লেখক: মোঃ দাউদুল ইসলাম।
যুক্তরাষ্ট্রে ৯/১১ হামলার কথা এলেই প্রথমে আসবে আল-কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেনের নাম। তারপর ওই হামলার জন্য দায়ী হিসেবে যাঁর নাম আসবে, তিনি হলেন খালিদ শেখ মোহাম্মদ। যুক্তরাষ্ট্রের ‘৯/১১ কমিশন’ ও গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, খালিদই ছিলেন ওই হামলার ‘মূল পরিকল্পনাকারী’। তিনিই বিন লাদেনকে এই ‘বিমান অভিযানে’ রাজি করিয়েছিলেন।
২০১১ সালের ২ মে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদের অদূরে অ্যাবোটাবাদে মার্কিন বাহিনীর কমান্ডো অভিযানে নিহত হন ওসামা বিন লাদেন। কিন্তু যাঁর ‘মস্তিষ্কপ্রসূত’ এই নজিরবিহীন হামলা, সেই খালিদ শেখ মোহাম্মদসহ পাঁচ অভিযুক্তের বিচার কত দূর এগিয়েছে? হামলার ২০তম বার্ষিকীর আগে এ সম্পর্কে একটি মতামত দিয়েছেন খালিদ শেখ মোহাম্মদের আইনজীবী ডেভিড নেভিন। তাঁর মতে, এই মামলা শেষ হতে লেগে যেতে পারে আরও ২০ বছর।
কুয়েতে জন্ম নেওয়া খালিদ শেখ মোহাম্মদ পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থা এফবিআই তাঁর নামের সংক্ষিপ্ত রূপ দিয়েছে ‘কে এস এম’। তিনি আফগানিস্তানে লড়েছেন। কে এস এমের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে জড়িত থাকার প্রমাণ বহু আগেই পেয়েছিল এফবিআই। ১৯৯৩ সালে বিশ্ববাণিজ্য কেন্দ্রে বোমা হামলার তদন্তে দেখা যায়, হামলায় জড়িত এক ব্যক্তিকে তিনি অর্থ জুগিয়েছেন। ১৯৯৫ সালে প্রশান্ত মহাসাগরের ওপর বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক উড়োজাহাজ উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিল সন্ত্রাসবাদীরা। সেই পরিকল্পনার সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন।
খালিদ শেখ মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করা হয় ২০০৩ সালে, পাকিস্তানে। এরপর মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ তাঁকে নিয়ে যায় গোপন ডেরায়। যেখানে তাঁর ওপর প্রয়োগ করা ‘জিজ্ঞাসাবাদের উন্নত কৌশল’। সে সময় অন্তত ১৮৩ বার খালিদের মাথা পানিতে ডুবিয়ে রাখা হয়। এই ‘ওয়াটারবোর্ডিং’ পদ্ধতি প্রয়োগ ছাড়াও আরও নানা শারীরিক শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। পায়ুপথ দিয়ে পানি ঢোকানোর মতো কঠিন ‘শাস্তির’ও শিকার হয়েছিলেন তিনি। ঘুমাতে বাধা দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। নগ্ন করে রাখা হয়েছিল জোর করে। এমনকি সন্তানদের হত্যা করা হবে বলেও তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। তাঁকে ২০০৬ সালে কিউবায় যুক্তরাষ্ট্রের কুখ্যাত গুয়ানতানামো বে কারাগারে সরিয়ে নেওয়া হয়।
অন্য অভিযুক্তরা ও অভিযোগ
৯/১১ হামলায় জড়িত সন্দেহভাজন ১৯ ব্যক্তির মধ্যে কিউবার গুয়ানতানামো বেতে মার্কিন সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচার হচ্ছে খালিদ শেখ মোহাম্মদসহ পাঁচজনের। তাঁদের আটক করা হয় ২০০২ থেকে ২০০৩ সালের মধ্যে। এরপর তাঁদের রাখা হয় সিআইএর গোপন কারাগারে। বিচারের জন্য ২০০৬ সালে পাঠানো হয় গুয়ানতানামো বেতে। ওই পাঁচজনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, যুদ্ধবিধি ভঙ্গ করে হত্যা ও সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ আনা হয়েছে, যে অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।
৯/১১ হামলার মামলায় খালিদ ছাড়া অন্য অভিযুক্তদের একজন ওয়ালিদ বিন আত্তাশ। খাল্লাদ নামে পরিচিত এই ব্যক্তি দুজন উড়োজাহাজ ছিনতাইকারীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। গবেষণা করেছেন উড়োজাহাজ চলাচলের সূচি নিয়ে। কীভাবে একজন যাত্রী ছোরা লুকিয়ে উড়োজাহাজে উঠতে পারেন, সেই পরীক্ষা চালাতে কয়েকটি দেশও ভ্রমণ করেছেন তিনি। ২০০৩ সালের ২৯ এপ্রিল তাঁকে পাকিস্তানের করাচিতে গ্রেপ্তার করা হয়।
সৌদি আরবে জন্ম নেওয়া আত্তাশ আফগানিস্তানে লড়াইয়ে যোগ দিতে মাত্র ১৪ বছর বয়সে দেশ ছাড়েন। লড়াইয়ে তিনি ডান পায়ের নিচের অংশ হারিয়েছেন।
আরেক অভিযুক্ত রামজি বিন আল-শিভ আল–কায়েদার উড়োজাহাজ ছিনতাইকারী সেলের সমন্বয় করেছেন। তিনি নিজেও উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তবে ভিসা না পাওয়ায় তাঁর যাওয়া হয়নি। ৯/১১ হামলায় বিচারাধীন পাঁচ অভিযুক্তের মধ্যে সবার আগে ধরা পড়েন তিনি। ২০০২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তাঁকে পাকিস্তানের করাচিতে আটক করে নিরাপত্তা বাহিনী।
ওই হামলায় আরেক অভিযুক্ত আম্মার আল-বালুচি। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে উড়োজাহাজ ছিনতাইকারীদের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে অর্থ পাঠিয়েছেন। খালিদের এই ভাগনের নাম অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে আবদ আল আজিজ আলী হিসেবে। তিনি ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সংযুক্ত আরব আমিরাতে কম্পিউটার প্রযুক্তির ব্যবসা করেছেন। ৯/১১ হামলার সময় তিনি দুবাই ছেড়ে যান। ২০০৩ সালের ২৯ এপ্রিল তিনি পাকিস্তানের করাচিতে আটক হন। পাকিস্তানি নাগরিক বালুচির জন্ম কুয়েতে।
ওই পাঁচজনের মধ্যে সবচেয়ে কম অভিযোগ মুস্তাফা আল হাওসাভির বিরুদ্ধে। এই সৌদি নাগরিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি কয়েকজন উড়োজাহাজ ছিনতাইকারীকে অর্থ ও ভ্রমণে সহায়তা দিয়েছেন।
বিচারে এত দেরি কেন
৯/১১ হামলার বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয় বেশ কয়েকবার। কিন্তু নানা কারণে তা হয়নি। একবার নিউইয়র্কে বিচারের কথা ওঠে। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দা ও রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে সেটা ভেস্তে যায়। হামলারকারীদের নিউইয়র্ক শহরে দেখতে চাননি বাসিন্দাদের অনেকে। বিভিন্ন পক্ষ থেকে দাবি ওঠে, গুয়ানতানামো বেতেই বিচার হোক। শেষ পর্যন্ত সেখানেই বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু নানা কারণে এই বিচারকাজ বিলম্বিত হয়। শেষ পর্যন্ত হামলার ২০তম বার্ষিকীর আগে আবার আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অবশ্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের এক আইনজীবী বলছেন, গণমাধ্যমকে দেখানোর জন্যই হামলার ২০তম বার্ষিকীতে এ উদ্যোগ। তাঁর মতে, এ বিচারকাজ শেষ করতে পাড়ি দিতে হবে বহু পথ।
২০০৮ সালে মামলাটি শুরু হওয়ার পর থেকেই এর সঙ্গে যুক্ত আছেন খালিদ শেখ মোহাম্মদের আইনজীবী ডেভিড নেভিন। বিচারকাজ শেষ হতে বহু সময় লেগে যাওয়া প্রসঙ্গে তাঁর একটি যুক্তি, মামলার নতুন বিচারক নিয়োগ হয়েছে। এই বিচারপ্রক্রিয়ার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে তাঁকে আগের শুনানির ৩৫ হাজার পাতার বিবরণ পড়তে হবে। নেভিনের ভাষ্য, যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ফৌজদারি অপরাধের সবচেয়ে বড় বিচার এটাই। এবং সবচেয়ে বিতর্কিতও। এই বক্তব্যের কারণ হিসেবে তিনি বলেন, পাঁচজন বিবাদীর সবাইকে গোপন বন্দিশিবিরে আটক করে রেখেছিল সিআইএ। সেখানে তাঁদের ওপর জিজ্ঞাসাবাদের ‘উন্নত কৌশল’ ব্যবহার করা হয়েছে, যা বিতর্ক উসকে দিয়েছে। আইনজীবী নেভিন বলেন, এসব পদ্ধতির ব্যবহার সম্ভাব্য যেকোনো সাজার বিরুদ্ধে আপিলের প্রচুর সুযোগ তৈরি করে দেবে, যা চলতে পারে বছরের পর বছর ধরে।
এই মামলার সাজা মৃত্যুদণ্ড। বিচারকাজ বিলম্বিত হওয়ার পেছনে এটিকেও একটি কারণ হিসেবে দেখছেন আইনজীবীরা। সরকার যদি বিবাদীদের মৃত্যুদণ্ড দিতে না চাইত, তাহলে বিচারকাজ অনেক আগেই শেষ হয়ে যেত, দাবি নেভিনের।
এদিকে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার আগে সামরিক জুরি নির্বাচন শুরু করতে ২০২১ সালের ১১ জানুয়ারি দিন ধার্য করেছিলেন বিচারক। তখন ধারণা করা হয়েছিল, বিচার শেষ হতে এক বছরের মতো সময় লাগবে। কিন্তু বদলি ও করোনা পরিস্থিতিতে গুয়ানতানামো বেতে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা সবকিছু এলোমেলো করে দেয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে ধারণা করা হচ্ছে, ২০২১ সালে হয়তো জুরি নির্বাচন প্রক্রিয়াই হয়তো শুরু হবে না।
২০১২ সালের ৫ মে আসামিদের অভিযুক্ত করা হলেও মামলাটি এখনো প্রাক্-বিচার পর্যায়ে রয়ে গেছে। মূল বিচারপ্রক্রিয়া শুরুর আগে বহু প্রশ্নের সমাধান প্রয়োজন। আসামিপক্ষের আইনজীবীদের দাবি, গুয়ানতানামো বেতে জিজ্ঞাসাবাদের সময় তাঁদের মক্কেলদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছে। নির্যাতনের মুখে জিজ্ঞাসাবাদকারীদের পছন্দমতো প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন তাঁরা। এভাবে আদায় করা প্রমাণ বাদ দেওয়ার দাবি উঠেছে আসামিপক্ষের আইনজীবীদের দিক থেকে।
অভিযুক্তদের মার্কিন আইনজীবী
এই পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাঁরা হামলা চালিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। অথচ সেই যুক্তরাষ্ট্রেরই আইনজীবীরা তাঁদের রক্ষার জন্য আদালতে লড়ছেন। কারণ, মার্কিন কর্তৃপক্ষের বাধ্যবাধকতা। ‘নিরাপত্তার স্বার্থে’ কর্তৃপক্ষ ঠিক করে দিয়েছে, বাদী-বিবাদী দুই পক্ষের আইনজীবীদেরই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হতে হবে। নেভিন বলেন, শুরুর দিকে খালিদ মার্কিন আইনজীবী নেওয়ার ব্যাপারে ছিলেন দারুণ সন্দিহান। এ কারণে তাঁদের একে অপরকে জানতে দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।
নেভিন জানান, খালিদ শেখ মোহাম্মদকে একসময় রাখা হয়েছিল নৌঘাঁটির অতিগোপন জায়গায়। তখন মক্কেলের কাছে নিতে তাঁদের গাড়িতে উঠিয়ে ৪৫ মিনিট ঘোরানো হতো। ভেতর থেকে যাতে বাইরে কিছু দেখা না যায়, গাড়িতে সেই ব্যবস্থা ছিল। যাতে তাঁরা বুঝতে না পারেন কোথায় নেওয়া হচ্ছে তাঁদের। কিন্তু এখন তাঁর মক্কেলকে কম গোপনীয় ক্যাম্প ফাইভে রাখা হয়েছে।
৯/১১ হামলায় নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের স্পর্শকাতরতার বিষয়ে সচেতন আসামিদের আইনজীবীরা। কেন তাঁরা এ রকম বিবাদীর প্রতিনিধিত্ব করছেন, এ নিয়ে কিছু কিছু পরিবারের সদস্যদের দিক আপত্তিও উঠেছিল। তবে অনেকেই আবার তাঁদের কাছে জানতে চেয়েছেন কীভাবে বিচারপ্রক্রিয়া চলছে।
নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা বছরের পর বছর ধরে যে দুঃখ-যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন, তা যাতে আরও না বাড়ে, সে ব্যাপারে তাঁরা অত্যন্ত সচেতন, যোগ করেন নেভিন।
বিচারক
২০১২ সালে আসামিরা অভিযুক্ত হওয়ার পর থেকে আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন চারজন বিচারক। শুরু থেকে প্রথম ছয় বছর দায়িত্ব পালন করেছেন কর্নেল জেমস এল পোহল। তিনি অবসরে যাওয়ার পর যাঁকে নিয়োগ করা হয়, তিনিও এখন অবসরে। একজন বিচারক নৌবাহিনীতে কমান্ড পজিশন পাওয়ার পর এ দায়িত্ব ছেড়েছেন। হামলার ভুক্তভোগীদের সঙ্গে সম্পৃক্ততার কথা বলে একজন বিচারক এক দিনের জন্যও আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করেননি। সর্বশেষ বিচারক কর্নেল ম্যাথিউ এন ম্যাককল দায়িত্ব পেয়েছেন গত ২০ আগস্ট।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, দ্য নিউইয়র্ক টাইমস
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ১১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,