লেখক:শওকত হোসেন।
মার্টিন উলফ লন্ডনভিত্তিক ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এর প্রধান অর্থনৈতিক বিশ্লেষক। তাঁকে বলা হয়েছিল, মাত্র তিনটি শব্দ ব্যবহার করে ২০২২ সালের অর্থনীতিকে বর্ণনা করতে হবে। মার্টিন বলেছিলেন, যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি ও জ্বালানিসংকটের ধাক্কা। এই তিন সংকটই কি একই রকম থাকবে নতুন বছরেও। তাহলে কেমন যাবে ২০২৩? সংকট কেটে যাওয়ার লক্ষণ কতটা?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি এবং জ্বালানিসংকটের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি সংকুচিত হবে। দেখা দেবে অর্থনীতির মন্দা। নতুন বছরে আরেকটি ঘটনা ঘটবে। তিন বছর বিরতির পর অর্থনীতিতে প্রবেশ করছে চীন। তারা সরে এসেছে ‘জিরো কোভিড’ নীতি থেকে। নতুন বছরে চীনের অংশগ্রহণের প্রভাব থাকবে বিশ্ব অর্থনীতিতে। অনেকেই মনে করছেন, এতে অর্থনীতি লাভবান হবে। আবার চীনের মাধ্যমে নতুন করে কোভিড ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও আছে। তাহলে এটাই হবে নতুন বছরের সবচেয়ে খারাপ ঘটনা।
মূল্যস্ফীতির চাপ থাকবে
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সামান্য কমলেও নতুন বছরেও উচ্চ মূল্যস্ফীতিই বজায় থাকবে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) প্রাক্কলন হচ্ছে নতুন বছরে মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে কমে সাড়ে ৬ শতাংশ হবে। তবে উন্নয়নশীল দেশগুলো এই চাপ থেকে এতটা রেহাই পাবে না। তাদের গড় মূল্যস্ফীতি থাকবে ৮ দশমিক ১ শতাংশ। জ্বালানি ও শিল্পের কাঁচামালের দাম বেশিই থাকবে। ফলে আমদানি ব্যয় খুব একটা কমবে না।
কমবে প্রবৃদ্ধি
আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো অন্তত তিন মাস আগেই বলে দিয়েছিল যে নতুন বছরে বিশ্ব অর্থনীতিতে জিডিপির প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ৭ শতাংশ, ২০২২ সালে যা ছিল ৩ দশমিক ২ শতাংশ। তবে সংস্থাটি মনে করে, প্রবৃদ্ধির হার আরও কমে ২ শতাংশের নিচে নেমে যাওয়ার আশঙ্কাও আছে। ইউরোপীয় দেশগুলোর সংগঠন ওইসিডির মতে, প্রবৃদ্ধি হবে আরও কম, ২ দশমিক ২ শতাংশ। এর অর্থ হচ্ছে নতুন বছরে বিশ্ব অর্থনীতি নিশ্চিত করেই মন্দায় ঢুকে যাবে। সাধারণত পরপর দুটি প্রান্তিকে অর্থনীতিতে ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধি হলে তাকে মন্দা বলা হয়। আর এর সঙ্গে যুক্ত হবে উচ্চ পণ্যমূল্য ও উচ্চ সুদহার। মূলত, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরো অঞ্চলের পরিস্থিতি এ রকমই থাকবে। তবে চীনের প্রবৃদ্ধি বাড়তে পারে।
খুলে যাচ্ছে চীন
কোভিড দেখা দেওয়ার পর থেকে তিনটি বছর চীন তাদের দুয়ার বন্ধই রেখেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘জিরো কোভিড নীতি’ থেকে তারা সরে যেতে বাধ্য হচ্ছে। দেশটির জনগণের প্রতিবাদের মুখে চীন এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যা খুবই বিরল ঘটনা। ৮ জানুয়ারি চীন আন্তর্জাতিক সীমানা খুলে দিচ্ছে। চীন এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ। দেশটির অর্থনীতির ওপর মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া বা থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলোর রপ্তানি আয় অনেকখানি নির্ভর করে। চীনের বিপুল ভোক্তার চাহিদা বাড়লে উৎপাদন বাড়বে। এতে সরবরাহব্যবস্থার উন্নতি হবে।
সব মিলিয়ে নতুন বছরের বড় ঘটনা হচ্ছে বিশ্ববাণিজ্য চীনের অংশগ্রহণ। এর আগে চীনের শেষ সরব উপস্থিতি ছিল ২০১৯ সালে। তখন ডোনাল্ড ট্রাম্প ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। সময়টা ছিল বাণিজ্যযুদ্ধের। মার্কিন প্রেসিডেন্ট এখন জো বাইডেন। নতুন পরিস্থিতিতে এই দুই বড় অর্থনীতির দেশের মধ্যকার সম্পর্কের ওপরও নির্ভর করছে নতুন বছরের অর্থনীতির গতিপথ।
আবার চাপে পড়ে চীন যেভাবে প্রস্তুতিহীনভাবে ঢুকছে, তাতে সংকট কিছুটা বাড়তে পারে বলেও কেউ কেউ মনে করছেন।
মন্দা কত দিন থাকবে
ব্রিটিশ পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) মনে করে, ২০২২ সালজুড়ে মূল্যস্ফীতির চাপ কমাতে যেভাবে সুদহার বাড়ানো হয়েছে, তাতে মন্দা ঘটবেই। ২০২৩ সালেও নীতি নির্ধারকেরা সুদহার বাড়ানো অব্যাহত রাখবে। কেননা উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। আর এভাবে সুদহার বাড়ানোর কারণে মুদ্রা সরবরাহ কমবে, ঋণ নেওয়া ব্যয়বহুল হবে। বিনিয়োগ কমবে। এতেই মন্দা দেখা দেবে।
প্রশ্ন হচ্ছে, মন্দা কত দিন থাকবে? বেশির ভাগই মনে করছেন, ২০২৩ সালের তৃতীয় প্রান্তিক (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত তা থাকবে। তবে কোথাও মন্দা গভীর হবে, কোথাও এর তেজ থাকবে কম। ওইসিডির প্রাক্কলন হচ্ছে, ২০২৪ সালে এসে মূল্যস্ফীতি কমে সাড়ে ৫ শতাংশ হবে। তার আগে সুখবর নেই। তত দিন পর্যন্ত মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা ফেডারেল রিজার্ভ (ফেড) এবং ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক (ইসিবি) মুদ্রানীতিকে সংকোচনমূলকই রেখে দেবে।
তবে অর্থনীতি ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংকুচিত হবে ঠিকই, তবে কেউ কেউ তাকে মন্দা বলতে নারাজ। যে নামেই ডাকা হোক না কেন, ২০২৩ সাল যে খুব ভালো যাবে না, এ বিষয়ে সবাই একমত। আবার প্রখ্যাত মার্কিন অর্থনীতিবিদ নুরিয়েল রুবিনিসহ কেউ কেউ মনে করেন, পরিস্থিতি আসলে আরও খারাপ হবে। যতটা আশার বাণী শোনানো হচ্ছে, পরিস্থিতি তত ভালো না।
গত সেপ্টেম্বরে আইএমএফ যেমনটা বলেছিল, ‘অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন। খারাপ সময় আসা এখনো আরও বাকি।’ আর বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে দিয়ে বলেছিল, মন্দা আসছে, তবে এর চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি হতে পারে। ঘটতে পারে স্ট্যাগফ্লেশন। অর্থাৎ উচ্চ মূল্যস্ফীতি-নিম্ন প্রবৃদ্ধি। এ ছাড়া ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) জরিপ করে বলেছিল, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ঋণ পরিশোধের সংকট এবং জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধিই হচ্ছে আগামী দুই বছরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় হুমকি।
জ্বালানিসংকটও থাকছে
জ্বালানি নিয়ে সবচেয়ে বিপদে আছে ইউরোপ, বিশেষ করে যারা রাশিয়ার গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি ফান্ড সম্প্রতি তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, ২০২৩ সালেও ইউরোপ গ্যাস–সংকটে ভুগবে। আর যদি বেশি শীত পড়ে, তাহলে সংকট আরও বাড়বে। যদিও ইউরোপের দেশগুলো নরওয়ে, কাতার ও ওমানের কাছ থেকে জ্বালানি নেওয়া বাড়িয়েছে, তবে তা পর্যাপ্ত না। আর চীন যদি অর্থনীতিতে পূর্ণশক্তি নিয়ে নামে, তাহলে জ্বালানির চাহিদা আরও বাড়বে, দামও তাতে বাড়তি থাকবে।
মানুষ কী বলছে
প্যারিসভিত্তিক বাজার গবেষণা সংস্থা ইপসস প্রতিবছরই বিশ্বব্যাপী একটি জরিপ করে। নতুন বছরটি কেমন যাবে, এটাই হচ্ছে জরিপের মূল বিষয়। বিশ্বের ৩৬টি দেশের ২৪ হাজার ৪৭১ জনের মধ্যে জরিপটি পরিচালনা করা হয়। গত ২১ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত জরিপটি করা হয়।
জরিপে অংশ নিয়ে সবচেয়ে বেশি, ৭৯ শতাংশই বলেছে, তারা মনে করে, তাদের দেশে মানুষের আয়ের তুলনায় মূল্যস্ফীতি বেশি হারে বাড়বে। ৭৫ শতাংশ বলেছে, তাদের ধারণা ২০২৩ সালে মূল্যস্ফীতি আগের বছরের তুলনায় বেশি হবে। ৭৪ শতাংশ মনে করে, সুদের হারও আগের বছরের তুলনায় আরও বাড়ানো হবে। ৬৮ শতাংশের মতে, নতুন বছরে বেকারত্বের হারও বাড়বে। আর ৫০ শতাংশ মনে করে, বিশ্বের প্রধান শেয়ারবাজারগুলোর পতন ঘটবে এবং ৪৫ শতাংশের ধারণা, তাদের দেশকে উদ্ধারের জন্য আইএমএফের কাছে যেতে হবে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সাধারণ মানুষও ২০২৩ সাল নিয়ে খুব একটা আশাবাদী নয়।
বাংলাদেশ কেমন থাকবে
গবেষণা সংস্থাগুলো বলছে, ২০২৩ সাল ইউরোপের কিছু দেশের জন্য যতটা খারাপ যাবে, অন্য সবার ক্ষেত্রে তেমনটি না–ও হতে পারে। বিশেষ করে এশিয়া তুলনামূলকভাবে ভালো করবে। এই ভালো করার ক্ষেত্রে চীনের একটি ভূমিকা থাকবে অবশ্যই, তবে নেতৃত্ব দেবে ভারত।
তাহলে বাংলাদেশ কেমন করবে? বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ মনে করে, প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের ওপরেই থাকবে। যদিও সরকারের আশা ৭ শতাংশের বেশি। তবে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘস্থায়ী মন্দায় থাকলে বাংলাদেশের জন্য তা দুঃসংবাদ। বলা হচ্ছে, জার্মানি, ইতালি ও যুক্তরাজ্যের অর্থনীতির মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হবে। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক খাতের বড় বাজার। আগের তুলনায় বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে বাংলাদেশ অনেক বেশি সংযুক্ত। ফলে রপ্তানি খাতে কিছু প্রভাব পড়বে। যদিও বাংলাদেশ উচ্চ মূল্য সংযোজন হয় এমন দামি পোশাক রপ্তানি করে না। ফলে খুব খারাপ প্রভাব না–ও পড়তে পারে। আর মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে যেহেতু সংশয় কম, তাই প্রবাসী আয় বাড়তে পারে। তবে এ জন্য ডলারের হার বাংলাদেশ আরও কতটা বাজারমুখী করে, তার ওপরই প্রবাসী আয় আসা বেশি নির্ভর করবে। নইলে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা আসবে, পাচারও হবে।
২০২৪ সালের শুরুতে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন সামনে রেখে ২০২৩ সালে সরকার অর্থ খরচ বাড়াবে। ব্যবসায়ীদের খুশি রাখতে নানাভাবে ঋণ দেওয়া হবে। ঋণ থাকবে সস্তা হয়ে। ফলে খেলাপি ঋণ কমবে না। বাজেটের আকার বড় হবে। নতুন নতুন প্রকল্প নেওয়া হবে। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমবে। তবে আইএমএফের ঋণ আসা শুরু হবে, যা কিছুটা স্বস্তি দেবে। এ জন্য কিছু সংস্কার কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকার বাধ্য হবে। এর প্রতিক্রিয়ায় সেবা খাতে ভর্তুকি কমানো হলে জীবনযাত্রায় ব্যয় বাড়বে। এতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমবে না। ফলে ২০২৩ সালের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি জটিলই থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
নিম্ন রাজস্ব আয় নিয়েই নতুন বছরে ঢুকেছে বাংলাদেশ। তবে নতুন বছরে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি থাকবে ব্যাংক খাত নিয়ে। এই সুশাসনের অভাব, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দুর্বল নজরদারি, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা, প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের চাপ—কোনো কিছুরই সুরাহা হয়তো হবে না।
সব মিলিয়ে নতুন বছর আসলে কেমন হবে, তা সঠিকভাবে প্রাক্কলন করা বেশ কঠিন। তবে শেষ পর্যন্ত রপ্তানি আয়, প্রবাসী আয় এবং কৃষি উৎপাদন ভালো হলে দুশ্চিন্তা অনেকটাই কমবে। এ আশাবাদ নিয়েই সুকুমার রায়ের ‘মনের মতন’ ছড়াটা দিয়ে লেখা শেষ করা যায়। মনে রাখতে হবে, এত কষ্টের মধ্যেও ২০২২ সালে বাংলাদেশ সুখী দেশের তালিকায় সাত ধাপ এগিয়ে গেছে। সুতরাং কে জানে নতুন বছরে হয়তো সবাই আনন্দময় গানই আবার গাইবে।
কান্না–হাসির পোঁটলা বেঁধে, বর্ষভরা পুঁজি,
বৃদ্ধ বছর উধাও হ’ল ভূতের মুলুক খুঁজি।
নূতন বছর এগিয়ে এসে হাত পাতে ঐ দ্বারে,
বল্ দেখি মন মনের মতন কী দিবি তুই তারে?
আর কী দিব?—মুখের হাসি, ভরসাভরা প্রাণ,
সুখের মাঝে দুঃখের মাঝে আনন্দময় গান।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:জানুয়ারী ০২, ২০২৩
রেটিং করুনঃ ,