পদ্মপত্রে নীর
মুস্তাফা জামান আব্বাসী | আপডেট: ০০:০৬, অক্টোবর ২৬, ২০১৬
পাঠকদের কোন জিনিসটা আকর্ষণ করে তা অনেক লেখক চট করে অনুধাবন করতে পারেন, আবার অনেকে পারেন না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে দু-একজন ই-মেইলে আর্টিকেল পাঠান। উদ্দেশ্য, যাতে আমি পাঠ করি এবং পছন্দ হলে চেনা সম্পাদকের কাছে পাঠিয়ে সেগুলোর একটা সুবন্দোবস্ত করতে পারি। অথচ অবাক হই তাঁদের বিষয় চয়নের দারিদ্র্য দেখে। আমি একজন পাঠক। আমি পড়ব কি না, তা নির্ভর করছে তার বিষয় চয়নের ওপরে। একটি পদ্মপত্রের ওপরে শিশির কণা টলমল করছে। এটি আমার নিজের চোখে দেখা। যেকোনো হালকা বাতাসেই এর পতন হবে। এটিকে মনের এক কোনায় সযত্নে বেঁধে রেখেছি। যদি এর ওপরেই লিখি, কেউ ফেলে দেবে না। সামান্য জিনিসও পাঠককে আকৃষ্ট করে বৈকি।
পদ্মপত্র নীরের কথাটা কতবার জেনেছি। আমাদের ক্ষুদ্র জীবনের সঙ্গে কত মিলে যায় তা। এখনই আছি, আবার এখনই নাই। যখন থাকব না, তখন কেউ আর আমাকে খুঁজে পাবে না। পদ্মপত্র কিছুদিন থাকবে। তারপর সেও মিলিয়ে যাবে। এই স্থিতিটুকু জীবনের সম্বল। যুক্তরাষ্ট্রের দুজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর সর্বশেষ বিতর্ক-যুদ্ধ দেখতে দেখতে কত কথাই মনে হলো। এই হিলারিই ওবামার সঙ্গে তিনটি বাগ্যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। তখন হিলারিকে যতখানি উত্সাহী ও বাকপটু বলে মনে হয়েছিল, এবার যেন তার চেয়ে বেশি। সবচেয়ে ভালো লাগল যখন বিরুদ্ধপক্ষের কঠোর সমালোচনার জবাবে তিনি উপহার দিলেন শুধু একটি হাসি। নির্মল হাসি, বানানো নয়। এটি আয়ত্ত করতেই জীবন চলে যায়। পদ্মপত্রে যে নীর জমা পড়েছে তা তো ঝরে যাবেই, কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে ব্যালেন্স করে কতটুকু টিকে থাকা যায়, সেটাই শিক্ষা।
আমাদের জীবনও নিষ্ঠুর আক্রমণের ঘাত-প্রতিঘাতে সদা বিধ্বস্ত। এটুকু বেঁচে থাকা, তা নিয়ে সমস্যা। কেউ বাঁচতে দেবে না। আমার বাঁচারটা আমাকেই দেখতে হবে। সে শিক্ষা দেবে প্রকৃতি। যে যোগ্য, সে-ই বেঁচে থাকার অধিকার সংরক্ষণ করে। ঝরা পাতা ঝরে পড়বেই। যখন বড়শিতে মাছ মারতে বসতাম, পুরো মনোযোগটা থাকে বড়শির ফাতনার দিকে, কখন সেটি ডুবে যাবে এবং হ্যাঁচকা টানে মাছটিকে ডাঙায় তুলে আনব। এটাই আমার সক্ষমতার প্রমাণ দেবে। ওই সময় যদি ঘুমিয়ে পড়ি অথবা মোবাইলে কাউকে টেক্সট মেসেজ পাঠাই, তাহলে মাছ বড়শি নিয়ে পালিয়ে যাবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প সফল ব্যবসায়ী হতে পারেন কিন্তু সফল রাজনীতিক হতে হলে প্রয়োজন তাঁদের দর্শকদের হৃদয় জয় করা, ক্ষণিকের হাততালি বিভ্রান্তিকর হতে পারে। এখানে বড়শির ফাতনা হচ্ছে ওই জনগণ।
যাঁরা দীর্ঘকাল দেশ শাসন করেছেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা কত করুণ হতে পারে তা ইউরোপের ইতিহাসে পড়েছি। হিটলার, মুসোলিনি ভেবেছিলেন সব যুদ্ধেই তাঁরা হবেন জয়ী। তাঁদের সব দম্ভের পরাজয় এই ইঙ্গিতই বহন করে যে পৃথিবীতে ‘ন্যাচারাল জাস্টিস’ বলে একটি কথা আছে। সেটাই শেষ সত্য।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সৈকতে ছোট-বড় বড়শি নিয়ে যাঁরা মাছ ধরতে আসেন, তাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার ভালো লাগে। আমার তো আর সরঞ্জাম নেই। তাই তাকিয়ে থাকি কখন তাঁরা একটি-দুটি মাছ সংগ্রহ করবেন। গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁরা একেকটি মাছ পটাপট বড়শিতে গেঁথে নিচ্ছেন। তারপর কি সেগুলো বালতিতে সংগ্রহ করে বাসায় গিয়ে গিন্নিকে বলবেন, এই দেখো কত মাছ এনেছি। এবার এগুলো কোটো, খুব ভালো যেন রান্না হয়? না, তাঁরা তা করেননি। মাছগুলো ধরার পর খানিকক্ষণ স্পর্শ করে আবার নিক্ষেপ করলেন মুক্ত সমুদ্রে, যেন তারা তাদের মা-বাবা, ভাইবোনের কাছে ফিরে যেতে পারে। বেশ কয়েকটি সৈকতে এই খেলা দেখে আমি অসম্ভব পুলকিত হই, যেন মাছ ধরা নয়, মাছ ধরার খেলা।
পৃথিবীতে পাঠিয়ে মানুষের ভালো-মন্দ সবই পর্যবেক্ষণ করছেন সৃষ্টিকর্তা। কখনো আনন্দে, কখনো বিষাদে আমি পতিত, কখনো এই খেলাঘরে আমাকে উত্তরণ করছেন, কখনোবা ডুবিয়ে দিচ্ছেন, সব প্রভুর খেলার অন্তর্ভুক্ত। এবার বার্নস অ্যান্ড নোবেলসের লাইব্রেরিতে প্রবেশ। মাছের ভক্ত যাঁরা অনেক বড় বড় বই সংগ্রহ করে তাঁরা দেখছেন মাছ ধরার দৃশ্য। ছবিতে যেন প্রতিটি মাছ জীবন্ত হয়ে ধরা দিচ্ছে। পাঠক যেন চিনতে পারছেন প্রতিটি মাছ এবং দেখছেন মাছ ধরার খেলা। যদিও তিনি নদ-নদী, সমুদ্র থেকে অনেক দূরে।
লেখক তাহলে কী করেন? তাঁর সামনে বিরাট মানব-সমুদ্রের মেলা। তার মধ্যে যাঁকে খুশি তিনি চয়ন করছেন। তাঁর জীবন, যৌবন, ছোট ছোট অক্ষরের মধ্যে তা স্থান করে নিচ্ছে। শত শত পাঠক তার মধ্যে অবগাহন করে খুঁজে পেল সেই সব মুহূর্তগুলো, হয়তো শত বছর ব্যবধানে। এদিক থেকে আমার মনে হয়েছে সবচেয়ে আনন্দ উপকরণ লেখকদের জীবনে স্পর্শিত সেই আনন্দের মুহূর্তগুলো। এটাই লেখকদের সবচেয়ে বড় পাওয়া। যখন আগের শতাব্দীর লেখকদের বই নিয়ে পড়তে বসি, আমি এত আনন্দ পাই যে, যা বলার নয়। সেই সব চরিত্রের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করি। লেখক তাঁদের বাঁচিয়ে রেখেছেন। সদ্য প্রয়াত সৈয়দ শামসুল হক একদিন আমাকে বললেন, ‘এই আব্বাসী, তোমার কাছে তো অনেক সুন্দর সুন্দর ব্যাগ। আমাকে দাও না দু-একটি।’ সঙ্গে সঙ্গে দিলাম। উনি বলতেন, ‘জানো, সারা দিন লিখি। ওটাই আমার আনন্দ।’ তাঁকে আজ মনে পড়ছে।
সংবাদপত্র প্রতিদিনের খাদ্যসামগ্রীর মতো। সকালেই নতুন, বিকেলে বাসি। পরের দিন পুরোনো ভাতের মতো ফেলে দেওয়া। সংগ্রহ করে রাখা যায় না। যাঁরা জীবনকে ভালোবাসেন, তাঁদের লেখা শত বছর পরেও পুরোনো হয় না। তাই যে পদ্মপত্রের দিকে তাকিয়ে আছে তার ওই তাকানোটা হতে হবে মূল্যবান। সে ওর মধ্যেই অনেক কিছু খুঁজে পাবে।
রেটিং করুনঃ ,