‘কেন বিশ্বের অন্যমত বৃহৎ ইলেট্রনিক্স কোম্পানি স্যামসাং দেশে বিনিয়োগ করতে এসে ফিরে গেল? কেন কোরিয়ান কোম্পানি ইয়াংওয়ানও বছরের পর বছর অপেক্ষা করে ইপিজেড স্থাপনে জায়গা বুঝে পায়নি? এ দুই ঘটনায় স্পষ্ট, কী কারণে বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে পারছে না, যা খুব ভালোভাবে পারছে তাইওয়ান।’
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) আয়োজিত ‘ভিয়েতনামের অসাধারণ রপ্তানি সাফল্য: বাংলাদেশের জন্য কী শিক্ষা’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় এ কথা বলেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা সংস্থা সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান।
তিনি বলেন, দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বাড়াতে সরকারের নীতির মধ্যে বড় গলদ আছে। অবস্থার উন্নতি করতে হলে ভিয়েতনামকে মডেল ধরে সরকারি নীতিতে আমূল ও আশু সংস্কার আনতে হবে। এমনকি অন্য সব ক্ষেত্রের মতো সুশাসনেও বাংলাদেশের তুলনায় ভিয়েতনাম এগিয়ে।
সুশাসনের ঘাটতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোরিয়ান কোম্পানি ইয়াংওয়ান আজ পর্যন্ত তাদের কেনা জমির মালিকানা বুঝে পায়নি। ১৯৯৬ সাল থেকে চেষ্টা করছে তারা। স্যামসাং কোম্পানি কেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে এসেও না পেরে ভিয়েতনামে চলে গেল- এসব প্রশ্নের জবাব জানা খুব দরকার। এই বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর তিক্ত অভিজ্ঞতা অন্য উদ্যোক্তাদেরও এ দেশে বিনিয়োগে নিরুৎসাহিত করছে।
শুল্কমুক্ত সুবিধা কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে ব্যর্থতার কথা তুলে ধরে অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নে (ইইউ) ‘এভরি থিঙ্কস বাট আর্মস (ইবিএ)’ স্কিমে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা ভোগ করছে বাংলাদেশ। ভারত শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রেও জিএসপি সুবিধা ছিল। সব বড় বাজারে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা কেন কাজে লাগানো যায়নি। অথচ শুল্কমুক্ত সুবিধা ছাড়াই ভিয়েতনাম কীভাবে রপ্তানি বাণিজ্যে এগিয়ে গেল, এসব প্রশ্নের জবাব মেলাতে হবে। একইভাবে পণ্যে বৈচিত্র্য না থাকা, অবকাঠামো দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে না পারার সমালোচনা করেন তিনি।
ওয়েবিনারটিতে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। তিনি বলেন, গত কয়েকবছর ধরে সবকিছুতে ভিয়েতনামের সঙ্গে তুলনা করা একটা প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মনে রাখা দরকার, ‘দে আর ওয়ান পার্টি স্টেট (এক দলের দেশ)। বাংলাদেশের রাজনীতি তা নয়। তাদের অনেক কিছুর সঙ্গে আমাদের মিল নেই। এরপরও আলোচনা থেকে উঠে আসা বিভিন্ন সুপারিশ ও পরামর্শ সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে বলে আশ্বাস দেন তিনি।
আলোচনা সভা সঞ্চালনা করেন পিআরআইয়ের চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তার। বিষয়ের ওপর মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান ড. সাদিক আহমেদ। তার উপস্থাপনায় দেখা যায়, ব্যবসা, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, রপ্তানিসহ বিভিন্ন ক্ষেতে বাংলাদেশের তুলনায় বেশ এগিয়ে ভিয়েতনাম। পরিসংখ্যান তুলে ধরে তিনি দেখান, খাদ্য সংকটের দেশ তাইওয়ানও এখন চাল রপ্তানি করে। এমনকি প্রাথমিক পণ্য থেকে শুরু করে সব ধরনের প্রযুক্তি পণ্য রপ্তানি করে দেশটি।
আলোচনায় মেট্রোপলিটন চেম্বারের সভাপতি ব্যারিস্টার নিহাদ কবীর বলেন, বাংলাদেশে কাগজে সব কিছুই চমৎকার। বাস্তবে উল্টো। কেন বিদেশি উদ্যোক্তারা বাংলাদেশ ছাড়ল, তা কি সরকারের কেউ জানতে চেয়েছে? ব্যবসায়ীদের উদ্যোক্তাদের কী সমস্যা, তারা কী সহযোগিতা চায়, তা কেউ জানতে চায়নি। অথচ বিনিয়োগ আনতে বিভিন্ন দেশে রোডশো হচ্ছে। লক্ষ্যভুক্ত উদ্যোক্তাদের কাছে না গেলে বিনিয়োগ আসবে না। বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক সত্ত্বেও কেন বিদেশি উদ্যোক্তারা এ দেশে বিনিয়োগ না করে ভিয়েতনামে যাচ্ছে, এ প্রশ্নগুলোর উত্তর মেলানো প্রয়োজন।
এপেক্স ফুটওয়্যারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, মুদ্রার বিনিময় হার রপ্তানিকারকদের জন্য সহায়ক নয়। টাকা-ডলারের এই বিনিময় হার দিয়ে ব্যবসা কীভাবে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে, সেটাই বড় প্রশ্ন। ভিয়েতনাম আগ্রাসী রপ্তানির জন্য স্থানীয় মুদ্রার মান কমিয়ে রেখেছে- এ অভিযোগ আছে যুক্তরাষ্ট্রের। অথচ এদেশে মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছেন না।
ভিয়েতনামের তুলনায় পিছিয়ে থাকার একটা উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ভিয়েতনামে কোনো পণ্যের কাস্টমস ক্লিয়ারেন্সের জন্য সময় লাগে দুই থেকে তিন দিন। বাংলাদেশে লাগে দুই থেকে তিন সপ্তাহ। পাদুকা শিল্পে দুই দেশের বড় ব্যবধানের বিভিন্ন পরিসংখ্যান তুলে ধরেন তিনি।
বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ড. রুবানা হক বলেন, রপ্তানিতে খাত বৈচিত্র্য দরকার। এমনকি পোশাকের খাতের মধ্যেই বৈচিত্র্য আনা প্রয়োজন। এখনও ৫ পণ্য নির্ভর এই খাত। ম্যান মেইড ফাইবারের বিভিন্ন পণ্যে বৈচিত্র্য আনা যায়। পণ্য রপ্তানির পাশাপাশি সেবা সংক্রান্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে মনোযোগ বাড়ানোর পরামর্শ দেন তিনি।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, স্যামসাংয়ের মতো আর কোনো বিদেশি বিনিয়োগ যাতে এ দেশ ছেড়ে না যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।
ইউনাইটেড ন্যাশনস ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের (ইউএনডিপি) কান্ট্রি ইকোনোমিস্ট ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, ভিয়েনামের সাফল্যের পেছনে লক্ষ্যভুক্ত বিদেশ নীতি কাজ করেছে। সে লক্ষ্যে দেশটি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের তুলে ধরেছে। বাংলাদেশকে সেই নীতি থেকে শিক্ষা নিতে হবে।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. মাশরুর রিয়াজ বলেন, ভিয়েতনাম এ পর্যন্ত ১৩টি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি অথবা অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি করেছে। বাংলাদেশের এ ধরনের চুক্তি মাত্র একটি। এছাড়া পণ্যে বৈচিত্র্য আনতে আরও অন্তত ২০টি খাত উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রাধিকারভিত্তিক কার্যক্রম হাতে নিতে হবে।
ওয়েবিনারে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান, সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।
সূত্রঃ সমকাল।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ১৭, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,