনটাকে বড় করে উপভোগ করো, খাঁচার পাখীর মতো থেকো না।…
____________
‘স্মৃতির রেখা’ (১৯৪১) থেকে, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
সমস্ত দিন আপিসের হাড়ভাঙা খাটুনির পরে গড়ের মাঠে ফোর্টের কাছ ঘেঁষিয়া বসিয়া ছিলাম।
নিকটেই একটা বাদামগাছ, চুপ করিয়া খানিকটা বসিয়া বাদামগাছের সামনে ফোর্টের পরিখার ঢেউখেলানো জমিটা দেখিয়া হঠাৎ মনে হইল যেন লবটুলিয়ার উত্তর সীমানায় সরস্বতী কুণ্ডীর ধারে সন্ধ্যাবেলায় বসিয়া আছি। পরক্ষণেই পলাশী গেটের পথে মোটর হর্নের আওয়াজে সে ভ্রম ঘুচিল।
অনেক দিনের কথা হইলেও কালকার বলিয়া মনে হয়।
দক্ষিণ দেশে ধরমপুর পরগণার ফসল মারা যাওয়াতে ধাতুরিয়া নাচিয়া গাহিয়া পেটের ভাত জুটাইতে আসিয়াছিল, লবটুলিয়া অঞ্চলের জনবিরল বন্য গ্রামগুলিতে চীনা ঘাসের দানা ভাজা আর আখের গুড় খাইতে পাইয়া কি খুশির হাসি দেখিয়াছিলাম তার মুখে! কোঁকড়া কোঁকড়া চুল, ডাগর চোখ, একটু মেয়েলি ধরনের ভাবভঙ্গি, বছর তের-চৌদ্দ বয়সের সুশ্রী ছেলেটি; সংসারে বাপ নাই, মা নাই, কেহ কোথাও নাই, তাই সেই অল্প বয়সেই তাহাকে নিজের চেষ্টা নিজেকেই দেখিতে হয়…সংসারের স্রোতে কোথায় ভাসিয়া গেল আবার। মনে পড়ে সরল মহাজন ধাওতাল সাহুকে। আমার খড়ের বাংলোর কোণটাতে বসিয়া সে বড় বড় সুপারি জাঁতি দিয়া কাটিতেছে। গভীর জঙ্গলের মধ্যে ছোট কুঁড়েঘরের ধারে বসিয়া দরিদ্র ব্রাহ্মণ রাজু পাঁড়ে তিনটি মহিষ চরাইতেছে এবং আপন মনে গাহিতেছে- ‘দয়া হোই জী-’
মহালিখারূপের পাহাড়ের পাদদেশে বিশাল বনপ্রান্তরে বসন্ত নামিয়াছে, লবটুলিয়া বইহারের সর্বত্র হলুদ রঙের গোলগোলি ফুলের মেলা, দ্বিপ্রহরে তাম্রাভ রৌদ্রদগ্ধ দিগন্ত বালির ঝড়ে ঝাপসা, রাত্রে দূরে মহালিখারূপের পাহাড়ে আগুনের মালা, শালবনে আগুন দিয়াছে। কত অতিদরিদ্র বালকবালিকা, নরনারী কত দুর্দান্ত প্রকৃতির মহাজন, গায়ক, কাঠুরে, ভিখারির বিচিত্র জীবনযাত্রার সঙ্গে পরিচয় হইয়াছিল। অন্ধকার প্রান্তরে খড়ের বাংলোয় বসিয়া বসিয়া বন্য শিকারির মুখে অদ্ভুত গল্প শুনিতাম, মোহনপুরা রিজার্ভ ফরেস্টের মধ্যে গভীর রাত্রিতে বন্য মহিষ শিকার করিতে গিয়া ডালপালা-ঢাকা গর্তের ধারে বিরাটকায় বন্য মহিষের দেবতাকে তারা দেখিয়াছিল।
ইহাদের কথাই বলিব। জগতের যে পথে সভ্য মানুষের চলাচল কম, কত অদ্ভুত জীবনধারার স্রোত আপন মনে উপলবিকীর্ণ অজানা নদীখাত দিয়া ঝিরঝির করিয়া বহিয়া চলে সে পথে, তাহাদের সহিত পরিচয়ের স্মৃতি আজও ভুলিতে পারি নাই।
কিন্তু আমার এ স্মৃতি আনন্দের নয়, দুঃখের। এই স্বচ্ছন্দ প্রকৃতির লীলাভূমি আমার হাতেই বিনষ্ট হইয়াছিল, বনের দেবতারা সেজন্য আমায় কখনো ক্ষমা করিবেন না জানি। নিজের অপরাধের কথা নিজের মুখে বলিলে অপরাধের ভার শুনিয়াছি লঘু হইয়া যায়।
তাই এই কাহিনীর অবতারণা।…
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ: অক্টোবর ১১, ২০২০
রেটিং করুনঃ ,