একসময় সাদা অ্যাম্বাসেডর গাড়ির ওপর লাল বাতি জ্বালিয়ে চলাফেরা করতেন ভারতীয় আমলারা। সময়ের ব্যবধানে সে প্রথা উঠে গেছে। তবে এখনো তাঁদের তোয়ালেঢাকা চেয়ারে বসতে দেখা যায়। সময় বদলেছে। বদলেছে কাজের ধরন। তবে ভারতীয় আমলাতন্ত্রে যুগ যুগ ধরে কিছু প্রথা টিকে রয়েছে। আমলাতন্ত্রের এমনই কিছু প্রথার কথা উঠে এসেছে কৌশিক বসুর বয়ানে। তিনি বলেন, স্যার শব্দটা এক–দুবার নয়, মিনিটে ১৬ বার বলেন ভারতের একজন আমলা।
কৌশিক বসু পেশায় অর্থনীতিবিদ। লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকস থেকে পিএইচডি শেষে তিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতি বিষয়ে অধ্যাপনা করছেন। মাঝে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তারও আগে ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। দেশটির তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমন্ত্রণে তিনি এ পদে যোগ দিয়েছিলেন। তখনই তিনি ভারতীয় আমলাতন্ত্রের নানা প্রথার সঙ্গে পরিচিত হন।
চলতি মাসের শুরুতে কৌশিক বসুর একটি স্মৃতিচারণামূলক বই প্রকাশ পেয়েছে। ‘পলিসিমেকারস জার্নাল: ফ্রম নিউ দিল্লি টু ওয়াশিংটন ডিসি’ নামের বইটিতে তিনি নিজের চোখে দেখা ভারতীয় আমলাদের কিছু পছন্দ-অপছন্দ, প্রথা সম্পর্কে বিশদ তুলে ধরেছেন। এতে তোয়ালের ব্যবহার থেকে শুরু করে কথায় কথায় স্যার সম্বোধন, বসার চেয়ারের বিশেষ ধরন, অনুমতি ছাড়াই কক্ষে প্রবেশ, সময়ের কাজ সময়ে করার আপ্রাণ চেষ্টার কথাসহ আরও নানা দিক উঠে এসেছে।
জি স্যার!
সরকারি কর্মকর্তারা ‘স্যার’ ডাক ভীষণ পছন্দ করেন। বলতেও, শুনতেও। তাই অধস্তনরা কথায় কথায় ঊর্ধ্বতনদের স্যার ডাকেন। তাই বলে কয়বার? একবার, দুবার, তিনবার। না, তা নয়। কৌশিক বসু বলছেন, ভারতে মিনিটে গড়ে ১৬ বার স্যার শোনার অভিজ্ঞতা রয়েছে তাঁর। একটি সরকারি বৈঠকে তিনি ইচ্ছা করে গুনেছিলেন। ওই বৈঠকে একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। একজন জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা সেখানে প্রতি মিনিটে গড়ে ১৬ বার স্যার শব্দ উচ্চারণ করেছেন।
এ বিষয়ে কৌশিক বসু বইয়ে লিখেছেন, একবার স্যার শব্দ বলতে যদি আধা সেকেন্ড সময় লাগে, তাহলে ভারতীয় আমলারা তাঁদের কথা বলার মোট সময়ের ১৩ শতাংশই স্যার শব্দ ব্যবহার করতে ব্যয় করেন।
সবকিছুতেই অনুমতি
মহাত্মা গান্ধী একবার বলেছিলেন, ‘আমার অনুমতি ছাড়া কেউ আমাকে মারতে পর্যন্ত পারবে না।’ এই বাক্য অমোঘ সত্য হিসেবে ধরে নিয়েছেন ভারতের আমলারা। সরকারি দপ্তরগুলোয় ছোট থেকে বড়—সব কাজের জন্য অনুমতি নিতে হয়। আপনি অসুস্থ আত্মীয়কে দেখতে যাবেন, দপ্তরে কফির ব্র্যান্ড বদলাবেন কিংবা টয়লেট পরিষ্কারের জন্য আপনার আরেকজন কর্মীর প্রয়োজন; কাজটা ছোট হোক কিংবা বড়—নিতে হবে অনুমতি। আর এই অনুমতি সর্বোচ্চ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শৃঙ্খলা মেনে অধস্তন পর্যন্ত গড়াবে বলে জানান কৌশিক বসু।
ব্যতিক্রম কক্ষে প্রবেশে
সবকিছুতে অনুমতির প্রয়োজন হলেও ভারতের সরকারি দপ্তরগুলোয় কেউ কারও কক্ষে প্রবেশের সময় অনুমতির ধার ধারেন না। শুরুর দিকে এই বিষয়টি কৌশিক বসুকে বেশ ভুগিয়েছিল। কেননা, তিনি পশ্চিমা রীতিতে অভ্যস্ত। পশ্চিমের দেশগুলোয় কেউ কারও কক্ষে প্রবেশের সময় অনুমতি নিয়ে নেন। এর ব্যতিক্রম হয় না। কৌশিক বসু বলেন, ‘অনুমতি না নেওয়ার এই নিয়মের সঙ্গে মানিয়ে নিতে আমার বেশ সময় লেগেছিল।’
বিলম্ব বর্জনীয়
সরকারি কর্মকর্তাদের টেবিলে ফাইল নড়ানো দুষ্কর—সাধারণ মানুষ সচরাচর এমন অভিযোগ করে থাকেন। তবে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। ইদানীং ভারতের সরকারি দপ্তরগুলোয় ফাইল আটকে রাখাকে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ে কাজের অভিজ্ঞতার আলোকে কৌশিক বসু বলছেন, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সব সময় অধস্তনদের সময়ের কাজ সময়ে করতে, নিয়মানুবর্তী হতে তাড়া দিতেন। তাঁর মতে, ১০ কিংবা ১৫ বছর আগের তুলনায় ভারতের সরকারি দপ্তরগুলোয় এখন অনেক বেশি সময় মেনে কাজ করা হয়।
সঠিক চেয়ার নিয়ে ভাবনা
কৌশিক বসুর পর্যবেক্ষণ, সরকারি বৈঠকগুলোয় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বসার চেয়ার অন্যদের তুলনায় কিছুটা উঁচু হয়। এতে তিনি বাড়তি কিছু সুবিধা ভোগ করেন। উঁচুতে থেকে কথা বলতে পারেন। এতে সহজেই তিনি সবার মনোযোগ কাড়তে পারেন। প্রভাব ফেলতে পারেন অন্যদের মনে।
কৌশিক বসু বলেন, ‘সরকারি দপ্তরের প্রতিটি চেয়ারের ডান পাশের হাতলের নিচে একটি লিভার রয়েছে। এটি দিয়ে চেয়ারের উচ্চতা ঠিকঠাক করা যায়। প্রয়োজন অনুযায়ী উঁচু-নিচু করে নেওয়া যায়। আমি বৈঠক চলাকালে সবার অগোচরে ওই লিভার টেনে চেয়ারের উচ্চতা বাড়িয়ে নিতাম।’
তোয়ালের গল্প
ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাদের বসার চেয়ারে পিঠের নিচে তোয়ালের রাখার প্রচলন উপনিবেশকাল থেকেই চলে আসছে। তবে কৌশিক বসু ওয়াশরুমে ব্যবহারের তোয়ালে নিয়ে একটি ঘটনা বইয়ে উল্লেখ করেছেন।
ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় ভবনের নিচের তলায় ঊর্ধ্বতন আমলাদের ব্যবহারের জন্য একটি শৌচাগার ছিল। সেটি ব্যবহার করতেন দেশটির অর্থ, রাজস্ব ও ব্যয়বিষয়ক সচিব—এই তিন কর্মকর্তা। সেখানে তিনজনের জন্য তিনটি আলাদা র্যাক ও তোয়ালে ছিল। কৌশিক বসুর কর্মচারী তাঁকে জানান, এই শৌচাগার অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারতেন না। করলে ওই তিন কর্মকর্তার দর্প ক্ষুণ্ন হবে। তাই সেখানে তাঁকে (কৌশিক বসুকে) প্রবেশ করতে দিতে নারাজ মন্ত্রণালয়ের কর্মচারীরা।
পরে অবশ্য কৌশিক বসু সেই ‘অভিজাত শৌচাগার’ ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছিলেন। অনুরোধ করায় তাঁকে সেটা ব্যবহারের অনুমতি দেন তখনকার অর্থমন্ত্রী। পরে সেখানে তাঁর নামেও আলাদা র্যাক ও তোয়ালে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে এ ঘটনায় তাঁর কর্মীকে দুর্দান্ত লড়াই চালাতে হয়েছিল।
বিশ্বব্যাংকের প্রণয়ন করা ২০২০ সালের ইজ অব ডুয়িং বিজনেস সূচকে ১৯০টি দেশের মধ্যে ভারতের অবস্থান ৬৩। এ জন্য আমলাতন্ত্রের নানাবিধ প্রথা ও লাল ফিতার দৌরাত্ম্যকে দায়ী করেন অনেকেই। সময় বদলাচ্ছে। অথচ এসব প্রথা ঔপনিবেশিক আমল থেকে সরকারি দপ্তরগুলোয় টিকে রয়েছে। এই বিষয়ে কৌশিক বসুর ভাষ্য, এসব ব্রিটিশরাজের (ঔপনিবেশিক শক্তি) কাছ থেকে পাওয়া অভ্যাস। দীর্ঘদিন ধরে সরকারি চাকরিতে থাকা আমলারা এসব পছন্দ করেন। তাই সময় বদলালেও এমন আচরণ ও প্রথা বদলায়নি।
সূত্র: প্রথম আলো
বিবিসি অবলম্বনে অনিন্দ্য সাইমুম
তারিখ: জুলাই ১৫, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,