নয়াপল্টন ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরে রাজধানীর তৃতীয় কোনো জায়গায় সমাবেশ করা নিয়ে এখনো একমত হতে পারেনি বিএনপি এবং পুলিশ প্রশাসন। এ বিষয়ে গত দুই দিনে তিন দফা বৈঠকের পর জানা গেছে, পুলিশ এখনো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই বিএনপিকে সমাবেশ করতে দিতে চায়। অন্য দিকে বিএনপি নয়াপল্টন থেকে সরে এসে আশপাশের কোথাও সমাবেশ করার প্রস্তাব দিয়েছে।
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, এরপরও পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো বিকল্প না পেলে তাঁরা পল্টন এলাকাতেই সমাবেশ করবেন। তবু তাঁরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের মতো দেয়ালঘেরা জায়গায় যাবেন না। কারণ, নানা শঙ্কা ও বিবেচনায় এই মুহূর্তে তাঁরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে নিরাপদ ভাবতে পারছেন না।
এ ক্ষেত্রে সর্বশেষ ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীর বিভাগীয় গণসমাবেশে বৈরী অভিজ্ঞতার বিষয়টি বিবেচনায় নিচ্ছেন বিএনপির নীতিনির্ধারকেরা। সেখানে পুলিশ সমাবেশ মাঠের দুটি ফটকে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল। মঞ্চ তৈরিতেও বাধা দেওয়া হয়।
সমাবেশের দিন ভোর পর্যন্ত কাউকে মাঠে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। ফলে সকালে দুটি ফটক খুলে দেওয়া হলে হাজার হাজার নেতা-কর্মী একযোগে মাঠে ঢুকতে গিয়ে মারাত্মক দুর্ভোগের সম্মুখীন হন। অনেককে হুড়োহুড়িতে বিরক্ত হয়ে আশপাশের রাস্তায়, এখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে বক্তব্য শুনতে দেখা যায়। একই ঘটনা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেও যে হবে না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তা ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের প্রবেশপথগুলো এতটা সরু যে কোনো হুড়োহুড়িতে ভয়াবহ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে রাজশাহীর মতো শর্তানুযায়ী পুলিশ দুপুর ১২টায় উদ্যানের ফটক খুললে সারা দিনেও মাঠে কয়েক হাজার মানুষ জড়ো করা সম্ভব হবে না। মূলত জনসমাগম কমানোর জন্য এ রকম নানা ‘ফন্দি’ থেকে সরকার বিএনপিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে ঠেলছে বলে মনে করেন নেতারা।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করছেন, হঠাৎ গুলশানে খালেদা জিয়ার বাসার সামনে পুলিশের তল্লাশিচৌকি বসানো, নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তারে বিশেষ অভিযান পরিচালনা এবং সমাবেশের স্থান সরাতে চাপাচাপি—এসবের লক্ষ্য হচ্ছে আতঙ্ক সৃষ্টি করা, যাতে নেতা-কর্মীরা ভয়ে সমাবেশে যোগদানে নিরুৎসাহিত হন। পাশাপাশি এই সমাবেশ ঘিরে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ রাজধানীর পাড়া-মহল্লায় সতর্ক পাহারায় থাকবে বলে যে ঘোষণা দিচ্ছে, তার লক্ষ্যও একই। তারা বিএনপিকে চাপে ফেলে ঢাকায় জনসমাগম কমাতে চায়।
সরকার মনে করছে, বিএনপি নয়াপল্টন এলাকায় বড় জমায়েত করে সেখানে অবস্থান নিয়ে একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। সমাবেশস্থল নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনায় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের উল্লেখ করে পুলিশ এমন তথ্য জানিয়েছে।
অবশ্য এ ধরনের চিন্তাকে নাকচ করে দিয়েছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এবং ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশ প্রস্তুতি কমিটির প্রধান উপদেষ্টা মির্জা আব্বাস। গতকাল সোমবার নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘আমরা বসে পড়ব কেন? আমাদের বসে পড়া তো কাজ নয়। আমাদের কাজ হলো আমরা দুপুর ১২টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত সমাবেশ করব। এটাই হলো আমাদের কাজ। তারপর আমাদের কর্মীরা যার যার মতো বাসায় ফিরে যাবে।’
সংবাদ সম্মেলনে মির্জা আব্বাস সমাবেশের প্রচারপত্র বিলির সময় পুরান ঢাকায় দলের নেতা ইশরাক হোসেনের ওপর হামলা ও তাঁর গাড়ি ভাঙচুর, দলের মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক নাসির উদ্দিন অসীমের বাসায় হামলা, নয়াপল্টনে দলের কার্যালয়ের সামনে ককটেল ফোটানো এবং গতকাল সকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাঁর শাজাহানপুরের বাসা ঘেরাও করার কথা তুলে ধরেন।
মির্জা আব্বাস বলেন, ‘আমার বাসায় আজকে একটা কর্মী সভা ছিল। সেখানে শান্তিপূর্ণ মিটিংয়ের বিষয়ে আমি নির্দেশনা দেব, সেটা আমাকে করতে দেওয়া হলো না। চারদিক থেকে আমার বাড়ি ঘিরে ফেলল সিভিলে ও পোশাকধারী পুলিশ। এটা কেন? আমরা কি নিজের বাসায় নিরাপদ না? আমরা কি নিজের অফিসে নিরাপদ না? এই দেশ, এ জাতি কি একটা সন্ত্রাসীদের হাতে পড়ে গেছে?’
বিএনপির নেতারা বলছেন, পুলিশ এবং ক্ষমতাসীনদের হামলা, বাধা, পরিবহন ধর্মঘটসহ নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও তাঁরা ধৈর্যের সঙ্গে নয়টি বিভাগীয় সমাবেশ করেছেন। এই কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে করতে গিয়ে দলের একজন সাবেক সংসদ সদস্যসহ একাধিক নেতা নিহত হয়েছেন, আহত করা হয়েছে অসংখ্য নেতা-কর্মীকে। এরপরও তাঁরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিতেই আছেন।
বিএনপির নেতারা মনে করেন, সর্বশেষ ঢাকার গণসমাবেশ নয়াপল্টনে নাকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে হবে—এ নিয়ে বিতর্ক দেখা দিলে বিএনপি এই দুই জায়গার বাইরে তৃতীয় কোনো জায়গায় সমাবেশ করার প্রস্তাব দিয়ে জেদাজেদির পথ থেকে সরে এসেছে। এতে সমঝোতার একটা পথ তৈরি হয়েছে। এখন সরকার এই প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে যদি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই জেদ ধরে থাকে, তাতে যে এর পেছনে সরকারের অসৎ উদ্দেশ্য রয়েছে, সেটি প্রমাণিত হবে। শেষ পর্যন্ত এমন কিছু হলে তার সব দায়দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তাবে।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা তাদের (বিএনপি) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সমাবেশের অনুমতি দিয়ে রেখেছি। এখন পর্যন্ত আমরা কোনো বিকল্প স্থানের প্রস্তাব পাইনি। খোলা মাঠ ছাড়া রাস্তাঘাটে কোনো সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না।’
দলের উচ্চপর্যায়ের মূল্যায়ন হচ্ছে, ঢাকায় সমাবেশের স্থান নিয়ে সরকার পরিকল্পিতভাবে একটা উসকানিমূলক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে চাইছে, যাতে বিএনপি অহিংস আন্দোলনের পথ থেকে সরে এসে সংঘাতে জড়ায়। আর সেটি এখনই শুরু করা গেলে বিএনপি যে অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর যুগপৎ আন্দোলনে নামার ছক করেছে, তা নষ্ট হয়ে যাবে।
বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকারের ঠিক করে দেওয়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে, নাকি নিজের পছন্দের নয়াপল্টনেই সমাবেশ করবে—এ নিয়ে দলের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দুটি মত আছে। অনেকে নয়াপল্টনেই সমাবেশ করার ব্যাপারে অনমনীয়। আবার কেউ কেউ মনে করছেন, সমাবেশের স্থল নিয়ে এখনই সংঘাতে জড়ানো যাবে না। এতে এত দিনের অহিংস আন্দোলনের অর্জন বিফলে যাবে। এ জন্য নয়াপল্টন থেকে সরে এসে বিকল্প কোনো জায়গার নাম প্রস্তাব করা হয়েছে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘যার বিরুদ্ধে আন্দোলন, যার কাছ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য এই আন্দোলন, তার নির্দেশনায় আন্দোলনের সিদ্ধান্ত হতে পারে? সে বলবে অমুক খানে যাও, এটা করতে পারবে, এটা করতে পারবে না—এটা কি কখনো হতে পারে?’
বিএনপির সূত্রে জানা গেছে, নয়াপল্টন ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বাইরে ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ করার বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্তে পৌঁছেনি বিএনপি ও পুলিশ প্রশাসন। এ বিষয়ে কথা বলতে গতকাল বিকেলে পুলিশের প্রতিনিধি মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার হায়াতুল ইসলাম খানের কার্যালয়ে গিয়েছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী।
গতকাল রাত পৌনে ১০টায় শহীদ উদ্দীন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি (হায়াতুল ইসলাম খান) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই সমাবেশ করার জন্য অনুরোধ করেছেন। আমি বলেছি, সেখানে আমরা নিরাপদ মনে করি না। নয়াপল্টন নিয়ে যখন এতই আপত্তি, তাহলে আমরা আরামবাগে আইডিয়াল স্কুলের সামনে করি। তিনি বলেছেন, কথা বলে জানাবেন, এখন পর্যন্ত কিছু জানাননি।’
বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, জনসমাগম যা-ই হোক, ১০ ডিসেম্বর তাঁরা যেকোনো মূল্যে সমাবেশ করবেন। এ লক্ষ্যে সাংগঠনিক প্রস্তুতি চলছে। গতকাল বিকেলে বিএনপির চেয়ারপারসনের গুলশানের কার্যালয়ে বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদের সঙ্গে প্রস্তুতি সভা হয়।
সভায় পেশাজীবী নেতাদের উদ্দেশে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘গোটা বাংলাদেশ জেগে উঠেছে। আমাদের কর্মসূচির মধ্যে ছিল ১০টি বিভাগীয় সমাবেশ। ৯টি আমরা সফল করেছি। এ দেশের মানুষ সফল করেছে।…এই সমাবেশের দিকে বাংলাদেশের মানুষ, গোটা পৃথিবীর মানুষ তাকিয়ে আছে। এই সমাবেশ আমাদের যেকোনো মূল্যে সফল করতে হবে।’
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:ডিসেম্বর ০৬, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,