আজ ১১ই জ্যৈষ্ঠ,আমাদের জাতীয় কবির জয়ন্তী, আমাদের প্রতি ক্ষণের, প্রতি সেকেন্ডের কবিকে আমাদের সকল সময়ের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
আমাদের জাতীয় কবি- কখনো বিদ্রোহী কবি, কখনো সাম্যের কবি, কখনো আমাদের সোনা মনিদের কবি, কখনো সুরের কবি, আমাদের প্রিয় কবি নানান রূপে আমাদের সামনে ধরা দিয়েছেন প্রতি মূর্হুতে।
নজরুল প্রেমী বা বাংলার সকলে জানেন তিনি কত বড় প্রেমের কবি ছিলেন ! কাজী নজরুলের উপর আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা অনেক, আমার পক্ষ্যে কাজী নজরুল ইসলাম কত বড় প্রেমের কবি, কত বড় প্রেমিক ছিলেন তার চিত্র আঁকা সম্ভব নয়, সঠিক চিত্র আঁকতে চাইলে চাই নজরুলের উপর গবেষনা।
নার্গিস, একটি ফার্সি শব্দ। ফার্সি ভাষায় ও ইরানের বাগানের ফুল। নার্গিস ফুল। নার্গিস, কাজী নজরুলের জীবনে একটি প্রেমের ফুল হয়ে এসেছিল, প্রেমের বিরাট এক দর্পিত দাবি নিয়ে। নজরুলের গানে, কবিতায়, লেখার পাতায় পাতায় নজরুল দিয়ে গেছেন তাঁর অমর প্রেমের স্বাক্ষী
নার্গিস, আমাদের জাতীয় কবির জীবনে এসেছিল ক্ষণ কালের জন্যে কিন্তু আজ তা চির কালের জন্যে, অনন্ত কালের জন্যে। নার্গিস নজরুলের জীবনে একটি বেদনার ফুল হয়ে, কষ্টের ফুলের নাম হয়ে এসেছিলেন, থেকেছেন। থাকবেন। নার্গিস ফুল কবিকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন এক মহান প্রেমিক হিসাবে। নানান গানে কবিতায় তা জীবন্ত হয়ে আছেন।
কত গানে, কত কবিতায়, কত লেখায় কবি নার্গিসকে এক দর্পিত প্রেম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, অনেক গবেষক তা আজ তাঁদের গবেষণার বিষয়ে অন্তর্ভূক্ত করেছেন।
নার্গিস ফুল বা নার্গিস বা নার্গিসের মূল নাম ” নার্গিস আসার খানম।”
কবি অনেক লেখায় নার্গিসকে উল্ল্যেখ করেছেন পল্লী বালা বা পল্লী বালিকা হিসাবে।, তাঁকেই উপলক্ষ্য করে লিখেছেন
” ‘‘… তুমি কি বুঝিবে, বালা,
যে আঘাত করে বুকের প্রিয়ারে, তার বুকে কত জ্বালা!
ব্যথা যে দিয়াছে– সম্মুখে ভাসে নিষ্ঠুর তার কায়া,
দেখিলে না তব পশ্চাতে তারি অশ্রু-কাতর ছায়া!…
অপরাধ শুধু মনে আজে তার, মনে নাই কিছু আর?
মনে নাই, তুমি দলেছো দু’পায়ে কবে কার ফুলহার?
কাঁদায়ে কাঁদিয়া সে রচেছে তার অশ্রুর গড়্খাই,
পার হতে তুমি পারিলে না তাহা, সে-ই অপরাধী তাই?
সে-ই ভালো, তুমি চিরসুখী হও, একা সে-ই অপরাধী!
কি হবে জানিয়া, কেন পথে পথে মরুচারী ফেরে কাঁদি’!…’’”
কবির সাথে ১৯২১ সালে নার্গিসের প্রথম দেখা হয়।
সংক্ষিপ্ত ভাবে লিখলে বলা যায় ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বন্ধু আলী আকবর খানের সঙ্গে কুমিল্লার দৌলতপুরে আসেন। সেখানে অবস্থানকালে কবি তাঁর বন্ধুর বোনের মেয়ে সৈয়দা খাতুনের সঙ্গে পরিচিত হন। সেই পরিচয়ের সূত্র ধরে তাঁদের মধ্যে ভালোলাগা, প্রেম বাসা বাঁধে। কাজী নজরুল, সৈয়দা খাতুনের নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘নার্গিস আসার খানম’। বিভিন্ন লেখা থেকে পাওয়া যায় ওই বছরের ১৭ জুন তাঁদের বিয়ে হয় (বাংলা ৩ আষাঢ়, ১৩২৭)। কিন্তু বিপত্তি ঘটে বিয়ের রাতে থেকেই নানান কারণে। বিয়ের শর্তে।
নজরুল কাউকে কিছু না বলে কুমিল্লা শহরে চলে আসেন। এরপর আর কখনো নার্গিসের সঙ্গে কবির দেখা হয়নি কিংবা কবি দেখা করেন নি। তবে একবার হয়তোদেখা হয়েছিল ১৫ বছর পরে । ওই বিয়ের তিন বছরের মধ্যে কবি ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ এপ্রিল কুমিল্লা শহরের প্রমীলা দেবীকে বিয়ে করেন।
গানে, কবিতায়, লেখায় নার্গিস আসার খানম আজও জীবন্ত। আমাদের গানে, কবিতায় লেখায় নার্গিস আসার খানম। অনেক পরে নার্গিসও বিয়ে করেন আর এক কবিকে।
হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া কবির কিছু গানে, কবিতায়, লেখায় নার্গিস আসার খানমকে নিয়ে লেখা তুলে ধরা হলো পাঠকদের জন্যে।
দৌলতপুরে নার্গিস ফুলকে নিয়ে লিখেছিলেন
” রেশমী চুরির ঝিঞ্জিনীতে
রিমঝিমিয়ে মরম কথা
পথের মাঝে চমকে কে গো
থমকে যায় ঐ শরম লতা। ”
কবি অভিমান করে লিখেছেন।
” আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেবনা ভুলিতে
আমি বাতাস হইয়া জড়াইব কেশ, বেনী যাবে যবে খুলিতে।
তবু আমারে দেবনা ভুলিতে।।
তোমার সুরের নেশায় যখন, ঝিমাবে আকাশ কাঁদিবে পবন
রোদন হইয়া আসিব তখন তোমার বক্ষে দুলিতে ।
তবু আমারে দেবনা ভুলিতে।।”
আবারো অভিমানের সুরে লিখেছেন।
” ভীরু এ মনের কলি
ফোটালে না কেন ফোটালে না-
জয় করে কেন নিলে না আমারে,
কেন তুমি গেলে চলি।।
ভাঙ্গিয়া দিলে না কেন মোর ভয়,
কেন ফিরে গেলে শুনি অনুনয়;
কেন সে বেদনা বুঝিতে পার না
মুখে যাহা নাহি বলি।।”
” মোরে ভালোবাসায় ভুলিও না
পাওয়ার আশায় ভুলিও
মোরে আদর দিয়ে তুলিও না
আঘাত দিয়ে তুলিও।।
হে প্রিয় মোর একি মোহ
এ প্রাণ শুধু চায় বিরহ
তুমি কঠিন সুরে বেঁধে আমায়
সুরের লহর দুলিও।।”
নার্গিসকে নার্গিস ফুল উল্ল্যেখ করে লিখেছেন
” ………….
মজনু! তোমার কাঁদন শুনিয়া মরু-নদী পর্বতে
বন্দিনী আজ ভেঙেছে পিঞ্জর বাহির হয়েছে পথে।
আজি দখিনা বাতাস বহে অনুকূল,
ফুটেছে গোলাপ নার্গিস ফুল,”
আবারো নার্গিস ফুল উল্ল্যেখ করে লিখেছেন
“নূরজাহান! নূরজাহান!
সিন্ধু নদীতে ভেসে,
এলে মেঘলামতীর দেশে
ইরানী গুলিস্তান।।
নার্গিস লালা গোলাপ আঙ্গুর-লতা
শিরিঁ ফরহাঁদ সিরাজের উপকথা”
কবির চির বালিকাকে লিখেছেন-
” মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী,
দেব খোঁপায় তারার ফুল।
কর্ণে দোলাব তৃতীয়া তিথির,
চৈতী চাঁদের দুল।।
কন্ঠে তোমার পরাবো বালিকা,
হংস-সারির দুলানো মালিকা।”
প্রেমের কবি অভিমান করে লিখেছেন
” আমার গানের মালা
আমি করব কারে দান।
মালার ফুলে জড়িয়ে আছে
করুণ অভিমান।”
নার্গিস আবার আসবেন সে অনেক আশা নিয়ে কবি লিখেছেন তার গানে
……………..আজো আসিলে না হায়,
মোর অশ্রুর লিপি বনের বিহগী
দিকে দিকে লয়ে যায়,
তোমায়ে খুঁজে না পায়। ”
কবি আক্ষেপ করে লিখেছেন
” জনম জনম তব তরে কাদিবো..
জনম জনম তব তরে কাদিবো ।
যতই হানিবে হেলা..ততই সাধিবো
জনম জনম তব তরে কাদিবো ।”
ভালোবাসায় হতাশ হয়ে কবি তাঁর গানে লিখেছেন
” আমায় নহে গো ভালোবাসো শুধু
ভালোবাসো মোর গান
বনের পাখিরে কে চিনে রাখে
গান হলে অবসান ।
চাঁদেরে কে চায় জোসনা সবাই যাচে
গীত শেষে বীণা পড়ে থাকে ধূলি মাঝে
তুমি বুঝিবে না
আলো দিতে কত পোড়ে
কত প্রদীপের প্রাণ ।”
কবি অভিশাপ দিয়ে লিখেছেন-
” যেদিন আমি হারিয়ে যাব, বুঝবে সেদিন বুঝবে অস্তপারের সন্ধ্যাতারায় আমার খবর পুঁছবে বুঝবে সেদিন বুঝবে।
ছবি আমার বুকে বেধে পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে ফিরবে মরু কানন গিরি সাগর আকাশ বাতাশ চিরি
সেদিন আমায় খুজবে বুঝবে সেদিন বুঝবে।”
এমনি অনেক গান কবিতায় নার্গিস হয়ে আছেন অমর।
জেল খানায় বসে কবি লিখেন এক অমর চিঠি, যেখানে তিনি উল্ল্যেখ করেছিলেন তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না। হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া চিঠির কিছুটা অংশ উল্ল্যেখ করা হলো।
” জ্বর হয়েছিল, বহু সাধনার পর আমার তৃষিত দুটি কর তার শুভ্র সুন্দর ললাট স্পর্শ করতে পেরেছিল; তার সেই তপ্ত ললাটের স্পর্শ যেন আজও অনুভব করতে পারি। সে কি চেয়ে দেখেছিল? আমার চোখে ছিল জল, হাতে সেবা করার আকুল স্পৃহা, অন্তরে শ্রী বিধাতার চরণে তার আরোগ্য লাভের জন্য করুণ……………। ”
নার্গিস ফুল। নার্গিস। নার্গিস আসার খানম।
পরে কবি আজিজুল হাকিমের সাথে নার্গিসের বিয়ে সম্পন্ন হয়। অনেক পরে, সঠিক দিন ক্ষণ মনে নেই, খুব সম্ভবত আশির দশের শেষের দিকে একটি জাতীয় পত্রিকায় পড়ে ছিলাম লন্ডনে আমাদের জাতীয় কবির গানের কথার, কবিতার কথার নানান লেখার নার্গিস আসার খানম শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
থেকে গেলেন, থেকে যাবেন অনন্ত কাল ধরে আমাদের জাতীয় কবির লেখায়, সুরে।
” আমি চিরতরে দূরে চলে যাব, তবু আমারে দেবনা ভুলিতে
আমি বাতাস হইয়া জড়াইব কেশ, বেনী যাবে যবে খুলিতে।
তবু আমারে দেবনা ভুলিতে।”
তারিখ: মে ২৫, ২০১৪
নানান রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নজরুল জন্ম বার্ষিকী পালিত হয়েছে একই ভাবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে আজ শনিবার বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন উদ্যাপন করা হচ্ছে। নজরুলজয়ন্তীতে বর্ধমানের আসানসোল শহরে কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজন করা হয়েছে বিশেষ সমাবর্তন উৎসবের। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেওয়া হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানজনক ডি–লিট।
জন্মদিনে বিদ্রোহী কবির জন্মভিটা বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রামে শুরু হয়েছে নজরুল মেলা। আজ সকালেই কলকাতা থেকে আসানসোল এসে শেখ হাসিনা যোগ দেবেন কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত বিশেষ সমাবর্তন উৎসবে। উৎসব শুরু হবে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে। দুপুর সোয়া ১২টার দিকে শেখ হাসিনাকে সম্মানজনক ডি–লিট দেওয়া হবে। ডি–লিট দেবেন কাজী নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য ও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠি। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সাধন চক্রবর্তী।
শেখ হাসিনা ১৯ বছর আগে প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ির আমলে নজরুল জন্মশতবর্ষ উৎসবে যোগ দিতে বর্ধমানের আসানসোলের চুরুলিয়ায় গিয়েছিলেন।
তারিখ: মে ২৬, ২০১৮
রেটিং করুনঃ ,