হামলার তৃতীয় দিনে ২৬ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের কেন্দ্রের অনেকটা কাছে রাশিয়ার সেনাবাহিনী। কিয়েভে সকাল থেকেই বিস্ফোরণ ও গোলাগুলির শব্দ চলছে। কিয়েভের বিভিন্ন রাস্তায় ও আশপাশের এলাকায় রুশ সেনাবাহিনী ও ইউক্রেনের সেনাবাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষও চলছে। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী দাবি করেছে, ৩ হাজার ৫০০ রুশ সেনা নিহত হয়েছে।
রাশিয়ার সঙ্গে অস্ত্রবিরতি নিয়ে আলোচনা শুরু করতে প্রস্তুত আছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। আলোচনার জন্য সম্ভাব্য তারিখ ও ভেন্যু ঠিক করা নিয়ে ক্রেমলিনের সঙ্গে কথা বলছে কিয়েভ।
কিয়েভের রুশ সেনারা প্রথম দিনই ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের উপকণ্ঠে পৌঁছে যান। দ্বিতীয় দিনেও বিমান, ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চলেছে। বেসামরিক এলাকাতেও হামলা হয়েছে। রুশ হামলার প্রথম দিনে ইউক্রেনের অন্তত ১৩৭ সামরিক-বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি।
চলমান ইউক্রেন সংকট নিয়ে পাঠকের মনে নানা প্রশ্ন আছে। বিবিসি অবলম্বনে সেসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা রইল এ প্রতিবেদনে।
সংকটের শুরু কবে
সাম্প্রতিক ইতিহাস বিবেচনায় নিলে চলমান সংকটের সূত্রপাত ২০১৪ সালে। তবে এ সংকটের মূলে যেতে ফিরে তাকাতে হবে সোভিয়েত আমলে। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল ইউক্রেন।
ইউক্রেনে দুটি রাজনৈতিক ধারা প্রবল। একটি ধারা পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে চায়। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) যোগ দেওয়ার পাশাপাশি পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য হতে আগ্রহী। অপর ধারাটি রুশপন্থী। তারা রাশিয়ার বলয়ে থাকতে চায়।
ইউক্রেনের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ রুশভাষী। তারা জাতিগতভাবেও রুশ। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক-সামাজিক ঘনিষ্ঠতা আছে।
বিক্ষোভের মুখে ২০১৪ সালে ইউক্রেনের রুশপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের পতন হয়। তিনি দেশ ছেড়ে পালান।
ইয়ানুকোভিচ ইইউর সঙ্গে বড় ধরনের বাণিজ্য চুক্তি করতে চেয়েছিলেন। তখন পুতিন চাপ বাড়ান। চাপে পড়ে ইয়ানুকোভিচ ইইউর সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসেন। ফলে ইউক্রেনে তাঁর বিরুদ্ধে গণবিক্ষোভ শুরু হয়।
ইয়ানুকোভিচের পর যাঁরা ইউক্রেনের ক্ষমতায় আসেন, তাঁরা ইইউপন্থী বলে পরিচিত। তাঁদের নানা পদক্ষেপে পুতিন ক্ষুব্ধ হন।
ইয়ানুকোভিচের পতনের পর পূর্ব ইউক্রেনের ক্রিমিয়া অঞ্চল দখল করে নেয় রাশিয়া।
কেন ক্রিমিয়া দখল
প্রায় ২০০ বছর ধরে রাশিয়ার অংশ ছিল ক্রিমিয়া। ১৯৫৪ সালে সোভিয়েত নেতা নিকিতা ক্রুশ্চেভ তৎকালীন সোভিয়েত প্রজাতন্ত্র ইউক্রেনের কাছে ক্রিমিয়া হস্তান্তর করেন। তখন রুশ নেতৃত্ব ভাবতে পারেনি যে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হবে।
ক্রিমিয়ার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক। কৌশলগত কারণে রাশিয়ার কাছে ক্রিমিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই সুযোগ পেয়ে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া দখল করে নেয় রাশিয়া।
রাশিয়ার দাবি কী
পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য নয় ইউক্রেন। তবে দেশটি ন্যাটোর সদস্য হতে চায়। বিষয়টি মানতে নারাজ রাশিয়া। এ কারণে রাশিয়া পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে এমন নিশ্চয়তা চায় যে ইউক্রেনকে কখনো ন্যাটোর সদস্য করা হবে না।
রাশিয়ার চাওয়া অনুযায়ী, এ ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা দিতে রাজি নয় পশ্চিমা দেশগুলো।
পুতিন মনে করেন, রাশিয়াকে চারদিক থেকে ঘিরে পশ্চিমা দেশগুলো ন্যাটোকে ব্যবহার করছে। ইউক্রেনকেও এ উদ্দেশ্যে ন্যাটোতে নেওয়া হতে পারে। এ কারণে পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণের বিরোধিতা করছেন তিনি।
রাশিয়ার অভিযোগ, গত শতকের শেষ দিকে যুক্তরাষ্ট্র ন্যাটোকে পূর্ব দিকে সম্প্রসারণ করা হবে না বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এ প্রতিশ্রুতি রাখা হয়নি।
রাশিয়ার অভিযোগ প্রত্যাখ্যানের পাশাপাশি ইউক্রেনকে ন্যাটো জোটে অন্তর্ভুক্ত না করার যে দাবি মস্কো জানাচ্ছে, তা নাকচ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
অন্যদিকে ন্যাটো বলছে, এটি একটি আত্মরক্ষামূলক সামরিক জোট। প্রতিটি দেশের প্রতিরক্ষার পথ বেছে নেওয়ার অধিকার আছে।
রাশিয়া কেন উদ্বিগ্ন
১৯৯০-এর দশকের শুরুতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়। এ ভাঙনকে রাশিয়ার জন্য একটি ভূরাজনৈতিক বিপর্যয় বলে মনে করেন পুতিন। তারপর থেকে রাশিয়া দেখছে, সামরিক জোট ন্যাটো ধীরে ধীরে তাদের ঘিরে ফেলছে। সংগত কারণেই রাশিয়া তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
১৯৯৯ সালে চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি ও পোল্যান্ড ন্যাটোতে যোগ দেয়। ২০০৪ সালে যোগ দেয় বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া ও স্লোভাকিয়া। ২০০৯ সালে যোগ দেয় আলবেনিয়া।
জর্জিয়া, মলদোভা বা ইউক্রেনেরও ন্যাটোতে যোগ দেওয়া আকাঙ্ক্ষা আছে। কিন্তু রাশিয়ার কারণে এখন পর্যন্ত তা হয়ে ওঠেনি। তবে এই তিন দেশে রুশপন্থী বিদ্রোহী আছে। এই দেশগুলোর কোনোটি যদি ন্যাটোতে যোগ দেয়, তবে তা রাশিয়ার জন্য মেনে নেওয়া কঠিন হবে।
রাশিয়ার গ্যাস কেন বড় ইস্যু
সমরাস্ত্র ছাড়া রাশিয়ার একটি বড় হাতিয়ার হলো তার জ্বালানি। ইউরোপের মোট তেল-গ্যাস সরবরাহের ২৫ শতাংশ যায় রাশিয়া থেকে।
ইউরোপে গ্যাস সরবরাহে রাশিয়ার প্রবেশদ্বার ইউক্রেন। রাশিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রধান গ্যাস পাইপলাইনগুলো ইউক্রেনের ভেতর দিয়ে গেছে।
ফলে ইউক্রেন যদি রাশিয়ার প্রভাববলয়ের বাইরে চলে যায়, তাহলে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে রাশিয়া তার একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ হারাতে পারে।
ন্যাটো কি ঐক্যবদ্ধ
প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেছেন, ইউক্রেন প্রশ্নে পশ্চিমা নেতারা ঐক্যবদ্ধ। তবে ইউক্রেনের ব্যাপারে বিভিন্ন দেশের সমর্থন-সহযোগিতায় পার্থক্য দেখা যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে প্রাণঘাতী সামরিক সরঞ্জাম পাঠিয়েছে। তবে ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা মোতায়েন করা হবে না বলে জানিয়েছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
ইউক্রেনকে স্বল্পমাত্রার ট্যাংক-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র দেওয়ার কথা বলেছে যুক্তরাজ্য। ডেনমার্ক, স্পেন, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ডসের মতো ন্যাটো দেশ পূর্ব ইউরোপে প্রতিরক্ষা জোরালো করেছে। ইউক্রেনের অনুরোধ সত্ত্বেও দেশটিকে কোনো অস্ত্র দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে জার্মানি। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ বলেছেন, তাঁর দেশ ইউক্রেনের পক্ষে থাকবে।
ন্যাটোর প্রধান জেনস স্টলটেনবার্গ বলেছেন, এ জোটের মূল কাজ হলো সব মিত্রের সুরক্ষা দেওয়া। একজনের ওপর আক্রমণ মানে সবার ওপর আক্রমণ। জোটের নীতিনির্ধারণী পর্ষদ অন্যান্য দেশকে রক্ষার যে প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা রয়েছে, সেটা সক্রিয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অর্থাৎ যেখানে প্রয়োজন হবে, সেখানে ন্যাটো সেনা মোতায়েন করা হবে।
দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বীকৃতি
ইউক্রেন সীমান্তে লাখো সেনা মোতায়েন নিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে উত্তেজনার মধ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশটির রুশপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদী-নিয়ন্ত্রিত দনবাসের দুটি অঞ্চল দোনেৎস্ক ও লুহানস্ককে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। একই সঙ্গে ‘প্রজাতন্ত্র’ দুটিতে রুশ সেনাদের ‘শান্তিরক্ষী’ হিসেবে দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন তিনি।
রাশিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা
পুতিনের ২১ ফেব্রুয়ারির পদক্ষেপের জেরে রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা আসে।
রাশিয়ার পাঁচটি ব্যাংক ও পুতিন-ঘনিষ্ঠ তিন ধনকুবেরের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাজ্য।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন রাশিয়ার দুটি ব্যাংক ও পাঁচ ধনকুবেরের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দেন।
রাশিয়ার ২৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞায় পড়ে। ইইউর নিষেধাজ্ঞার আওতায় এসেছেন দেশটির ৩৫১ জন এমপিও। ইইউর ব্যাংকগুলোয় থাকা রাশিয়ার তহবিল আটকে দেওয়া হবে।
জার্মানি রাশিয়া থেকে গ্যাস নেওয়ার জন্য চলমান নর্ড স্ট্রিম ২ গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছে।
কানাডা, জাপানও রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়।
জরুরি অবস্থা
২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ইউক্রেনে ৩০ দিনের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। ইউক্রেনের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যান্ড ডিফেন্স কাউন্সিলের সেক্রেটারি ওলেক্সি দানিলভ জানান, দোনেৎস্ক ও লুহানস্ক ছাড়া সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি থাকবে।
রুশ আক্রমণ প্রতিরোধে ইউক্রেন তাদের সংরক্ষিত সেনাদের নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত করে। যুদ্ধের জন্য ইউক্রেনের নাগরিকদেরও প্রস্তুত থাকতে বলা হয়।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে এক ভাষণে বলেন, তাঁর দেশে রুশ আক্রমণ ইউরোপে একটি বড় যুদ্ধের সূচনা করতে পারে।
অভিযান শুরুর নির্দেশ
পূর্ব ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়ার লাখো সেনা মোতায়েন নিয়ে পশ্চিমাদের সঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরে মস্কোর উত্তেজনা চলছিল। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা বলে আসছিল, ইউক্রেনে হামলার পরিকল্পনা করছে রাশিয়া। তবে রাশিয়া বলে আসছিল, ইউক্রেনে হামলার পরিকল্পনা নেই মস্কোর। শেষ পর্যন্ত সেই আশঙ্কাই সত্যি হয়।
২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে টেলিভিশনে দেওয়া এক ভাষণে পূর্ব ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী-নিয়ন্ত্রিত দনবাস অঞ্চলে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরুর নির্দেশ দেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন। সামরিক অভিযান শুরুর ঘোষণা দিয়ে পুতিন পূর্ব ইউক্রেনে থাকা ইউক্রেনের সেনাদের অস্ত্র ত্যাগ করে ঘরে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান।
তিন দিক থেকে হামলা
পুতিনের নির্দেশের পরপরই স্থানীয় সময় ২৪ ফেব্রুয়ারি ভোরে স্থল, আকাশ ও জলপথে ইউক্রেনে হামলা শুরু করেন রাশিয়ার সেনারা।
রাশিয়ার সেনাবাহিনী আক্রমণ চালায় উত্তর, দক্ষিণ ও পূর্ব দিক থেকে। বেলারুশ থেকেও হামলা হয়। সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন রুশ সেনারা।
রাশিয়া প্রথম দিনের হামলাকে সফল বলছে। তারা ইউক্রেনের বিমানঘাঁটিগুলোর সামরিক কাঠামো ও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবি করে। প্রথম দিনই রুশ সেনারা কিয়েভের উপকণ্ঠের আন্তোনোভ বিমানবন্দর দখলে নেন। নিয়ন্ত্রণ নেন বেলারুশ সীমান্তবর্তী চেরনোবিল পরমাণুকেন্দ্রের।
কিয়েভের পক্ষ থেকে বলা হয়, রুশ হামলার প্রথম দিন সামরিক-বেসামরিক মিলিয়ে ইউক্রেনের ১৩৭ জন নিহত হন। অপর দিকে রাশিয়ার ৫০ সেনাকে হত্যা, ৫টি ট্যাংক ধ্বংস ও ৬টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করার দাবি করে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী।
ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রার হামলার জবাবে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নতুন করে কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:ফেব্রুয়ারী ২৬, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,