বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়েছে। তিনি যে কূটনৈতিক পাসপোর্ট নিয়ে পালিয়ে গিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তার আওতায় নির্ধারিত মেয়াদ ৪৫ দিন শেষ হয়েছে। এখন তিনি ভারতে- কী অবস্থায়, কোন মর্যাদায় অবস্থান করছেন, তা নিয়ে নানা জল্পনা। এরই মধ্যে ফিনান্সিয়াল টাইমস তাকে নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে,
ছাত্র নেতৃত্বাধীন গণঅভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের স্বৈরাচারী নেত্রী শেখ হাসিনা গত মাসে ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে তিনি ভারতে যাওয়ার পর থেকেই দিল্লির নৈশভোজগুলোতে আলোচনার বিষয় হচ্ছে হাসিনা এখন ঠিক কোথায়?
৫ই আগস্ট যখন বিক্ষোভকারীরা তার ঢাকার বাসভবনের দিকে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যায় তখন হাসিনা পদত্যাগ করেন। পরে বাংলাদেশের একটি সামরিক হেলিকপ্টার যোগে ভারতের গাজিয়াবাদের কাছে একটি বিমান বাহিনীর ঘাঁটিতে অবতরণ করেন। তখন থেকেই শেখ হাসিনা ভারতে অবস্থান করছেন এ বিষয়টি নরেন্দ্র মোদির প্রশাসন নিশ্চিত করেছে। এর চেয়ে বেশি কিছু জানায়নি ভারত। তবে বিষয়টি নিয়ে মানুষের আলোচনা চলছেই।
বিশ্বাসযোগ্যতায় গড়মিল আছে। কিন্তু ভারতের একটি শ্রেণির সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে দাবি করেছেন যে, ক্ষমতাচ্যুত শক্তিশালী নারী (হাসিনা) ভারতীয় সরকারের একটি নিরাপদ বাসভবনে রয়েছেন। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দিল্লিভিত্তিক আঞ্চলিক পরিচালকের দায়িত্ব নেয়া নিজ মেয়ের সাথে আছেন, এমনকি তাকে তার সঙ্গীদের সঙ্গে ভারতের রাজধানীর অন্যতম সেরা পার্ক লোধি গার্ডেনে ঘুরে বেড়াতেও দেখা গেছে।
মোদি সরকার, হাসিনার ঘনিষ্ঠ বিদেশি সমর্থক ছিল। যখন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের ক্ষমতায় ছিল তখন তাদের শাসনের বিষয়ে মোদি প্রশাসন ছিল নিশ্চুপ। দিল্লির দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমগুলো বেশিরভাগই এই ভান করা থেকে বিরত রয়েছে যে, তারা হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত-পরবর্তী প্রথম সাক্ষাৎকারটি পাবে।
এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। হসিনার পতনের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। জুলাই অভ্যুত্থানে শত শত হত্যার জন্য হাসিনাকে দায়ী করেছে ড. ইউনূসের সরকার। ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে একটি প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। ২০১৩ সালে চুক্তিটি করেছিল হাসিনার সরকার। তত্ত্বগতভাবে এই চুক্তিকে তার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা যেতে পারে, যদি বাংলাদেশের নতুন সরকার তাকে গ্রেপ্তার করতে চায়।
ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসকে বলেছেন, ‘ভারতের সাথে প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী, আমরা তাকে (হাসিনাকে) বাংলাদেশের কাছে প্রত্যর্পণের দাবি জানাতে পারি। আপাতত, আমরা আশা করি ভারত তাকে বাংলাদেশে অস্থিতিশীলতা ঘটাতে দেবে না, তিনি মিথ্যা ও ভুল তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।’
হাসিনাকে দায়ী করা বিতর্কিত মন্তব্য সংবাদমাধ্যমের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের পরে ড. ইউনূস নিজেই বলেছিলেন, যতক্ষণ না বাংলাদেশ তাকে ফেরত চায় ভারত তাকে রাখতে পারবে, তবে শর্ত হবে তাকে সেখানে চুপ করে থাকতে। (এ কথায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কেউ কেউ বিরক্ত হয়েছিলেন)
পালিয়ে আসা আঞ্চলিক নেতাদের আশ্রয় দেয়ার ইতিহাস রয়েছে ভারতের। ১৯৫৯ সালে চীনের অভিযানের মুখে তিব্বত থেকে পালিয়ে ভারতে বসতি আশ্রয় নেন আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা। তিনি রাজনৈতিক বিষয়গুলি ভারতের বেসামরিক নির্বাসিত প্রশাসনের কাছে হস্তান্তর করেছেন। তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেসের একটি প্রতিনিধিদলকে স্বাগত জানিয়েছেন। এই পদক্ষেপে চীন ক্ষুব্ধ হয়েছে। বেইজিং এবং এর বিশ্লেষকদের মতে মোদি সরকারের সম্মতি ছাড়া এমনটি ঘটেনি।
আফগান নেতা মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহর পরিবার ১৯৯২ সালে ভারতে পালিয়ে যায়। সেখানে তার স্ত্রী ফাতানা নাজিব এবং সন্তানরা এখনও তাদের বেশিরভাগ সময় কাটান বলে জানা গেছে। (তারা সাধারণ জনতার দৃষ্টি এড়িয়ে থাকছেন; নাজিবুল্লাহ নিজে পালানো থেকে বিরত ছিলেন এবং কয়েক বছর জাতিসংঘের একটি কম্পাউন্ডে আশ্রয় নেওয়ার পর, ১৯৯৬ সালে কাবুলে প্রবেশ করার সময় তালেবানরা তাকে হত্যা করে)। তার লাশ একটি ট্রাফকি লাইটের খুঁটিতে ঝুলিয়ে রাখে ।
১৯৭৫ সালে যখন শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যা করা হয় তখন শেখ হাসিনা নিজেও তার ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তখন বেশ কয়েক বছর তারা ভারতে ছিলেন। ভারতের মনমোহন সিং সরকারের পররাষ্ট্রসচিব ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন শিবশঙ্কর মেনন। তিনি বলেছেন, প্রতিবেশী অঞ্চল থেকে ভারতে আসার অনেক নজির রয়েছে। আমরা সবসময় তাদের থাকার অনুমতি দিয়েছি এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা আমাদের ইচ্ছাকে সম্মান করে রাজনৈতিক কার্যকলাপ থেকে দূরে থেকেছেন।
হাসিনা ভারতের রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে সমর্থিত। সেখানে তাকে ইসলামপন্থী চরমপন্থার বিরুদ্ধে প্রতিরোধক হিসাবে দেখা হয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে তার প্রয়াত পিতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য ভারতে তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদশেকে সর্মথন দিয়েছিলেন ভারতের তৎকালীন ইন্দরিা গান্ধী সরকার। এ জন্য ভারতকে বেশ মূল্য দিতে হয়।
হাসিনার ক্ষমতাচ্যুত হওয়া এবং ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে অধিষ্ঠিত হওয়ার তত্ত্বটি ছিল একটি ‘রঙিন বিপ্লব’ বা মার্কিন সমর্থিত একটি শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন, যে দেশটি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল। ভারতে মোদিপন্থী লোকজনের বাইরেও এই ধারণার বিস্তৃতি রয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতে হাসিনার অবস্থানের যে সংবেদনশীলতা তার অর্থ হচ্ছে সতর্কতার আবরণ আপাতত তার অবস্থানকে ঘিরে রাখতে পারে – যে পরিকল্পনা নয়াদিল্লিরই করা।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মেনন বলেছেন, এগুলো ঘনিষ্ঠতার সমস্যা। আমাদের প্রতিবেশীদের ক্ষেত্রে বিষয়গুলো সূক্ষ্ম হয়। আমরা বিশ্বের অন্য প্রান্তের দেশগুলির সাথে কাজ করছি, বিষয়টি এমন নয়।
সূত্র:মানবজমিন।
তারিখ: সেপ্টম্বর ২০, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,