#বইকথা# ভারতের হিজড়ে সমাজ ,অজয় মজুমদার ও নীলয় বসু।
পৃথিবীর প্রাচীনতম পেশা বেশ্যাবৃত্তি নিয়ে নিকি রবার্টস এর অসাধারণ একটি বই Whores in History প্রকাশিত হয়েছিল হারপার কলিংস থেকে 1992 সালে।নিকি সেখানে এই প্রাচীন পেশার মানুষগুলো সম্বন্ধে বলেছেন ‘দ্য মোস্ট ম্যালাইনড উইমেন’!দ্ব্যার্থহীন ভাষায় সমাজকে চাবকেছেন: Open your eyes and see the real issue. Eunuchs in History বলে কোন বই এখনও চোখে পড়েনি আমার। কিছু আর্টিকেল লেখা হয়েছে ইতঃস্তত। কিছু বছর আগে অজয় মজুমদার ও নিলয় বসুর একটি বই ‘ভারতের হিজড়ে সমাজ ‘ আমার হাতে এসেছিল।বইটি প্রকাশিত হয়েছিল 1997 সালে দীপ প্রকাশনী থেকে। অনেক সমস্যা পেড়িয়ে বহুপরিশ্রমে গবেষণালব্ধ একটি বই ,বলতে গেলে দলিল এটি।
কদিন আগেই লাঞ্ছিত বঞ্চিত অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠী শূদ্রদের কথা বলছিলাম। অমৃতের পুত্র নাকি আমরা সবাই। কিন্তু এরা কারা? কার পুত্রকন্যা এরা? ছেলে নাচিয়ে বেড়ায়,ট্রাফিক সিগন্যালে টাকা তোলে,ট্রেনে টাকা তোলে। ছেলেবেলায় গ্রামে এলে পিছন পিছন ঘুরে বেড়াতাম।বড়রা ফিসফিস করত। আজ আমিও বড় হয়েছি। আমিও কেমন আড় চোখে দেখি, কোনদিন সহজ হতে পারি নি তেমন।আমার যাতায়াতের পথে ইদানীং সুন্দরীকে দেখি আমি।কি নাম ওর জানি না।আমাদেরই দেওয়া নাম এটা। আমাদের কাছে টাকা চায় না।আমরা বছরে কোন অনুষ্ঠানের আগে ওর হাতে কিছু দিই অনেকেই।রেজিনগর ষ্টেশনে চাসিগারেট খাওয়ার নিত্যদিনের অভ্যেস আমাদের।বন্ধুরা তখনও কেউ আসেনি।আমি একাই ছিলাম। সুন্দরী দূরে বসেছিল। হঠাৎই দাম দিতে চাইল।নিষেধ করা সত্ত্বেও দিল চাসিগারেটের দাম।এও জীবনের একটা সঞ্চয় আমার।এটা বললাম এই কারণে যে এখান থেকে বোঝা যায় স্নেহের ফল্গুধারা ভালোবাসার প্রস্রবণ ওদের শরীরজুড়েও বহে যায়।
ওরা কারা!ওরা হিজড়ে।হিজড়ে শব্দটি এসেছে সেমেটিক শব্দ হিজর থেকে।হিজর মানে গোত্র বহির্ভূত।নামে কিবা এসে যায় বললে ত হবে না!নামেই পাওয়া যাচ্ছে এদের পরিচয়। মহাভারতের কাল থেকেই মানুষ জেনে এসেছে শিখন্ডী মানে অশুভ,মুখ দেখলে অযাত্রা।ভীষ্মকে হারতে হয়েছিল, কৌরবদের হয়েছিল পরাজয়।এটা ভেবে দেখতে সমাজ আমাদের শেখায় নি বিজেতা পান্ডবদের সব সময়ের সঙ্গী কিন্তু ছিল ঐ শিখন্ডী। ইতিহাস বলে সম্রাট গিয়াসউদ্দিনেকে প্রতি সকালে দেখে প্রজারা সুখেই থাকতেন!সমাজ কিছুই দেয়নি এদের। নাম দিয়েছে অনেক — শিখন্ডী, নপুংসক,হিজড়ে,ইউন্যাক্স,আরভানি,অরুভানি, জাগাপ্পা ইত্যাদি।সমাজ বিচ্ছিন্ন এক জনগোষ্ঠী,মানমর্যাদাহীন এক জনসমাজ সমাজের মূল স্রোতে থেকেও নেই; আবর্জনাসম পড়ে আছে এক পাশে। ইন্দোনেশিয়ায় একটি বিখ্যাত জনপ্রিয় নাচ লেঙ্গার লানং। শুধুমাত্র পুরুষরা নারী সেজে নাচতে পারেএ নাচ ।
অর্ধনারীশ্বর ভাবনা থেকেই হয়ত! বিবর্তনের ইতিহাসে বহু জীবের মধ্যেই এই বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। এরা মূলতঃ শিবের উপাসক। এদের আরাধ্য দেবীও আছে। দেবীর নাম দেবী বহুচেরা। মৃত্যুর আগে প্রায়োবেশন করে: জল ছাড়া কিছুই খায় না। মারা গেলে গোপনে লোক চক্ষুর অন্তরালে শেষকৃত্য সম্পন্ন হয় নিজের নিজের পিতৃপুরুষের ধর্ম অনুযায়ী।
এই বইএ হিজড়ের শরীরতত্ত্ব, ছদ্মবেশী হিজড়া, কৃত্রিম উপায়ে হিজড়ে করনের প্রক্রিয়া , ইতিহাস ও তার উৎস, হিজড়ে সমাজ, সংস্কৃতি ও ধর্ম, তাদের সাথে অন্ধকার জগতের সম্পর্ক, এদের মনস্তত্ত্ব, যৌনজীবন ইত্যাদি বিস্তারিত আলোচনার মধ্য দিয়ে হিজড়েদের সমস্যার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র উপস্থিত করতে সক্ষম হয়েছেন লেখকদ্বয়।একটি অধ্যায়ে এদের সমস্যার প্রতিকারের কিছু যুক্তিপূর্ন ঈঙ্গিত লেখক দিয়ে রেখেছেন। কিছু অসাধারণ ছবিও আছে ভিতরে।
হিজড়েদের দলে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধীর সংখ্যা খুবই কম। দিল্লির সর্বভারতীয় হিজড়ে কল্যাণ সমিতির সভার একটি সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে জানা যায় সারা ভারতে জন্মগত যৌন প্রতিবন্ধীর সংখ্যা মাত্র 213। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে প্রতি লক্ষে একজন মাত্র যৌন প্রতিবন্ধী শিশুর জন্ম হয়।সমাজ বিজ্ঞানী Vyas এবং Shingala তাদের সমীক্ষায় একই কথা বলেছেন। বিশিষ্ট তামিল সাহিত্যিক R Nurullah তার বই ‘আলকল ওয়ালকারি ‘(1990) তে উল্লেখ করেছেন সারা ভারতে মোট 11 লক্ষ হিজড়ের মধ্য 2 শতাংশ জন্মগত হিজড়ে। হিজড়ে সমাজে এদের স্থান খুব উচ্চে ,সম্মানের। এরাই গুরুমা হোন।এ রা বিশ্বাস করে গুরুমা অলৌকিক ক্ষমতধারী, উনার অনুশাসনে ওদের সমাজ চলে। এই বইএ সারা ভারতের মহল্লার নাম ও তাদের গুরুমার নাম আছে, আদমসুমারীর রিপোর্ট আছে। জন্মগত প্রতিবন্ধী ছাড়াও হিজড়ে দলে আছে কিছু ভিন্ন ধরনের মানুষ।এরাই সংখ্যাগুরু। এদের চার ভাগে ভাগ করা হয়েছে –আকুয়া(বিপরীত সাজসজ্জা কামী ও যৌন পরিবর্তনকামী ),জেনানা (পুরুষ ),ছিবড়ি( মহিলা),ছিন্নি( খোজা)। আর্থসামাজিক কারণে জেনানা বা সম্পূর্ণ পুরুষ ও ছিবড়ি বা সুস্থ মহিলা হিজড়ে দলে নাম লিখিয়েছে।
সুখের কথা আমাদের দেশ 2014 সালে এদের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ভোটার কার্ড,রেশন কার্ড চাকরী ক্ষেত্রে সংরক্ষণ ইত্যাদির মাধ্যমে কিছুটা হলেও সুযোগ তারা পাবে এখন।মানবী মুখোপাধ্যায়ের মত অনেকেই মূল স্রোতে ডিগনিটির সাথে মাথা উঁচু করে বেঁচে আছেন। আরও মানবী উঠে আসুক এই সমাজে এই প্রত্যাশায়—-
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখঃ ফেব্রুয়ারী ১৭, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,