কোনো বাছবিচার ছাড়া বিদেশি উৎস থেকে ধার করে দেশকে ঋণের সাগরে ভাসিয়ে গেছে শেখ হাসিনার সরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, চলতি বছরের জুন শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১০৩.৭৯ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। বাংলাদেশি মুদ্রায় এই ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় (১২০ টাকা দরে) ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা।
অথচ ২০০৮-০৯ সাল শেষে সরকারের বিদেশি ঋণ ছিল ২১.১৯ বিলিয়ন ডলার।
গত ডিসেম্বরের শেষে সরকারি ও বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণে স্থিতি ছিল ১০০.৬৪ বিলিয়ন বা ১০ হাজার ৬৪ কোটি ডলার। অর্থাৎ ২০২৪ সালের প্রথম ছয় মাসেই প্রায় ৩.৩৬ বিলিয়ন ডলার বিদেশি ঋণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গতকাল বুধবার বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সাবেক সরকারের যথাযথ ঋণ ব্যবস্থাপনা না থাকায় দেশি উৎস থেকে বেশি পরিমাণে ঋণ নেওয়া হয়েছে।
যদিও বৈদেশিক মুদ্রায় বিদেশি ঋণ নেওয়াকে সব সময় স্বাগত জানান অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা। গত ১৫ বছরে অনেক বিদেশি ঋণও নেওয়া হয়েছে। তবে এসব ঋণের বেশির ভাগই নেওয়া হয়েছে দর-কষাকষি ও বাছবিচারহীনভাবে; যা সরকারের দায়দেনা পরিস্থিতিতে চাপ বাড়িয়েছে।
২০২৪ সালের জুন শেষে বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণ দাঁড়িয়েছে ২০.৫৭ বিলিয়ন ডলার।
ডিসেম্বর শেষে এই ঋণ ছিল ২০.৯৫ বিলিয়ন ডলার। গত বছরের অক্টোবর শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ২১.২৮ বিলিয়ন ডলার থাকলেও চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ৯ মাসে বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণ কমেছে ৭০৬ মিলিয়ন ডলার। জুন পর্যন্ত মোট বিদেশি ঋণের ১১.৪০ বিলিয়ন স্বল্পমেয়াদি এবং ৯.১৭ বিলিয়ন ডলার দীর্ঘমেয়াদি ঋণ।
প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, গত মার্চে দেশের মোট বিদেশি ঋণ কমে ৯৯.৩০ বিলিয়ন ডলার হয়েছিল। কিন্তু ডলার সংকটসহ নানা কারণে বিদেশি সংস্থাগুলো থেকে নেওয়া ঋণের ফলে মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে আবার বেড়ে ১০৪ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, করোনা মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী আর্থিক সংকট তৈরি হওয়ার পর বিদেশি ঋণে সুদের হার বেড়ে যায়। পাশাপাশি টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়নে বিপাকে পড়েন বিদেশি ঋণ নেওয়া ব্যবসায়ীরা। এ জন্য বিদেশি ঋণ নেওয়ার চেয়ে পরিশোধে মনোযোগী হন তাঁরা। কিন্তু ডলারের দর স্থিতিশীল হওয়া এবং ঋণে সুদের হার বাড়তে থাকায় তাঁরা ফের বিদেশি ঋণ নিতে শুরু করেছেন।
জানতে চাইলে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, ঋণ বাড়লেও পরিশোধ করার সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে সরকারকে। তাহলে এই ঋণ কোনো শঙ্কা তৈরি করবে না।
ব্যয়বহুল প্রকল্প, সাবেক সরকারের ঋণের স্ফীতি ও পুঁজি পাচার নিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন, ২০০৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত মেগাপ্রকল্পগুলো, যেমন—পদ্মা বহুমুখী সেতু, ঢাকা মেট্রো রেল, ঢাকা শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর এসব করতে গিয়ে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। দুঃখজনক হলো, এসব ঋণের অর্থে চলমান প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যখন সম্পন্ন হবে তখন প্রকল্পগুলোর আয় থেকে ঋণের কিস্তির অতি সামান্য অংশই পরিশোধ করা সম্ভব হবে।
তিনি আরো বলেন, “বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ কিংবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এখনো ‘সফট লোন’ পাওয়া গেলে আমরা নিতে আগ্রহী হই। কিন্তু আমাদের বৈদেশিক ঋণের বেশির ভাগই এখন ‘সাপ্লায়ারস ক্রেডিট’। এর অসুবিধা হলো জোগানদাতারা প্রকল্পের প্লান্ট, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ঋণ হিসেবে দেওয়ার সময় প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দাম ধরে ঋণের পরিমাণকে বাড়িয়ে দেয়।
এর সুদের হারও সফট লোনের সুদের হারের চেয়ে বেশি, ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও কম থাকে। আরো গুরুতর হলো, সাপ্লায়ারস ক্রেডিটে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ব্যবসায়ী ও আমলাদের ‘মার্জিনের হার’ অনেক বেশি হয়ে থাকে। সে জন্য বাংলাদেশের মেগাপ্রজেক্টগুলোর ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক হয়ে যাচ্ছে। ২০০৯ সাল থেকে সাপ্লায়ারস ক্রেডিটের প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়েছে বাংলাদেশ।”
এসব সমস্যার সমাধানে সরকারকে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন ও পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর দমননীতি গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করেন মইনুল ইসলাম। এ জন্য সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কঠোরভাবে হুন্ডি ব্যবস্থাকে দমন।
সূত্র:কালের কন্ঠ।
তারিখ: সেপ্টম্বর ১৭, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,