খ্রিষ্টবিশ্বাসের কেন্দ্রীয় রহস্যাবৃত ঘটনাটি হলো যিশুর মৃত্যু ও পুনরুত্থান। পুনরুত্থান করেই যিশু মৃত্যুর ওপর জয় ঘোষণা করেছেন। পুনরুত্থান করেই বিজয়ীর কণ্ঠে যেন যিশু বলছেন, ‘হে মৃত্যু! হে কবর! তোমার জয় কোথায় হলো?’ আমরা বলতে পারি, কবর যিশুকে ধরে রাখতে পারেনি। যিশুর মৃত্যু শুধু মনুষ্যপুত্রের দেহাবসান নয়, তাঁর মৃত্যু গোটা মানবজাতির পাপের মৃত্যু। পাপের ফলে স্বর্গের যে দুয়ার হয়ে গিয়েছিল রুদ্ধ, যিশুর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই মন্দিরের পর্দা সরে গেল, রুদ্ধ দুয়ার খুলে গেল। যিশুর পুনরুত্থান, তথা যিশুর পুনরুত্থিত অবস্থা, গৌরবান্বিত অবস্থা গোটা মানবজাতিকে করেছে পুনরুত্থিত, গৌরবান্বিত।
মাগদালার মারিয়া রোববার দিন ভোরে যিশুর কবরে যান। দেখতে পান শূন্য কবর। শুভ্র পোশাক পরা এক যুবক ডান দিকে বসা। তিনি বলেন, ‘নাজারেথের যিশু পুনরুত্থিত হয়েছেন, তিনি এখানে নেই।’ শূন্য কবর যেন মারিয়ার অন্তরে দিয়েছিল এক তাগিদ, একটি জোর আহ্বান। এই পুনরুত্থান–সংবাদ তাঁকে ঘোষণা করতেই হবে। আর মারিয়া তখনই তা করেন; হয়ে ওঠেন প্রথম পুনরুত্থানের বার্তাবাহক (মর্ক ১৬: ১-৭)।
প্রতিটি মানুষের জীবনে, কোনো পরিবারে, কোনো সমাজে, কোনো দেশে, এমনকি এই পৃথিবীতে যখন কোনো কিছু ঘটে, হোক তা সুখময় বা দুঃখময়, পুণ্যময় বা পাপময়, আশাব্যঞ্জক বা নৈরাশ্যকর, তিক্ত বা সর্বনাশা, আনন্দময় বা বিষাদময়, সেই ঘটনাকে বা সেই অবস্থাকে আমরা যদি একটু মনোযোগী হয়ে, ধ্যানমগ্ন হয়ে গঠনমূলক মনোভাব নিয়ে পর্যালোচনা করি, অন্তরের গহনে ধারণ করে সার্বিকভাবে বিবেচনা করি, তখন আমরা অবশ্যই অন্তরে একটি তাগিদ অনুভব করব, যদি সচেতন থাকি। অন্তরে একটি ডাক শুনতে পাই। সেই ঘটনা বা অবস্থা যেন হয়ে ওঠে একটি আহ্বান। পরিত্যাগ বা গ্রহণ করার আহ্বান, হয়ে ওঠার বা হওয়ার আহ্বান।
কোভিড–১৯ একটি উদাহরণ। ‘করোনাভাইরাস’ আহ্বান জানাল, তাগিদ দিচ্ছে নিজেকে রোগমুক্ত রাখার জন্য সচেতন হতে, মাস্ক ব্যবহার করতে, হাত ধোয়া, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ইত্যাদি ব্যবহার করতে। অন্যকে ক্ষতি না করতে; তাই সামাজিক দূরত্ব। আমি রোগ দেব না; তুমিও আমাকে দেবে না। করোনা আহ্বান জানায় শান্ত, সুস্থ ও নিরাপদে থাকতে, ঘরে নিরাপদে থাকতে, পারিবারিক বন্ধনকে অধিকতর দৃঢ় করতে; পারিবারিক প্রার্থনা করার আহ্বান জানায় এই করোনা! বর্তমানের করোনার আহ্বান হলো টিকা নেওয়ার আহ্বান। এভাবে আরও দেখি, একজন কঠিন রোগ থেকে সুস্থ হয়েছে। তাগিদ আসে তার কাছে যেতে; আনন্দ করতে। আরও অনেক জীবনকেন্দ্রিক উদাহরণ টানতে পারি।
যিশুর পুনরুত্থান একটি আহ্বান, একটি তাগিদ। যিশুর পুনরুত্থান হলো পাস্কা, যার বাইবেলীয় অর্থ ‘লাফিয়ে পার হওয়া’। ইসরায়েল জাতি মোশির নেতৃত্বে লোহিত সাগর পার হয়ে মিসরীয় দাসত্ব থেকে রেহাই পেয়েছিল; সাগর পার হয়ে নতুন দেশে পদার্পণ করেছিল। যিশুর পুনরুত্থান এই ঘটনারই পূর্ণতা। যিশুর পুনরুত্থানে গোটা মানবজাতি পাপের রাজ্য থেকে পেয়েছে নতুন জীবন। তাঁর নতুন জীবনে মানবজাতি পেয়েছে নতুন জীবন। প্রশ্ন: যিশুর পুনরুত্থান ঘটনা, পুনরুত্থান মহোৎসব আমাদের কী আহ্বান জানায়? যিশুর পুনুরুত্থান নতুন জীবনের আহ্বান। ঈশ্বরের পরিকল্পনা মতেই যিশুর মৃত্যু ও যিশুর পুনরুত্থান। ঈশ্বরের পরিকল্পনা হলো মানুষের হারানো মর্যাদাকে ফিরিয়ে আনা; মানুষকে পরিত্রাণ করে আবার তার সান্নিধ্যে নিয়ে আসা। যিশুর পুনরুত্থান এই পরিকল্পনারই বাস্তবায়ন। যিশুর পুনরুত্থান গোটা মানবজাতির পুনরুত্থান। অতএব প্রতিবছর পুনরুত্থান বা পাস্কা মহোৎসব আমাদের ‘পুনরুত্থিত’ হওয়ার তাগিদ দেয়; নতুন হওয়ার আহ্বান জানায়। আসুন চিহ্নিত করি সেই আহ্বান:
—আর নয় কবরে পড়ে থাকা; পাপের গহ্বরে পড়ে থাকা। পাপমুক্ত নবজীবন শুরু করার আহ্বান।
—শূন্য কবর দেখার আহ্বান—প্রত্যেকেই যেন ‘শূন্য কবর’ দেখার অভিজ্ঞতা অনুভব করি। মৃত্যুঞ্জয়ী যিশুর অভিজ্ঞতা অনুভব করি। আমার সত্য-সুন্দর জীবন হোক পুনরুত্থিত যিশুর আবাস। আমার পরিবার হোক পুনরুত্থিত যিশুর আবাস।
—চেতনায় অন্তর-বাইরে নতুন হওয়ার আহ্বান—পুরাতন বদভ্যাস ত্যাগ, অসৎ চিন্তা বর্জন, অসৎ কামনা-বাসনা, ষড়যন্ত্র, ফন্দিফিকির, আত্ম–অহম, স্বার্থপরতা, বৈষম্য, পদলেহন, পক্ষপাতিত্ব, সুপ্ত বা সূক্ষ্ম রাজনীতি-কূটনীতি, প্রশাসনিক দাম্ভিকতা, অন্যায় অন্যয্য এই মন্দগুলোই হলো বর্তমান যুগের ‘ভাইরাস’। এগুলো করোনার চেয়েও মারাত্মক। অতএব এবারের পুনরুত্থান এসব মন্দ ভাইরাস নির্মূল করার আহ্বান। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনৈতিক এই ভাইরাসগুলোকে নির্মূল করে পুনরুত্থিত যিশুর সঙ্গে যেন হতে পারি পুনরুত্থিত।
কদিন পরেই বাংলা নতুন বছর শুরু হবে। পয়লা বৈশাখও পুনরুত্থান উৎসব। পয়লা বৈশাখ তো নতুন হওয়ার আহ্বান জানায়। জীর্ণ–পুরাতন নিপাত যাক; ঝরে মুছে যাক পুরাতন; বৈশাখে নতুন পাতার মতোই জীবন হোক নতুন। এটাই তো বৈশাখের আহ্বান। আসুন, যিশুর পুনরুত্থানে, পয়লা বৈশাখে নতুন হওয়ার আহ্বান শুনি। নতুন হই অন্তর-বাহির। যিশুর পুনরুত্থান উৎসব এভাবেই হয়ে উঠুক নিত্যদিনের মহোৎসব। ‘যিশুর পুনরুত্থান, নতুন হওয়ার আহ্বান’ স্লোগানটি হোক নিত্যদিবসের স্লোগান, নিত্যদিনের আহ্বান। হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাইকে পাস্কা মহোৎসবের শুভেচ্ছা জানাই। হ্যাপি ইস্টার!
লেখক: ফাদার প্যাট্রিক গমেজ ক্যাথলিক ধর্মযাজক, সেন্ট আন্তনী’স ক্যাথলিক চার্চ, মহিপাড়া, দুর্গাপুর-রাজশাহী এবং আহ্বায়ক, খ্রিষ্টীয় ঐক্য ও আন্তধর্মীয় সংলাপ কমিশন, রাজশাহী ধর্মপ্রদেশ।
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: এপ্রিল ০৪, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,