এখন মধ্য হেমন্ত, বাংলা মাসের কার্তিক ও অগ্রহায়ণ এই দুই মাস মিলে আমাদের হেমন্ত কাল, সেই হিসাবে আজ পয়লা অগ্রহায়ণ, আর গতকাল ছিল কার্তিকের শেষ দিন। হেমন্ত এর প্রথম ভাগে শরৎ এর অনেক বৈশিষ্ট থেকে যায়- এই দুই ঋতুতে বেশ মিল থাকে পৃথক করাটা হয় অনেকটা গোপনে আর এটা হয় ঋতুর প্রতির আমাদের ভালোবাসার কারণে। আকাশ থেকে খন্ড খন্ড মেঘ সরে গিয়ে আমরা পাই একটি বিশাল নীল আকাশ, যে আকাশের দিকে তাকালে আমাদের মন হয় আরও প্রশস্ত ও উদার।
প্রকৃতির ঋতু চক্রে আমাদের মাঝে এসে ধরা দেয় প্রাণের মাস অগ্রাহায়ণ। ছয় ঋতুর দেশে চতুর্থ ঋতু হেমন্ত কাল, আর মাসের হিসাবে অগ্রহায়ণ অষ্টম মাস, অগ্রহায়ণ মাসের শেষের মধ্য দিয়ে হেমন্তের বিদায় নেওয়া।
অগ্রাহায়ণে বড় আয়োজন নবান্ন আর নবান্ন অর্থ নতুন অন্ন, মাঠের সোনালী ধানের চালের প্রথম ভাত বা অন্ন। গ্রামীন বাংলায় নতুন ফসল ঘরে তোলা উপলক্ষে কৃষকেরা এই উৎসব পালন করে থাকে মনে ধারণ করা এক অনাবিল সুখে। আমাদের প্রধান ফসল ধান পেকে মাঠের পর মাঠে যেন সোনালী-হলুদ রঙে সেজে উঠে সেই সাথে গ্রামগুলি হয়ে উঠে স্বর্ণ-ভাণ্ডারে আর শষ্য ভান্ডারে, কৃষকের মুখে দেখা দেয় এক অনাবিল সুখের হাসি তার আগে শুরু হয় ঘরে ঘরে সোনালী ফসল তোলার মহা-আয়োজন।
কার্তিককে কৃষকের ঘরে ফসলের মজুত ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে দেখা দেয় নানা অভাব, কৃষকের নানা চিন্তা. কার্তিক মাস একটি হাতি বা বড় পাথর খন্ড ঠেলে নেওয়া কঠিন হলে্ও আড়ালে চলে সবুজ মাঠে, ক্ষেতে ফসল উৎপাদনের আয়োজন আর যা সুখের আর আনান্দের মুখ দেখায় নবান্ন উৎসবের মধ্য দিয়ে। মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের কবি কংকন মুকুন্দরাম অগ্রাহায়ণকে নিয়ে লিখেছেন –
‘‘ধন্য অগ্রহায়ণ মাস, ধন্য অগ্রহায়ণ মাস,
বিফল জনম তার নাহি যার চাষ’’
বুঝতে বাকি থাকার কথা নয় যে, অগ্রহায়ণে প্রকৃতির দান শষ্য বা ফসল সঠিক পরিশ্রমে ঘরে তুলতে না পারলে কৃষকের সর্বনাশ। একই ভাবে সম্রাট আকবরের রত্ন সভার আবুল ফজলের ‘আইন-ই-আকবরী’তে উল্লেখ আছে যে, সম্রাট আকবরের আমলে অগ্রহায়ণ মাস থেকে বাংলা বছরের গণনা করা হতো এবং এ জন্যই বাংলা সালকে ‘ফসলী সাল’ বলা হতো, পরবর্তীকালে ইংরেজ শাসনামলে বাংলা বছরের গণনা অগ্রহায়ণের পরিবর্তন হয়ে বৈশাখ থেকে নববর্ষ শুরু করা হয়।
অগ্রহায়ণের বা অঘ্রানের ফসলের ভরা ক্ষেত দেখে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এতই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে, তিনি শুধু একটি শক্তিশালি গান নয় বরং আমাদের জন্য একটি জাতীয় সংগীতও রচনা করেছিলেন।
“ আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
……………………………………….
ও মা, অঘ্রানে তোর ভরা ক্ষেতে আমি কী দেখেছি মধুর হাসি ॥
কী শোভা, কী ছায়া গো, কী স্নেহ, কী মায়া গো–
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে, নদীর কূলে কূলে।” – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
অগ্রাহাায়ণ আমাদের বেশ ষ্পষ্ট করে জানান দেয় ভোরে শরীরে একটি মৃদু শীতল অনুভূতি তখনই আমাদের বুঝে নিতে হয় ধরণীতে অগ্রাহায়ণ আগমন। সেই সাথে ঘাসের ও ধান গাছের ডগায় জমতে শুরু করা শিশিরের বিন্দু বিন্দু কণা, কুয়াশার চাদর জানান দেয় অগ্রাহায়ণের শক্ত আগমনী বার্তা।
চারিদিকে শিউলি ফুলের সমারোহে আমাদের মন করে আকূল ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছা করে প্রকৃতির সব উপঢৌকন, মাঠের সবুজ মাঠ আর গাছের পাতায় শিশিরের আগমনে পাতায় পাতায় শিশিরে মাখানো রোদের এক মন জুড়ানো এক দৃশ্য।
এই অগ্রহায়ণেও বৃক্ষ রাজি থাকে সবুজে ভরা যেন একটা ঘাঢ় সবুজে ছোঁয়া লেগে আছে গাছে গাছে, ভরা খাল-বিল নদী-নালা, বিল জুড়ে সাদা-লাল শাপলার মেলা আর পদ্ম ফুলে ফুলে। বিলে নদীতে পানি বেশ নেমে যায় আর তখন জেলেরা একটি ভিন্ন আনান্দের অনুভূতিতে মাছ ধরা শুরু করে । শান্ত নদীতে ভেসে চলে একটি বা অনেকগুলি নৌকা এমন দৃশ্যে কে না প্রকৃতি পাগল হয় !! এসব দেখেই আমরা বুঝতে পারি কত বিচিত্র আমাদের এই ছয় ঋতুর দেশ।
এই অগ্রহায়ণের শীত শীত আবহাওয়া বলে দেয় শীতকাল আসন্ন আর শীত বা তুষার প্রবণ অঞ্চল থেকে দল বেঁধে ছুটে আসতে শুরু করে শীতের অতিথি পাখি কিছুটা উষ্ণতার আশায়, এমনি এক মনোরম আবহাওয়ায় হেমন্তকে যেন আমরা পাই একেবারে প্রাণের মধ্য খানে, কোথাও হারিয়ে গিয়ে শান্তি প্রশান্তির মধ্য খানে।
পয়লা অগ্রহায়ণ প্রতিবছরের মতো এ বছরও উদ্যাপিত হবে জাতীয় নবান্ন উৎসব। জাতীয় নাট্যোৎসব উদ্যাপন পর্ষদ আয়োজিত এ উৎসব উদ্যাপিত হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলায়। জাতীয় নবান্নোৎসব উদ্যাপন উপলক্ষ্যে থাকবে নানান আয়োজন যেমন দেশীয় ও গ্রামীণ সংগীত, ঐতিয্যবাহী নৃত্য, কবিতা আবৃতি, নবান্ন কথন, বাউল, কবি গান, শোভাযাত্রা, সেই সাথে থাকবে নানান গ্রামীণ খাবারের আয়োজন যেমন নানা পিঠা, খৈ, মুড়ি, মুড়কি এবং ঐতিয্যবাহী ঢাক-ঢোলের বাদ্য বাদন।
ধন ধান্যের প্রতিক বাংলার অগ্রহায়ণ যেমনই হোক আমাদের মানস পটে আঁকা থাক অগ্রহায়ণ সেই আমাদের চির চেনা প্রাণের জানা বিশাল নীল আকাশ, শীত শীত আবহাওয়ার একটি মনোরম পরিবেশ। প্রাণের অগ্রহায়ণ , শুভ হোক তোমার আগমন এই বাংলায় ।
ছবি: নেট থেকে সংগ্রিত।
রেটিং করুনঃ ,
ধন ধান্যের প্রতিক বাংলার অগ্রহায়ণ যেমনই হোক আমাদের মানস পটে আঁকা থাক অগ্রহায়ণ সেই আমাদের চির চেনা প্রাণের জানা বিশাল নীল আকাশ, শীত শীত আবহাওয়ার একটি মনোরম পরিবেশ। প্রাণের অগ্রহায়ণ , শুভ হোক তোমার আগমন এই বাংলায় ।
ঋতু নিয়ে আপনার লেখাগুলি দারুন।
প্রাণের অগ্রহায়ণকে স্বাগত ও বরণ করে নেওয়ার জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ, ঋতুতে পরিবর্তন আছে বলেই যান্ত্রিকতা থেকে আমরা কিছুটা দূরে আছি আর দূরে থাকার বড় একটি উপায় হচ্ছে প্রকৃতির সাথে মিশে থাকা, প্রকৃতিকে ভালোবাসা।
আপনাদের অনুপ্রেরণায় ঋতু বৈচিত্রতা নিয়ে লেখা – এই সব লেখার মালিক আমার সন্মানিত পাঠক বৃন্দ।
** গ্রামীন বাংলায় নতুন ফসল ঘরে তোলা উপলক্ষে কৃষকেরা এই উৎসব পালন করে থাকে মনে ধারণ করা এক অনাবিল সুখে। আমাদের প্রধান ফসল ধান পেকে মাঠের পর মাঠে যেন সোনালী-হলুদ রঙে সেজে উঠে সেই সাথে গ্রামগুলি হয়ে উঠে স্বর্ণ-ভাণ্ডারে আর শষ্য ভান্ডারে, কৃষকের মুখে দেখা দেয় এক অনাবিল সুখের হাসি তার আগে শুরু হয় ঘরে ঘরে সোনালী **
হেমন্ত ঋতু যে এতো বৈচিত্র পূর্ণ তা আগে দেখা বা জানা ছিল না।
আপনাদের অনুপ্রেরণায় আমার এ লিখালিখি, অনেক শুভেচ্ছা জানবেন তবে এবার অগ্রহায়ণের শুভেচ্ছা।
হেমন্ত বন্দনা চমৎকার হয়েছে!!
হেমন্তের অনেক অনেক ছবি থাকলে দারুন হতো!!!
মন্তব্য কলামে আমার সন্মানিত পাঠকবৃন্দ লেখায় উতসাহ দিয়ে যায় বলেই আমার লেখালিখি, তবে এবার অগ্রহায়ণের শুভেচ্ছা নিবেন আপা।