লেখক:রিচার্ড হাস।
আমেরিকান বেসবল খেলোয়াড় লরেন্স ‘যোগী’ বেরার একটি কথা পর্যবেক্ষণ হিসেবে ব্যাপকভাবে উদ্ধৃত হয়ে থাকে: ‘ভবিষ্যদ্বাণী করা কঠিন, বিশেষ করে তা যদি ভবিষ্যতের বিষয়ে হয়।’ কথাটা তিনি আদৌ বলে থাকুন আর না বলে থাকুন; কথাটা কিন্তু খাঁটি।
তারপরও বছরটা কেমন যাবে, সে বিষয়ে দশটি ভবিষ্যদ্বাণী করছি।
এক.
২০২২ সালের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ চলতে থাকবে; যদিও লড়াইয়ের তীব্রতা কিছুটা কমে আসতে পারে। এই লড়াইয়ের সামরিক বিজয় বলতে যদি এক পক্ষের দ্বারা অন্য পক্ষকে সামরিকভাবে ধসিয়ে দেওয়া এবং যুদ্ধ-পরবর্তী সীমানা নির্ধারণ ও রাজনৈতিক মীমাংসার শর্তাবলি নির্ধারণের ক্ষমতা প্রতিপক্ষকে নাস্তানাবুদ করা পক্ষটির হাতে থাকা দিয়ে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তাহলে সেই সংজ্ঞা অনুসারে এই যুদ্ধে এই বছর রাশিয়া বা ইউক্রেন—কেউই সম্পূর্ণ সামরিক বিজয় পাবে না।
কূটনৈতিক বিজয় হিসেবে যদি এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছানোকে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যেখানে উভয় সরকারই সন্ধিপত্রে সই করতে রাজি হবে এবং সন্ধির শর্ত মেনে চলবে; তাহলে সেই সংজ্ঞা অনুসারে কূটনীতিকেরাও কোনো বিজয় পাবেন না। কারণ, শান্তির জন্য নেতাদের মধ্যে দুটি জিনিস থাকা প্রয়োজন। একটি হলো সমঝোতা করার ইচ্ছা এবং অপরটি হলো সমঝোতার সক্ষমতা। আর এই দুটি উপাদান উভয় পক্ষের নেতাদের মধ্যে স্পষ্টতই অনুপস্থিত।
দুই.
যদিও অনেক নীতিনির্ধারক তাইওয়ানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আশঙ্কার কথা বলছেন, তবে ২০২৩ সালে এই যুদ্ধের আশঙ্কা খুবই কম বলে মনে হচ্ছে। চীনের নেতা সি চিন পিং কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে লড়াই করছেন। এই মহামারি এখনো তাঁর দেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে কাবু করে রেখেছে। এটি ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এবং চীনের মন্থর অর্থনীতিকে আরও দুর্বল করে দিচ্ছে। চীন কোনোভাবেই প্রয়োজনসাপেক্ষে বলপ্রয়োগ করে তাইওয়ানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার লক্ষ্য পরিত্যাগ করেনি। তবে এটিও ঠিক, বেইজিং আগামী অন্তত কয়েক বছরের মধ্যে তাইওয়ানের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক পদক্ষেপ নেবে না। এর বদলে তারা তাইওয়ানের ওপর চাপ বাড়াতে থাকবে।
ভারত মহা মহা কিছু অর্জন করবে বলে যাঁরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, দেশটি তাঁদের হতাশ করতে থাকবে। ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র ও তেল কেনা চালিয়ে যাবে এবং চীনের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের কাছ থেকে বড় ধরনের সহায়তা চাইলেও জোটনিরপেক্ষতার ভঙ্গিতে অনড় থাকবে। সবচেয়ে বিপদের বিষয় হলো, ভারত তার নিজ ভূখণ্ডে ক্রমাগত আরও অনুদার ও কম ধর্মনিরপেক্ষ হতে থাকবে।
তিন.
এ বছরের অন্যতম ঘটনা হবে একটি প্রধান ভূরাজনৈতিক খেলোয়াড় হিসেবে জাপানের আবির্ভাব। বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির এই দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১.৫ শতাংশে সংশোধিত হয়েছে এবং প্রতিরক্ষা ব্যয় এখন দ্বিগুণ হওয়ার পথে, যা জিডিপির ২ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। এ অঞ্চলের সবচেয়ে সক্ষম সামরিক বাহিনীর মালিক জাপান তাইওয়ানের বিরুদ্ধে চীনা আগ্রাসন ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আরও ঘনিষ্ঠভাবে শরিক হবে।
চার.
ঘন ঘন ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা করা ছাড়াও উত্তর কোরিয়া প্রায় নিশ্চিতভাবেই সপ্তমবারের মতো পারমাণবিক পরীক্ষা চালাবে। দক্ষিণ কোরিয়া বা যুক্তরাষ্ট্র—কেউই তার এই ধরনের কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করতে সক্ষম হবে না।
পাঁচ.
রাশিয়ার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো এবং ইউক্রেনকে সাহায্য করার যৌথ ইচ্ছার কারণে ট্রান্সআটলান্টিক দেশগুলোর সম্পর্ক আপাতত বেশ জোরালো অবস্থায় আছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সুরক্ষাবাদের বিষয়ে ইউরোপীয়দের অসন্তুষ্টি এবং চীনের ওপর ইউরোপের অব্যাহত অর্থনৈতিক নির্ভরতা নিয়ে ইউরোপিয়ান দেশগুলোর ওপর আমেরিকানদের অসন্তুষ্টির কারণে সে সম্পর্কে চিড় ধরবে। ইউক্রেনকে সামরিক, অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক সমর্থন দেওয়া এবং প্রতিরক্ষা ব্যয়ের মাত্রা নিয়ে মতপার্থক্যের সূত্র ধরে ট্রান্সআটলান্টিক সম্পর্ক নষ্ট হবে।
ছয়.
বেশির ভাগ পর্যবেক্ষক বিশ্ব অর্থনীতির প্রসারণ সম্পর্কে যে পূর্বাভাস দিচ্ছেন, অর্থনীতি তার চেয়ে ধীরগতিতে প্রসারিত হতে পারে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ২ দশমিক ৭ সামগ্রিক প্রবৃদ্ধির ভবিষ্যদ্বাণী করলেও কোভিড-১৯ মোকাবিলায় চীনের অব্যবস্থাপনার প্রভাব এবং মূল্যস্ফীতি কমানোর চেষ্টায় মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার বাড়ানোয় বদ্ধপরিকর থাকা সেই প্রবৃদ্ধি অর্জনকে অসম্ভব করে তুলবে। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কিছু অংশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার ফল এবং বৈশ্বিক সরবরাহ-শৃঙ্খল বিঘ্নিত হওয়াও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতার রাশ টেনে ধরবে।
সাত.
জাতিসংঘের বার্ষিক জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে (দুবাইয়ে অনুষ্ঠেয় কপ ২৮) হতাশার সুর অব্যাহত থাকবে। নিকট-মেয়াদি অর্থনৈতিক উদ্বেগগুলো মধ্যম এবং দীর্ঘমেয়াদি জলবায়ু বিবেচনাকে উপেক্ষা করবে। এতে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাব খারাপ থেকে খারাপতর অবস্থায় যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আট.
ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সম্পর্ক আরও সহিংস হয়ে উঠবে। কারণ, ইসরায়েল তার দখলদারিমূলক বসতি স্থাপনের কাজ প্রসারিত করবে এবং ইসরায়েল ও ফিলিস্তিন উভয়ের কাছে গ্রহণযোগ্য শর্তে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে ইসরায়েলের কূটনীতি এগোবে না। ‘দুই রাষ্ট্র সমাধান’ তত্ত্বের বদলে ‘এক রাষ্ট্র অ-সমাধান’ তত্ত্বই বাস্তবে পরিণত হওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হবে।
নয়.
ভারত মহা মহা কিছু অর্জন করবে বলে যাঁরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, দেশটি তাঁদের হতাশ করতে থাকবে। ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র ও তেল কেনা চালিয়ে যাবে এবং চীনের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের কাছ থেকে বড় ধরনের সহায়তা চাইলেও জোটনিরপেক্ষতার ভঙ্গিতে অনড় থাকবে। সবচেয়ে বিপদের বিষয় হলো, ভারত তার নিজ ভূখণ্ডে ক্রমাগত আরও অনুদার ও কম ধর্মনিরপেক্ষ হতে থাকবে।
দশ.
সম্ভবত ২০২৩ সালের সবচেয়ে জোরালো ইস্যু হবে ইরান। ইরানের অর্থনৈতিক অবনতি এবং সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আপস করা হবে, নাকি তাঁদের গ্রেপ্তার করে হত্যা করা হবে—এই নিয়ে নেতাদের মধ্যে দলাদলি বাড়বে এবং সেটি বিক্ষোভকে জনগণের কাছে আরও আকর্ষণীয় করে তুলবে। ২০১৫ সালে করা পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করা হবে না। এর ফলে রাশিয়াকে ইরানের সামরিক সহায়তা দেওয়ার সুযোগ খোলা থাকবে।
এসব আলামত নিয়ে একটি নববর্ষ শুভ না–ও হতে পারে। বছরটি যে আকর্ষণীয় ঘটনাবহুল হবে, তা নিশ্চিত।
******স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
রিচার্ড হাস কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের প্রেসিডেন্ট।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:জানুয়ারী ০৪, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,