এ পি জে কালাম – অনেক কথার বাড়ি – ৩( সংগ্রহিত)
07/28
বিজ্ঞানী, লেখক, রাষ্ট্রপতি—এমন অনেক বিশেষণই রয়েছে এ পি জে আবদুল কালামের নামের সঙ্গে। ভারতসহ বিশ্বের লাখো তরুণের কাছে তিনি পুরোপুরি একজন স্বপ্নবাজ মানুষ, স্বপ্নের ফেরিওয়ালা। যিনি স্বপ্ন দেখতে এবং দেখাতে পছন্দ করতেন। স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত লেগে থাকতেন। এক স্বপ্ন সফল হলে শুরু হতো তাঁর নতুন স্বপ্নবোনা। স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়েই গতকাল সোমবার রাতে ৮৪ বছর বয়সে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি ভালোবাসতেন মানুষের সঙ্গে মিশতে, বিশেষ করে তরুণদের সঙ্গে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ছড়িয়ে দিতেন হাজারো স্বপ্ন। তাঁর মৃত্যুর পর এনডিটিভি অনলাইন গতকাল ২০০৭ সালের পুরোনো একটি অনুষ্ঠান প্রচার করে। সেই অনুষ্ঠানটি ছিল শতাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে এ পি জে কালামের নানা কথোপকথন। অনুষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থীরা তাঁকে নানা বিষয়ে প্রশ্ন করেন, তিনিও বেশ মজা করে সেগুলোর উত্তর দেন। আবার কখনো হেসে হেসে শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করে মজাদার উত্তরটা বের করে নেন। তবে পুরো বিষয়টিতে একটি জিনিস ছিল স্পষ্ট, সেটি হলো স্বপ্ন।
স্বপ্ন নিয়ে এ পি জে আবদুল কালামের অনেক সুন্দর সুন্দর উক্তি আছে। তাঁর মতে, ‘মানুষ ঘুমিয়ে যা দেখে তা স্বপ্ন নয়। স্বপ্ন হলো সেটাই—যা মানুষকে ঘুমাতে দেয় না।’ তিনি সব সময় ছিলেন স্বপ্নের পক্ষে। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন, ‘স্বপ্ন ও স্বপ্নবাজরা সব সময় সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারেন।’ তাই তিনি সবাইকে স্বপ্ন দেখতে ও স্বপ্নের পেছনে তাড়া করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। কারণ, ‘স্বপ্ন না দেখলে তো তা সত্যি হবে না’। তাঁর মতে, ‘স্বপ্ন দেখতে হবে। কারণ, স্বপ্নটা চিন্তায় পরিণত হয়। আর চিন্তা মানুষকে কর্মে অনুপ্রাণিত করে।’
ওই শিক্ষার্থীরা আবদুল কালামের কর্মজীবন, ব্যক্তিগত জীবন, নারী, ধর্ম, রাজনীতি, সমাজ, এমনকি তাঁর কেশবিন্যাসের বিষয়ে জানতে চান। নারীকে কীভাবে দেখেন?—এ প্রশ্নের জবাবে আবদুল কালাম বলেন, তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় প্রেরণাদাত্রী তাঁর মা। তিনি চান, নারীর আরও ক্ষমতায়ন হোক। ভারতের পার্লামেন্টসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে আরও অধিক সংখ্যায় নারীর অংশগ্রহণ প্রয়োজন। কারণ, অর্ধেক জনগোষ্ঠী পিছিয়ে থাকলে আসলে দেশ আর দেশের উন্নয়নই পিছিয়ে থাকবে।
এ পি জে কালাম স্বপ্ন দেখার এই বিষয়টি তাঁর শৈশবের শিক্ষকের কাছ থেকে পেয়েছেন বলে উপস্থিত শিক্ষকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন। তিনি বলেন, ছোটবেলায় তাঁর শিক্ষক শিব সুব্রামনিয়াম আয়ার শ্রেণিকক্ষের বোর্ডে একটি পাখি এঁকে জানতে চেয়েছিলেন, পাখির মতো উড়তে পারবে? বিষয়টি তার ছোট মনে বেশ নাড়া দিয়েছিল, তিনি পাখির মতো ওড়ার জন্য যুদ্ধবিমানের পাইলট হতে চেয়েছিলেন। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তবে তিনি দমে যাননি। পরবর্তী সময়ে হয়েছিলেন রকেটবিজ্ঞানী। বিমান প্রকৌশলে পড়াশোনা করে ভারতের প্রথম মহাকাশযান তৈরিতে মুখ্য ভূমিকা রাখেন তিনি। ওই মহাকাশযান দিয়েই ১৯৮০ সালে ভারত প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র রোহিনী উৎক্ষেপণ করে। ১৯৯৮ সালে ভারতের পোখরান-২ পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষার পেছনেও প্রধান ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। ১৯৭৪ সালে মূল পরীক্ষা চালানোর পর দীর্ঘ ২৪ বছরে ভারতের এটাই ছিল প্রথম সফল পারমাণবিক পরীক্ষা। তিনি পরিচিতি পান ভারতের ‘মিসাইলম্যান’ হিসেবে।
চুলের এমন ভঙ্গিমা কীভাবে এলো?—এক শিক্ষার্থীর এমন প্রশ্নের জবাবে সাবেক এই রাষ্ট্রপতি বলেন, ছোটবেলা থেকেই তাঁর চুলটা একটু অন্যরকম, এলো ধাঁচের ছির। পরিপাটি করে রাখাটা বেশ কষ্টের ছিল। পরিপাটি করে রাখার নানা কৌশল প্রয়োগ করতে করতে একবার ভাবলেন, এইভাবে কাটলে কেমন হয়? কাটার পর দেখলেন নিজের চুলটা এভাবেই সবচেয়ে পরিপাটি থাকে। ব্যস, সেই থেকে এটাই চুলের স্টাইল হয়ে গেল!—বলেই লাজুক হাসি হাসতে থাকলেন।
বিজ্ঞানী না রাষ্ট্রপতি, কোন পরিচয়ে পরিচিত হতে পছন্দ করেন?—এমন প্রশ্নের জবাবে এ পি জে কালাম শুধুই হাসলেন। তারপর প্রশ্নকর্তা শিক্ষার্থীকে বললেন, এটা তোমরাই বলতে পারবে। ওই শিক্ষার্থী ঝটপট বলে ওঠেন, আপনি একজন ‘বৈজ্ঞানিক রাষ্ট্রপতি’। শিক্ষার্থীর এমন জবাব পেয়ে বাচ্চাদের মতো হাসলেন। সবার উদ্দেশে বললেন, হাসতে হবে প্রাণ খুলে। হাসতে পারাটা খুব দরকার। হাসি জীবনকে সহজ করে। কঠিন সময় পার করতে সহায়তা করে।
ধর্ম খুবই ব্যক্তিগত চর্চার বিষয়—এক প্রশ্নের জবাবে এমন মন্তব্য করে ‘ভারতরত্ন’, ‘পদ্মভূষণ’ ও ‘পদ্মবিভূষণ’ খেতাবে ভূষিত কালাম বলেন, যারা মহৎ তারা ধর্ম থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষের মঙ্গলে কাজ করে। আর যারা খারাপ, তারা ধর্মকে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। তিনি ধর্মের কাছ থেকে ভালো শিক্ষা নিয়ে তা জাতির উন্নয়নে কাজে লাগাতে তরুণদের প্রতি আহ্বান জানান।
তামিলনাড়ুর রামেশ্বরমে এক মৎস্যজীবী পরিবারে খুব দারিদ্র্যের মধ্যে জন্ম নিলেও কালামের স্বপ্ন ছিল অনেক বড়। আর এই স্বপ্নের অনেকটাই পূরণ করে দেখিয়েও গেছেন এই খ্যাতিমান পরমাণুবিজ্ঞানী। নিজের বইয়ে লিখে গেছেন আকাশসম স্বপ্নের কথা। তরুণদের জন্য তাঁর বার্তা ছিল, ‘অন্য রকমভাবে চিন্তা করো। নতুন কিছু সৃষ্টি করার সাহস রাখো। সাফল্যের পথে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করো। একসঙ্গে কাজ করার জন্য এগুলোই বড় গুণ।’
07/28
‘আমার মৃত্যুতে ছুটি ঘোষণা করো না, আমায় যদি ভালোবাসো, মন দিয়ে কাজ করো সেদিন।’ সদা কর্ম ও জ্ঞান সাধনায় নিবেদিত এ পি জে আবদুল কালাম মৃত্যুর বহু বছর আগে তরুণদের এক সমাবেশে এ রকমই উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন পরমাণুবিজ্ঞানী ছিলেন। সফল ক্ষেপণাস্ত্র নির্মাতা হিসেবে তাঁর নামের আগে যুক্ত হয়েছিল ‘মিসাইল আবদুল কালাম’। ১৯৯৮ সালে পোখরান-২ পরমাণু বোমা পরীক্ষার অন্যতম কারিগরও ছিলেন তিনি।
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই প্রখ্যাত বিজ্ঞানী কাজ করে গেছেন দেশ ও মানুষের কল্যাণে। রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন শেষে আর পাঁচজনের মতো অবসরে না গিয়ে তিনি জ্ঞানালোকে নবীন প্রজন্মকে দীক্ষিত করতে ঘুরেছেন ভারতের বিভিন্ন বিদ্যাপীঠে। এসেছেন বাংলাদেশেও। তাঁর লেখা বইগুলোতেও আছে স্বপ্ন ও জীবনকে জয়ী করার কথা।
উচ্চ চিন্তা ও সাদামাটা জীবনাচরণে অভ্যস্ত আবদুল কালাম বিশ্বাস করতেন মানুষের অমিত শক্তিতে। নিজে অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের সন্তান হয়েও অধ্যবসায়ের জোরে হতে পেরেছিলেন বিশ্বের অন্যতম সেরা বিজ্ঞানী। তিনি কোন পদ বা প্রতিষ্ঠানে যুক্ত ছিলেন কিংবা কত বড় রাষ্ট্রীয়, সেটি ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয়; বরং তাঁর স্পর্শেই সেই পদ, প্রতিষ্ঠান ও পুরস্কার হয়ে উঠেছিল অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ।
২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতি পদে থাকাকালে নিজের কর্মগুণে সব দলের সমর্থন আদায় করে নিয়েছিলেন এ পি জে আবদুল কালাম। যে বিজেপি তাঁকে রাষ্ট্রপতি করেছিল, সেই বিজেপির সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যেতেও দ্বিধা করেননি। বিহারে লালুপ্রসাদ যাদবের সরকারকে সরিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন-সংক্রান্ত বিল তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন।
আবদুল কালামের সঙ্গে বাংলাদেশেরও নিগূঢ় সম্পর্ক ছিল। বাংলাদেশের অনেক বিজ্ঞানী ও গবেষক তাঁর সান্নিধ্যে এসেছেন। তিনি একাধিকবার বাংলাদেশে এসে নতুন প্রজন্মকে উজ্জীবিত করেছেন। আমরা ভারতের এই মহান বিজ্ঞানীর মৃত্যুতে শোক জানাই। তাঁর শিক্ষা, গবেষণা ও লেখনী প্রজন্মান্তরে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
বিষয়:
রেটিং করুনঃ ,