বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদকে হত্যার কারণ ভিন্নমত। সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম ফেসবুকে তিনি বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক কয়েকটি চুক্তির সমালোচনা করেন। আর এ সমালোচনার কারণেই পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে আবরার ফাহাদকে। আর তাঁকে মেরেছেন তাঁরই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, তাঁরা সবাই ছাত্রলীগের নেতা-কর্মী।
ফেসবুকে আবরার লিখেছিলেন, ‘দেশভাগের পর দেশের পশ্চিমাংশে কোনো সমুদ্রবন্দর না থাকায় তৎকালীন সরকার ৬ মাসের জন্য কলকাতা বন্দর ব্যবহারের অনুরোধ করেছিল। কিন্তু অনুমতি না পাওয়ায় বাধ্য হয়ে দুর্ভিক্ষ দমনে উদ্বোধনের আগেই মোংলা বন্দর খুলে দেওয়া হয়েছিল। আর এখন ভারতকে সেই মোংলা বন্দর ব্যবহারের জন্য বলতে হচ্ছে।’ আবার ভারতের দুই রাজ্যের মধ্যকার পানি নিয়ে বিরোধের কথা উল্লেখ করে আবরার লিখেছিলেন, ‘যে দেশের এক রাজ্যই অন্যকে পানি দিতে চায় না, সেখানে আমরা বিনিময় ছাড়াই পানি দেব।’ একইভাবে আবরার গ্যাস চুক্তিরও সমালোচনা করছিলেন। সবশেষে একটি কবিতার চারটি লাইন তুলে ধরেছিলেন তিনি।
বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরারের লাশ পড়ে ছিল শেরেবাংলা হলের দ্বিতীয় তলার সিঁড়িতে। হত্যার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ায় সব মহল থেকেই বিভিন্নভাবে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে।
শুরুতে বলা হয় শিবির সন্দেহে আবরারকে পিটিয়ে মারা হয়েছে। গতকাল সোমবার সকালে এ তথ্য প্রচার করা হলে অসংখ্য ফেসবুক ব্যবহারকারী এর ব্যাপক সমালোচনা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফাহমিদুল হক ফেসবুকে লিখেছেন, ‘যেন শিবির হলেই কাউকে অকারণে মারা-ধরা যায়!’
‘শিবির সন্দেহে হত্যা’ বিষয়টি কিছুটা থিতিয়ে আসে আবরার ফাহাদের ‘ফেসবুক স্ট্যাটাস’ প্রকাশ পাওয়ার পরে। গতকাল রাত পর্যন্ত সময়ে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা আবরার ফাহাদের ছোট্ট লেখাটি ৩৩ হাজার বার ‘শেয়ার’ দিয়েছেন। অনেকেই বলেছেন, যে ভিন্নমতের কারণে আবরারকে হত্যা করা হলো, সেই একই মত তাঁদেরও।
সামাজিক মাধ্যমসহ সব মহলে দিনভর আলোচনাই ছিল ভিন্নমতের কারণে আবরার হত্যার ঘটনাটি। এমনকি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও এ নিয়ে কথা বলেছেন। গতকাল সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমি যতটুকু বুঝি, এখানে ভিন্নমতের জন্য একজন মানুষকে মেরে ফেলার কোনো অধিকার নেই।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভিন্নমত পোষণ করে বিএনপি বলছে যে আমরা ভারত সফরে দেশ বিক্রি করে দিয়েছি। তাই বলে কি বিএনপিকে মেরে ফেলব? যে নেতারা বলছেন তাঁদের কি মেরে ফেলব?’ ওবায়দুল কাদের সবশেষে আরও বলেছেন, ‘এখানে কোন আবেগ ও হুজুগে কারা এটা করেছে, তাদের অবশ্যই খুঁজে বের করা হবে।’
ভিন্নমতের কারণে হত্যার ঘটনা দেশে আগেও ঘটেছে। উগ্রবাদী জঙ্গিদের হাতে নিহত হয়েছেন একাধিক লেখক ও ব্লগার। আবার সামাজিক মাধ্যমে ভিন্নমত দেওয়ার কারণে মামলা ও গ্রেপ্তারের ঘটনাও আছে অসংখ্য। বুয়েটের প্রাক্তন শিক্ষার্থী অস্ট্রেলিয়াপ্রবাসী উল্লাস জায়েদ গতকাল ফেসবুকে লিখেছেন, ‘সামান্য স্ট্যাটাসের জন্য আপনি মারা পড়তে পারেন, চাকরি হারাতে পারেন, হেনস্তা হতে পারেন।’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক রাশেদা রওনক খান ফেসবুকে লিখেছেন, ‘ভাবতেই ভয় লাগছে, আমাদের অসহিষ্ণুতার পর্যায় কোথায় নেমে গেছে যে একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসের জন্য মেরেই ফেলা হলো! যে ছেলেরা একটা ফেসবুক স্ট্যাটাসকে মেনে নিতে পারে না, সে ছেলেরা দেশ পরিচালনা করবে কীভাবে? আমরা তবে কাদের পড়াই, কাদের নিয়ে স্বপ্ন দেখি, কাদের হাতে ভবিষ্যৎ?’
ফেসবুকে আবরার ফাহাদ নিজের পরিচয় দিয়ে লিখে রেখেছিলেন, ‘অনন্ত মহাকালে মোর যাত্রা অসীম মহাকাশের অন্তে।’ সামান্য একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস, দেশের কল্যাণ ভাবনায় একটা ভিন্নমত, তাতেই অসীমের পথে শিক্ষার্থী আবরার।
সামগ্রিক বিষয়ে মানবাধিকারকর্মী ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘সারা বিশ্বে নিজেদের উন্নয়নের রোল মডেল হয়ে গেছি, সারা বিশ্ব আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে দাবি করছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শান্তির জন্য সেদিনও একটা পুরস্কার পেলেন, তিনি মাদার অব হিউম্যানিটি পুরস্কার পেয়েছেন। কিন্তু আমরা কোন সমাজ, কোন রাষ্ট্রে বাস করছি। একজন ভিন্নমত পোষণ করতেই পারেন। তাঁর বিশ্লেষণের সঙ্গে আমরা একমত না হতেই পারি। তাই বলে একজনকে পিটিয়ে মেরে ফেলব—এমন সামাজিক, রাজনৈতিক সংস্কৃতির মধ্যে যদি আমরা বাস করি, তাহলে প্রশ্ন করতেই পারি নিজেদের সভ্য বলে দাবি করছি কীভাবে? আমরা নিজেদের উন্নত বলে দাবি করছি কীভাবে? আমাদের উন্নতিটা কোথা থেকে হচ্ছে? কীভাবে বলতে পারি, মানবতার কোনো একটা শর্তটা পূরণ করছি।’
সুলতানা কামাল আরও বলেন, ‘যাকে মারল সে যুবক, যারা মারল তারাও যুবক। এই বয়সীদের মনে এমন হিংস্র মনোভাব কীভাবে হতে দিলাম। এর জন্য আমরা সবাই দায়ী। এর জন্য আমাদের সমাজ, সামাজিক সংস্কৃতি, রাজনীতি সবই দায়ী। এটি মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। সেভাবেই বিষয়টি দেখা উচিত। যারা এই কাজ করেছে তারা যেন এমন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়, যাতে তারা অনুতপ্ত হয়। তাদের দেখে যেন অন্যরা বোঝে ভিন্নমতকে আসলে এভাবে দমন করা যায় না।’
সূত্র: প্রথম আলো, শওকত হোসেন, ঢাকা
তারিখঃ অক্টোবর ০৮, ২০১৯
সংযোজন:
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় জড়িত আরও তিন শিক্ষার্থীকে পাঁচ দিন রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার অনুমতি দিয়েছেন আদালত।
তিন আসামি হলেন বুয়েটের ছাত্র শামসুল আরেফিন (২১), মনিরুজ্জামান (২১) ও আকাশ হোসেন (২১)। তাঁদের মধ্যে মনিরুজ্জামান বুয়েটের ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৬তম ব্যাচের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। আকাশ একই ব্যাচের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের এবং শামসুল মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ১৭তম ব্যাচের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র।
মনিরুজ্জামান ও আকাশ হোসেন আবরার হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি।
এর আগে আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার অপর ১০ জন ছাত্রকে পাঁচ দিনের পুলিশ রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। ১০ আসামিকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখা (ডিবি)। আবরার ফাহাদ বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের (১৭তম ব্যাচ) ছাত্র ছিলেন। তিনি থাকতেন বুয়েটের শেরেবাংলা হলের নিচতলায় ১০১১ নম্বর কক্ষে। গত রোববার (অক্টোবর ০৬, ২০১৯০ রাতে আবরারকে পিটিয়ে হত্যা করেন বুয়েট ছাত্রলীগের একদল নেতা-কর্মী। আবরার হত্যার ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে তাঁর বাবা বরকত উল্লাহ ঢাকার চকবাজার থানায় মামলা করেছেন।
প্রথমে মামলার এজাহারভুক্ত ১০ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। আর গতকাল মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করা হয় আরও তিনজনকে। আবরার হত্যার ঘটনায় গত সোমবার বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফুয়াদ হোসেন, অনীক সরকার, মেফতাহুল ইসলাম, ইফতি মোশারেফ, বুয়েট ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিন, গ্রন্থ ও প্রকাশনা সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ ওরফে মুন্না, ছাত্রলীগের সদস্য মুনতাসির আল জেমি, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম ওরফে তানভীর ও মোহাজিদুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
তারিখঃ অক্টোবর ০৯, ২০১৯
রেটিং করুনঃ ,