(গল্পটি শুধুমাত্র রোমান মিথলজিতে পাওয়া যাওয়ায় সবজায়গায় রোমান নাম ব্যবহার করা হয়েছে, তাই দেবী আফ্রোদিতি এখানে দেবী ভেনাস। )
সাইপ্রাস দ্বীপে এমাথাস নামের এক শহর ছিলো, সেটা অনেক অনেক বছর আগেকার কাহিনী। অলিম্পিয়ান দেবতারা তখন পৃথিবী শাসন করছেন দোর্দন্ড প্রতাপে। এই দোর্দন্ড প্রতাপের মাঝেও কিছু কিছু মানব-মানবী সময়ে সময়ে বিদ্রোহী হয়ে উঠে, অমান্য করে দেবতাদের আধিপত্যকে। এমনই এক ঘটনা ঘটেছিলো এমাথাসে।
সুন্দরী এবং ভালোবাসার দেবী ভেনাস সাগরের ফেনা থেকে জন্ম নিয়ে সাইপ্রাসেই প্রথম স্বাগত হয়েছিলেন। তাই সাইপ্রাস ছিলো দেবীর পবিত্র জায়গা আর সাইপ্রাসের মানুষও দেবীকে খুব মান্য করতেন, কিন্তু হঠাৎ বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন কয়েকজন সুন্দরী তরুনী। এমাথাসে প্রোপেওটাস নামে এক ব্যক্তি ছিলেন, তার কয়েকজন সুন্দরী মেয়ে ছিলেন। তারা সংখ্যায় কতজন ছিলেন সেটা জানা যায়নি, কিন্তু তাদেরকে একসাথে বলা হতো প্রোপেওটিডেস। তারা এক সময় অহংকারী হয়ে উঠলেন, অমান্য করলেন দেবী ভেনাসকে।
ভেনাস সহজে হার মানার পাত্রী নয়!
ভেনাসের কৌশলের কারণে প্রোপেওটিডেস বোনেরা বিশ্বের প্রথম রুপোপজীবনী হলেন, তারা লজ্জার অনুভূতি হারালেন, হারালেন লজ্জা পেলে গালে গোলাপী আভার ছটা, এবং ধীরে ধীরে একদিন তারা পরিণত হলেন চকমকি পাথরে! পিগম্যালিয়ন নামক যুবকের কাহিনী এরপর থেকেই শুরু।
পিগম্যালিয়ন বাস করতেন সাইপ্রাস দ্বীপেই। কেউ কেউ বলে থাকেন পিগম্যালিয়ন ছিলেন একজন বিখ্যাত ভাষ্কর, আবার কেউ কেউ বলেন পিগম্যালিয়ন ছিলেন সাইপ্রাসের রাজা। সে যাই হোক, তিনি প্রোপেওটিডেস বোনদের কাহিনী জানতেন, তাই নারীদের প্রতি ছিলো প্রবল বিতৃষ্ণা, ছিলেন ভয়ংকর নারী বিদ্বেষী। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন জীবনে কখনো বিয়ে করবেন না।
তাই অনেক সময় পেতেন ভাষ্কর্য বানানোর জন্য। একবার তিনি এক নারী মূর্তি বানানো শুরু করলেন। নারী বিদ্বেষী হয়েও কেনো নারী মূর্তি বানাচ্ছিলেন, সেটা এক রহস্য বটে! সম্ভবত তিনি চাইছিলেন নিখুঁত সৌন্দর্য্য নিয়েও নারীরা কতো কদর্য হয় সেটি জনগণকে দেখাতে।
তিনি দিনরাত নাওয়া খাওয়া ছেড়ে মূর্তি গড়তে লাগলেন। হাতির দাঁত কেটে কেটে এক অপরুপ সৃষ্টি তৈরী হতে লাগলো।
পিগম্যালিয়ন প্রতিদিনই নতুন নতুন সৌন্দর্য্যের পরিস্ফুটন ঘটাচ্ছিলেন মূর্তিটিতে। এক পর্যায়ে এমন হলো কোনো জীবন্ত নারীর সাথে মূর্তিটির তুলনা চলে না! একসময় মূর্তি তৈরী শেষ হলো। কিন্তু এ কি! পিগম্যালিয়নের মনোজগতেও এক বিশাল পরিবর্তন এলো। যে পিগম্যালিয়ন ছিলেন প্রবল নারী বিদ্বেষী, সেই পিগম্যালিয়ন নারীর প্রেমে পড়ে গেলেন! তাও আবার সত্যিকারের নারী নয়, নারী মূর্তির! পিগম্যালিয়ন এতো সুন্দরভাবে মূর্তিটি তৈরী করেছিলেন যে, এটিকে মূর্তির মতো লাগছিলো না, মনে হচ্ছিল কোনো জীবন্ত নারী!
পিগম্যালিয়ন নারী মূর্তি বানাচ্ছেন
পিগম্যালিয়ন এক অদ্ভুত কাজ করেন। তিনি প্রেমে উন্মাদ হয়ে মূর্তিটির ঠোঁটে চুমুর পর চুমু দিতে থাকেন, কিন্তু মূর্তিটি চুমু আর ফিরিয়ে দেয় না!তিনি হাত বুলান নারী মূর্তির মুখে, কিন্তু কোনো সাড়া দেয় না! পাগলের মতো আলিঙ্গন করেন মূর্তিটিকে,কিন্তু সেটি ঠান্ডা, জড় পিগম্যালিয়ন মূর্তিটিকে মূল্যবান পোশাক পরিয়ে অলংকার দিয়ে সাজিয়ে তুলেন, কিন্তু মূর্তিটির যেনো কোনো বিকার নেই! তিনি কিনে আনেন মহা মূল্যবান উপহার সামগ্রী, যেগুলো পেলে নারীরা খুশি হোন, কিন্তু মূর্তিটি খুশি হয় না! মূর্তিটিকে নিয়ে পিগম্যালিয়ন বিছানাতেও ঘুমাতে যান, কিন্তু এখানেও মূর্তিটি অনড়! ধীরে ধীরে পিগম্যালিয়ন অনুভব করতে পারলেন, যে নারী জাতিকে এতো ঘৃনা করতেন তিনি, আজ যেনো সেই নারী জাতিই প্রতিশোধ নিচ্ছে তার উপর।
পিগম্যালিয়ন নারী মূর্তিকে চুমু দিচ্ছেন
সাইপ্রাসে প্রতি বছর দেবী ভেনাসের ভোজ-দিবস পালিত হয় খুবই জাঁক জমকের সাথে। এই দিনে সাইপ্রাসের অধিবাসীরা সোনার জলে মোড়ানো শিংঅলা দুধ সাদা গাভীকে ভেনাসের উদ্দেশ্য বলী দেয়। দ্বীপজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ভেনাসের মন্দিরগুলো থেকে উঠতে থাকে পবিত্র ধূপের ধোঁয়া। প্রেমিক যুবক এবং প্রেমিকা যুবতী ভেনাসের মন্দিরে এসে প্রার্থনা করে প্রিয় মানুষকে পাওয়ার জন্য। তাই পিগম্যালিয়নও এলেন দেবী ভেনাসের মন্দিরে।
তিনি দেবীর কাছে প্রার্থনা করলেন, “হে দেবী! আমি যেনো আমার হাতে গড়া মূর্তির মতো কাউকে আমার স্ত্রী হিসেবে পাই”। ভেনাস পিগম্যালিয়নেরর কথা শুনলেন। তিনি মুচকি হাসলেন, বুঝতে পারলেন পিগম্যালিয়নের মনের কথা। তিনি উড়ে গেলেন পিগম্যালিয়নের ঘরে, সেই নারী মূর্তির সামনে। কিন্তু এ কি! এ যে ভেনাস! নিজের আদলে মূর্তি দেখে ভেনাস খুব খুশি হলেন, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন।
শিল্পীর তুলিতে পিগম্যালিয়ন এবং গ্যালাতিয়া (শিল্পী- স্যার এডওয়ার্ড বার্নে জোনস, ১৮৩৩-১৮৯৮)
অন্যদিকে মন্দিরের বেদীর হোমশিখাটি তিনবার ঊর্ধ্বে লাফিয়ে উঠল। কারো মনোবাসনা দেবী ভেনাস পূর্ণ করলে হোমশিখাটি এইভাবে তিনবার ঊর্ধ্বে লাফিয়ে উঠে। পিগম্যালিয়ন চমকে উঠলেন। এক বুক আশা নিয়ে দ্রুত তিনি ঘরে ফিরে এলেন। সেই নারী মূর্তির সামনে এসে দাঁড়ালেন, বরাবরের মতোই জড়িয়ে ধরলেন।
এবার চমকে উঠার পালা পিগম্যালিয়নের। তিনি ভুল দেখছেন না তো! নারী মূর্তিটি যেনো সাড়া দিচ্ছে পিগম্যালিয়নকে! পিগম্যালিয়ন চুমু দিলেন মূর্তিটিকে, তার কাছে মনে হলো চুমুর স্পর্শে সজীব হয়ে উঠেছে মূর্তিটির ঠোঁট! ধীরে ধীরে নারী মূর্তিটির পুরো শরীর হয়ে উঠলো নরম আর প্রাণবন্ত! পিগম্যালিয়ন বুঝতে পারলেন দেবী ভেনাসের কারণেই এই অসম্ভব সম্ভব হয়েছে। কৃতজ্ঞতায় আবদ্ধ হলেন পিগম্যালিয়ন।
নারী মূর্তিটি যেনো সাড়া দিচ্ছে পিগম্যালিয়নের আহবানে!
নারী মূর্তিটির নাম দেওয়া হয়েছিলো গ্যালাতিয়া। পিগম্যালিয়ন এবং গ্যালাতিয়ার বিয়েতে স্বয়ং দেবী ভেনাস উপস্থিত ছিলেন।
তাদের এক পুত্র হয়েছিলো, পাফোস, যার নামে ভেনাসের খুব প্রিয় একটি নগরের নামকরণ করা হয়। তাদের আরেক সন্তান হচ্ছেন- মেথারমে। মেথারমে বিয়ে করেছিলেন সাইপ্রাসের রাজা সিনাইরাসকে, এই সেই রাজা সিনাইরাস, যিনি নিজ কন্যা স্মার্নার সাথে অনিচ্ছাকৃতভাবে মিলিত হয়ে জন্ম দিয়েছিলেন অ্যাডোনিসকে।
গ্রীক মিথলজিতে পিগম্যালিয়নই প্রথম ব্যক্তি নয়, যার সৃষ্টি প্রান পেয়েছিলো! অনেকে বলে থাকেন, পিগম্যালিয়নের পূর্বে গ্রীসের সেরা স্থাপত্যবিদ ডিডেলাস এমন এক মূর্তি তৈরী করেছিলেন যা হাঁটত, নাচতো এবং মানুষের মতো অনুভব করতো! ডিডেলাস কে ছিলেন, জানা আছে? তিনিই সেই ব্যক্তি, যিনি তার ছেলে ইকারুসের সাথে মোমের তৈরী ডানায় সর্বপ্রথম আকাশে উড়েছিলেন।
পিগম্যালিয়ন এবং গ্যালাতিয়ার মিথটি গ্রীক মিথলজিতে খুবই জনপ্রিয় একটি মিথ হওয়া সত্ত্বেও অন্যান্য মিথের মতো এই মিথটির খুব বেশী সংস্করণ নেই, এর কারণ সম্ভবত শুধুমাত্র রোমান লেখক ওভিদ তার মেটামোরফোসিসেই এই মিথটি বর্ননা করেছেন।
পিগম্যালিয়ন এবং গ্যালাতিয়ার কাহিনী শেষ করবো ‘পিগম্যালিয়ন এফেক্ট’ দিয়ে। রবার্ট রোসেনথাল এবং লেনোরে জ্যাকোবসন ১৯৬৮ সালে বর্ননা করেন যে, একটি ক্লাসরুমে যদি শিক্ষক কয়েকজন ছাত্রের নিকট খুব বেশি আশা করেন, তাহলে ছাত্ররা সেইভাবেই ফলাফল করেন। অর্থাৎ, মানুষের উপর বেশি আশা করলে, সেই রকম ফলাফলও তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায়। তাদের কাছে কম আশা করলে, পাওয়াও যায় কম। পিগম্যালিয়ন খুব বেশি আশা করে, সেই খুব বেশিই পেয়েছেন- তাই এই ইফেক্টের নামকরন করা হয়েছে ‘পিগম্যালিয়ন এফেক্ট”।
এই সিরিজের আগের লেখাগুলোঃ
সৃষ্টিতত্ত্বঃ পর্ব-১ থেকে ৭: বিশ্ব-ব্রক্ষ্মান্ডের সৃষ্টি এবং ইউরেনাসের পতন থেকে ডিওক্যালিয়নের প্লাবন
দেবতাদের গল্পঃ এথেনা এবং আফ্রোদিতি পর্ব-৮ থেকে ১৩: জিউস, মেটিস এবং এথেনার জন্ম থেকে এনকেসিসের সাথে দূরন্ত প্রেম
লেখকঃ
এস এম নিয়াজ মাওলা
ছবি সূত্রঃ ইন্টারনেট
রেটিং করুনঃ ,