এই করোনাকালেও সরকার মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের বেশ উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য ঠিক করেছে। সরকার হয়তো মনে করছে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে, প্রবৃদ্ধি হবে ৮ দশমিক ২ শতাংশ। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস বলছে ভিন্ন কথা। তাদের পূর্বাভাস সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যের ধারেকাছেও নেই। তারা বলছে, চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ১ দশমিক ৬ শতাংশ।
বিশ্বব্যাংকের যুক্তি হলো, করোনার কারণে দেশে কর্মসংস্থান, রপ্তানি, প্রবাসী আয়সহ বিভিন্ন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত ‘সাউথ এশিয়া ইকোনমিক ফোকাস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি নিয়ে পূর্বাভাস দেয় বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, করোনার পরিস্থিতিতে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের গতি বেশ শ্লথ। তবে কিছুটা সুখবর হলো, আগামী ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ হতে পারে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক।
প্রতিবেদনটি প্রকাশ উপলক্ষে গত বুধবার টেলিফোনে এক সংবাদ সম্মেলন করেন বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক ভাইস প্রেসিডেন্ট হার্টউইগ শিফার ও দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ হ্যান্স টিমার। এতে দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকেরা অংশ নেন।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বেশ শ্লথগতিতে হচ্ছে। যেমন তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমেছে। ইউরোপ ও আমেরিকার যেসব দেশে পোশাক রপ্তানি হয়, তাদের অর্থনীতিতে মন্দাভাব আছে।
বিশ্বব্যাংকের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক প্রধান অর্থনীতিবিদ হ্যান্স টিমার
প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছরে দক্ষিণ এশিয়ার গড় প্রবৃদ্ধি মাইনাস ৭ দশমিক ৭ শতাংশ হতে পারে। এর মধ্যে ভারতের প্রবৃদ্ধি মাইনাস ৯ দশমিক ৬ শতাংশ হতে পারে। আট দেশের মধ্যে ভারতসহ পাঁচ দেশেই প্রবৃদ্ধি নেতিবাচক হতে পারে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশ সরকারের জিডিপি লক্ষ্যের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে কেন এত ফারাক? জবাবে হ্যান্স টিমার বলেন, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার বেশ শ্লথগতিতে হচ্ছে। যেমন তৈরি পোশাকের রপ্তানি কমেছে। ইউরোপ ও আমেরিকার যেসব দেশে পোশাক রপ্তানি হয়, তাদের অর্থনীতিতে মন্দাভাব আছে। এ ছাড়া করোনার কারণে দেশের অনানুষ্ঠানিক খাতের বিপুলসংখ্যক লোকের আয় কমেছে। কাজ হারিয়ে অনেকে গ্রামে ফিরে গেছেন। তাই ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন বেশ কঠিন হবে।
অর্থনীতিতে করোনার কী ধরনের প্রভাব পড়েছে, তা তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়, গত মার্চ মাসে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর দেশের নিম্ন আয়ের মানুষ কাজ হারিয়েছেন, অনেকের আয়রোজগার কমেছে। রপ্তানিও কমেছে। এ ছাড়া প্রবাসী আয় হ্রাসের কারণে খরচ করার প্রবণতা কমেছে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ নিয়েও অনিশ্চয়তা আছে। চলতি অর্থবছরের শুরুর দিকে বন্যায় কৃষি উৎপাদনও ব্যাহত হয়েছে।
দারিদ্র্য বেড়ে দ্বিগুণ
করোনায় অর্থনীতিতে নানামুখী প্রভাব পড়ায় দারিদ্র্য বেড়েছে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, করোনার আগে দেশের ১২ দশমিক ৬ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করত। যাঁরা দৈনিক ১ ডলার ৯০ সেন্ট আয় করতে পারেন না, তাঁরাই দরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত হন। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, করোনায় কর্মজীবী মানুষের আয় কমায় দারিদ্র্য বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। গত জুন মাস শেষে এই হার ২১ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ
বিশ্বব্যাংক বলছে, করোনার কারণে কর খাতের সংস্কার বিলম্বিত হলে কিংবা বড় প্রকল্পগুলোর খরচ বাড়লে আর্থিক খাতে ঝুঁকি আরও বাড়তে পারে। বাজেট ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যাংক খাত থেকে অর্থ নেওয়া হলে তা সুদের হারে চাপ সৃষ্টি করবে এবং বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করবে। খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়া ঠেকিয়ে ঋণের ঝুঁকি কমাতে ফলপ্রসূ আলোচনা দরকার।
বহির্বাণিজ্য খাতেও চাপ বাড়বে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি বলছে, বিদেশি ক্রেতাদের কাছে তৈরি পোশাকের চাহিদা স্বাভাবিক হচ্ছে। কিন্তু তৈরি পোশাক রপ্তানিপ্রবাহ টেকসই নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমায় মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশি শ্রমিকদের চাহিদা কমতে পারে। এ কারণে প্রবাসী আয়ে প্রভাব পড়বে।
করোনার টিকা
সংবাদ সম্মেলনে করোনার ভ্যাকসিন (টিকা) নিয়েও আলোচনা হয়। হার্টউইগ সিফার বলেন, করোনার ভ্যাকসিন পাওয়া এ অঞ্চলের দেশগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। বর্তমানে বিভিন্ন দেশে ভ্যাকসিন বানানোর চেষ্টা চলছে। এই ভ্যাকসিন কেনার সামর্থ্য এবং তা জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মতো প্রশাসনিক ব্যবস্থা তৈরি করা এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
অর্থনীতি সচল হলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। রপ্তানি গন্তব্য ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ লাগার বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। এতে সেসব দেশে চাহিদা কমবে।
সিপিডির বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান
এদিকে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে সার্বিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় আট দেশের মধ্যে ভারতসহ পাঁচ দেশের নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হতে পারে। গড় প্রবৃদ্ধি মাইনাস ৭ দশমিক ৭ শতাংশ হতে পারে বলে মনে করছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি আরও বলেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অর্থবছর একেক সময় ধরে হওয়ায় জিডিপিতে করোনার প্রভাবও একেক রকম হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে, ভারতের অর্থবছর শুরু হয় এপ্রিল মাসে, শেষ হয় মার্চ মাসে। ভারতে করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয় মার্চ-এপ্রিল মাসে। ফলে গত দুই প্রান্তিক ধরেই করোনার প্রভাব রয়েছে ভারতীয় অর্থনীতিতে। অন্যদিকে বাংলাদেশের অর্থবছর জুলাই-জুন সময় ধরে। করোনার প্রভাব দুই অর্থবছরে ভাগ হয়ে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, অর্থনীতি সচল হলেও অনিশ্চয়তা কাটেনি। রপ্তানি গন্তব্য ইউরোপ ও আমেরিকায় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ লাগার বার্তা পাওয়া যাচ্ছে। এতে সেসব দেশে চাহিদা কমবে। বেসরকারি বিনিয়োগও তেমন হচ্ছে না। উৎপাদন খাতে চাঞ্চল্য নেই। অভ্যন্তরীণ চাহিদাও কমেছে। এসব কারণে বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসটি বাস্তবসম্মত।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: অক্টোবর ০৯, ২০২০
রেটিং করুনঃ ,