১. ভোটার যন্ত্রে আঙুলের ছাপ দেওয়ার পর ব্যালট উন্মুক্ত হলো। কাপড় দিয়ে ঘেরা গোপন কক্ষে ভোট সম্পন্ন করতে গেলেন। এ সময় কোন মার্কায় ভোট দিয়েছেন, তা উঁকি দিয়ে প্রত্যক্ষ করছেন অবাঞ্ছিত ব্যক্তিরা। ২. ভোটার গোপন কক্ষে গিয়ে দেখলেন, সেখানে থাকা অবাঞ্ছিত ব্যক্তি তাঁর ভোট দিয়ে দিচ্ছেন। ৩. ভোটার গোপন কক্ষে প্রবেশ করার পর কোন মার্কায় ভোট দিতে হবে, তা বলে দিচ্ছেন অবাঞ্ছিত ব্যক্তি। বেশির ভাগ ভোটকক্ষের দৃশ্য ছিল এমনই।
গতকাল শনিবার ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে এভাবে ‘নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে’ ভোট গ্রহণ হয়েছে। ভোটকক্ষ, কেন্দ্রের ভেতরে এবং কেন্দ্রের আশপাশের এলাকায় নৌকার ব্যাজধারীদের একতরফা নিয়ন্ত্রণ ছিল। ফলে গোপন ভোট আর গোপন থাকেনি।
বেশির ভাগ কেন্দ্রে বিএনপিসহ অন্য দলের মেয়র বা কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্ট পাওয়া যায়নি। প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিএনপির মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর এজেন্ট আসেননি। কোথাও কোথাও এজেন্টকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়
তবে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া ভোটে বড় কোনো সংঘাতের ঘটনা ঘটেনি। দুই সিটিতে ভোটকেন্দ্র ছিল ২ হাজার ৪৬৮টি। কোনো কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ স্থগিত হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে মারমুখী ভূমিকায় খুব একটা দেখা যায়নি। তবে কোথাও কোথাও ভোটার ও কর্তব্যরত সাংবাদিকদের বাধা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
দুই সিটির সব কেন্দ্রে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট হয়েছে। সকাল আটটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত একটানা ভোট গ্রহণ চলে। যন্ত্রের সঙ্গে অনভ্যস্ততার কারণে কীভাবে ভোট দিতে হবে, তা ভোটারদের বুঝিয়ে দিতে দেখা যায় ভোট গ্রহণ কর্মকর্তা ও পোলিং এজেন্টদের। আঙুলের ছাপ মেলাতেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কয়েক দফা চেষ্টা করতে হয়েছে। ভোটার উপস্থিতি খুবই কম থাকায় কোথাও লম্বা সারি দেখা যায়নি।
প্রথম আলোর ৬৬ জন সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী দিনভর ঘুরেছেন। তাঁরা ৪২৭টি কেন্দ্র ঘুরেছেন। এর মধ্যে সকালে ১২৫টি কেন্দ্রের কিছু কিছু কেন্দ্রে বিএনপির এজেন্ট দেখা গেছে। তবে বেলা একটার পর তাঁদের আর পাওয়া যায়নি।
বুথ বা ভোটকক্ষের চিত্র আরও খারাপ। সব কেন্দ্রেই আওয়ামী লীগ–সমর্থিত মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীর পোলিং এজেন্ট দেখা গেছে। এর বাইরে নৌকার ব্যাজধারী আরও তিন–চারজন করে অবস্থান করতে দেখা যায়। তাঁদের এক বা দুজন সার্বক্ষণিক কাপড় ঘেরা গোপন কক্ষের আশপাশে তৎপর ছিলেন।
পুলিশের বাইরে কেন্দ্রগুলোতে আনসার সদস্যরা মোতায়েন ছিলেন। এর মধ্যে কিছু স্থায়ী আর কিছু ভোটের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন। আনসার সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অস্থায়ী সদস্যদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের সুপারিশে নিয়োগ পেয়েছেন। বেশির ভাগই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।
ভোটারদের অভিজ্ঞতা
মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে বেলা একটার দিকে ভোট দিতে ঢোকেন এক ব্যক্তি। কিছুক্ষণ পরে বুথ থেকে বের হয়েই চিৎকার শুরু করেন তিনি। কারণ, জাতীয় পরিচয়পত্র দেখিয়ে আঙুলের ছাপ দেওয়ার পর নিজে ভোট দিতে পারেননি। তিনি গোপন কক্ষে যাওয়ার আগেই সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তি বাটন চাপ দিয়ে তাঁর ভোট দিয়ে দিয়েছেন।
সংসদ ভবনের উল্টো দিকে রাজধানী উচ্চবিদ্যালয়ে স্কুলে প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করার কথা জানান দুজন ভোটার। তাঁদের অভিযোগ, সব প্রক্রিয়া শেষ করার পর বাটন চাপ দেওয়ার সময় এক অবাঞ্ছিত ব্যক্তি এসে নৌকা প্রতীকে ভোট দিতে চাপ দেন। তাঁরা নিজের ভোট দিতে না পেরে ক্ষুব্ধ হয়ে বেরিয়ে আসেন।
তেজগাঁওয়ের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট কেন্দ্রে একই ধরনের ঘটনায় লাঞ্ছিত হন একজন ভোটার। তিনি বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের মেয়র ও কাউন্সিল প্রার্থীর পক্ষে সভাও করেছি। কিন্তু তাঁদের ভোট দিতে গিয়ে পারিনি। বুথের ভেতরে এক যুবক জোর করে আমার ভোট দিয়ে দেন। প্রতিবাদ করলে বলপ্রয়োগ করে বের করে দেওয়া হয়।’
সকাল ১০টার দিকে কার্জন হল কেন্দ্রে ভোট দেন এক ব্যক্তি। ভোট দিয়ে বের হওয়ার পর বাইরে থাকা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাঁর কাছে জানতে চান, তিনি কোন প্রতীকে ভোট দিয়েছেন। ওই ব্যক্তি ধানের শীষে ভোট দিয়েছেন বলতেই তাঁকে মারধর শুরু করেন। তাঁরা তাঁকে মারতে মারতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ হলের দিকে নিয়ে যান।
আগেও নিয়ন্ত্রিত ছিল
এর আগে ১৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম–৮ আসনের উপনির্বাচনে সরব উপস্থিতির মাধ্যমে ভোটকেন্দ্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করেন আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীরা। ইভিএম পদ্ধতির ওই নির্বাচনেও ভোটার উপস্থিতি কম ছিল।
আর ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির নেতা–কর্মীদের দাঁড়াতে দেয়নি আওয়ামী লীগ। এ নির্বাচনে নেতা–কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড়ের পর বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে বিএনপি। এর আগে গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহীসহ বিভিন্ন সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীরা ভোটের দিন ঠিকভাবে এজেন্ট দিতে পারেনি। দলটির অভিযোগ, মামলা-হামলা ও গ্রেপ্তার-ভয়ভীতির কারণে তারা নির্বাচনে পোলিং এজেন্ট দিতে পারেনি।
সূত্র : প্রথম আলো
তারিখ: ফেব্রুয়ারী ০২, ২০২০
রেটিং করুনঃ ,