লেখক: মিজানুর রহমান ।
বহুল আলোচিত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস্ বিদায় নিয়েছেন। সোমবার মধ্যরাতে নির্ধারিত মিশন শেষে ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে ঢাকা ছেড়ে যান তিনি। ক্যালেন্ডারের হিসাবে দু’বছর চার মাস বাংলাদেশে ছিলেন পিটার। আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে- ৮৬২ দিনের ঢাকা মিশন ছিল তার। ২০২২ সালের মার্চে দায়িত্ব নেয়ার মুহূর্ত থেকে বিদায়ের দিন অবধি ঘুরেফিরে আলোচনায় ছিলেন পিটার ডি হাস্। নগর বিচ্ছিন্ন চায়ের দোকান কিংবা ঢাকায় পার্টি হেডকোয়ার্টার, কূটনৈতিক আড্ডা কিংবা রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি। সর্বত্রই আলোচনায় ছিলেন তিনি। পিটার ছুটে চলেছেন সকাল-বিকাল। শুনেছেন নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের কথা, বলেছেনও। তার হাঁটা-চলা যেন সবার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল।
তার নিজের কথায় অবশ্য তেমন পরিবর্তন হয়নি। র্যাবের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে দুই দেশের সম্পর্ক যখন তলানিতে, ঠিক সেই সময়ে ঢাকায় দায়িত্ব বুঝে নেন পিটার হাস্। তার আমলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক টানাপড়েনের মধ্যদিয়ে গেছে, তবে এগিয়েছে। পেশাদারদের ভাষায় ‘বন্ধুত্বে এসব স্বাভাবিক ঘটনা’। পিটারের আগমনের মুহূর্তটি ছিল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের জন্য অস্বস্তিকর। আর তার বিদায়ের দিনে গোটা বাংলাদেশে ছিল দমবন্ধ অবস্থা। গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে নজিরবিহীন কারফিউয়ের মধ্যে বিমানবন্দরে যেতে হয়েছে তাকে। অবশ্য বিদায়ের দু’দিন আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আমন্ত্রণে অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত জরুরি কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে অংশ নেন তিনি। যে ব্রিফিংয়ে সহিংসতার ১৫ মিনিটের একটি ভিডিও দেখিয়ে সরকারের তরফে বিরোধী মত বিশেষত বিএনপি-জামায়াতের ওপর দায় চাপানো হয়। যেখানে কূটনীতিকদের পর্যবেক্ষণ ছিল ভিন্ন।
সূত্রের খবর ব্রিফিংয়ে পিটার হাস্ বলেন, যে ভিডিও ফুটেজ দেখানো হয়েছে তা একপক্ষীয়। আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অ্যাকশন বিশেষত যেভাবে নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলি-টিয়ারশেল ছোড়া হয়েছে তার তো কোনো ফুটেজ নেই। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সেই বক্তব্যের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন অনুষ্ঠানে উপস্থিত বৃটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক। ওই ব্রিফিংয়ে পিটার হাস্ কেবল বলেছেন তা কিন্তু নয়, তিনি তার সহকর্মী জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকদের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে সহমত ভিন্নমতও করেছেন বলে জানায় ব্রিফিং সূত্র। ঢাকায় পিটার হাস্-এর কার্যক্রম বিষয়ে সেদিন এক আড্ডায় সেগুনবাগিচার দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলছিলেন- ‘পিটার হাস্-এর অবস্থানে কোনো অস্পষ্টতা ছিল না। তিনি যা বিশ্বাস করতেন তাই বলতেন। সরকারি মহলে সমালোচনা সত্ত্বেও তিনি ভোটের আগ পর্যন্ত একটি অবাধ, স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলেছেন। এটা যেন তার ব্রত হয়ে গিয়েছিল। তিনি সরব ছিলেন গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, নাগরিক সমাজের ভূমিকা নিয়ে। তিনি কখনোই তার সমালোচনায় রা করেননি।’ ঢাকায় ১৭তম মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে যোগদানের আগে পিটার হাস্ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের অর্থনৈতিক ও ব্যবসা বিষয়ক ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারির দায়িত্বে ছিলেন। মুম্বইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। লন্ডন, বার্লিন, জাকার্তা, ওয়াশিংটনেও ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ পদে। ঢাকার মাটিতে পা রাখার আগেই পিটার হাস্-এর বিষয়ে রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহল তৈরি হয়। নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে সম্পর্কে গতি ফেরাতে তিনি কী ভূমিকা রাখতে পারেন তাতে নজর ছিল সবার।
বিশেষ করে ১৫ই মার্চ, ২০২২, ঢাকা মিশন শুরুর চারদিনের মাথায় স্টেট ডিপার্টমেন্টের চতুর্থ সর্বোচ্চ পদধারী রাজনীতি বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডকে স্বাগত জানান পিটার হাস্। পার্টনারশিপ ডায়ালগে নেতৃত্ব দিতে এসেছিলেন তিনি। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারির পর এটাই ছিল ওয়াশিংটনের উচ্চ পর্যায়ের কোনো প্রতিনিধিদলের প্রথম ঢাকা সফর। ওই টিমে মার্কিন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডনাল্ড লুও ছিলেন। ব্যক্তি জীবনে পিটার এবং লু’ বন্ধু। তাদের ৩০ বছরের বন্ধুত্ব। র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের আলোচনা জোর পেলেও সেই বৈঠকেই প্রথম দ্বাদশ নির্বাচন নিয়ে তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা হয়। দায়িত্ব গ্রহণের এক মাসের মাথায় গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ (বিস) মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক: বর্ধিত সহযোগিতা ও অগ্রসর অংশীদারিত্ব’ শীর্ষক এক সেমিনারে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন পিটার হাস্। সেখানে মোটা দাগে ‘নিষেধাজ্ঞা’ এবং ‘নির্বাচন’ নিয়ে প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান খোলাসা করেন। সেই সঙ্গে ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপ সংক্রান্ত কানাঘুষা দৃঢ়তার সঙ্গে নাকচ করেন।
র্যাবের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের তোড়জোড় প্রশ্নে মার্কিন দূত সেদিন জানিয়েছিলেন, মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের সুরাহায় সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ এবং বাহিনীর জবাবদিহিতা নিশ্চিত না হলে কোনো অবস্থাতেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হবে না! তবে সেদিন তিনি সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় র্যাবের কার্যক্রমের প্রশংসা করেছিলেন। ওই সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। বিশ্বের দেশে দেশে গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে বাইডেন প্রশাসনের সর্বাত্মক সহায়তার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে ঢাকায় দেয়া প্রথম টাউন হল মিটিংয়ে রাষ্ট্রদূত নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছিলেন। দায়িত্বের পুরো সময়ে পিটারের বয়ান ছিল অভিন্ন। কোনো দল বা জোটের প্রতি তার বিশেষ পছন্দ প্রমাণ করতে পারেনি সমালোচকরা। এ নিয়ে বহু জন বহু কথা বলেছেন। কিন্তু পিটার হাস্ ঢাকায় তার শেষ কর্মদিবস অবধি ‘পক্ষপাতহীনভাবে’ কাটিয়ে গেছেন বলে দাবি করেন সহকর্মীরা। পিটার হাস্ আওয়ামী লীগ অফিসে গিয়ে দলটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি বিরোধী দল এবং ভিন্নমতের কথাও শুনেছেন। যেমনটা কূটনীতিতে খুবই রুটিন ঘটনা। সর্বত্র তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট নিয়ে সমান উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তবে সেটি যে রাজনৈতিক দলগুলোকেই নির্ধারণ করতে হবে খোলামেলা ভাবেই সেটা বলেছেন।
যেকোনো রাষ্ট্রে রাজনৈতিক দল, মিডিয়া, সুশীল সমাজ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সবার যে ভূমিকা রয়েছে সেটি প্রায়শই স্মরণ করতেন পিটার হাস্। তিনি বলতেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে গুরুত্ব দেয়। এটা নিশ্চিত করতে হবে যেন জনগণ তার পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি ভয়ভীতি ছাড়া প্রকাশ করতে পারে। যেটা বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে খুবই জরুরি। পিটার হাস্ বলতেন- ‘উন্নয়ন ও নিরাপত্তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এটি কোনো ভাবেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের ঊর্ধ্বে স্থান পেতে পারে না।
গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ নানা ইস্যুতে নিরন্তর কাজ করা পিটার হাস্ ঢাকায় একাধিকবার অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন। ‘মায়ের ডাকের’ সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ কর্মসূচিতে গিয়ে রাজধানীর শাহীনবাগে তিনি বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিলেন। তার গাড়ি ঘিরে বিভিন্ন কথা বলতে ছিল মায়ের কান্না নামের আরেকটি সংগঠনের সদস্যরা। সেই সংগঠনটি সরকারের সমর্থকদের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত বলে বলাবলি আছে। উদ্ভূত সেই পরিস্থিতিতে নির্ধারিত সময়ের আগে কর্মসূচি শেষ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গিয়ে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছিলেন তিনি। বিষয়টি তখন কূটনৈতিক দুনিয়ায় বেশি আলোচিত হয়েছিল।
সূত্র: মানবজমিন।
তারিখ: জুলাই ২৪, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,