প্রিয় সা…………..
বেশ সময় গত হল। সবই দ্রুত। তুমি তখন আজিমপুরের এক নাম করা বালিকা বিদ্যালয়ে। আমি তোমার স্কুলের যাওয়া আসার পথে প্রিয় ………কলেজে। তোমার মা তোমাকে কড়া পাহড়ায় স্কুলে নিতেন এবং আনতেন। স্মৃতি কত স্পষ্ট। আজ চিঠি উৎসবের একটি চিঠি লিখতে বসেই নক্ষত্রের মত সব স্পষ্ট মনে হচ্ছে। স্কুল থেকে বা কলেজ থেকে আমাদের ফেরাটা ছিল এক খানেই। ধানমন্ডির বাসাটায় । চার ইউনিটের দো তালা বাসাটায় তুমি বাসাটার পশ্চিমে লেকে পাড়ে আর আমরা পূর্ব পাশে।
কলমে চিঠি লিখার চল এখন অনেকটাই অচল। সময় দ্রুত এগিয়ে চলেছে। অনেক কিছুর ধরণ পাল্টাচ্ছে। গতকাল যা চল ছিল এখন তা অনেকটাই অচল। তবুও আমরা পুরানা লেখায়, কাব্যে। যাদুঘরে। পুরানা নিদর্শনের এলাকায় যাই। লাল বাগ কেল্লা, মহা স্থান গড়, আগ্রার তাজমহলে। ফিরে যাই আমাদের নানান রঙের হারানো, ফেলে আসা দিনগুলিতে।
বেশ কয়েক দিন ধরে চিঠিটা লিখে যাচ্ছি। এতো সময় হয়তো কোন লেখায় ব্যয় করি নি। লিখেও আবার অনেক লাইন, শব্দ মুছে দিয়েছি। দিচ্ছি। বাসাটার নম্বর, সড়ক নম্বর উল্লেখ ছিল চিঠিতে । মুছে দিয়েছি। বেশ কয়েক জনের নামও ছিল তাও মুছে দিয়েছি। বিদ্বান বাবার মেয়ে তুমি। দেশের অনেক শ্রেষ্ট ছাত্র-ছাত্রী তোমার বাবার হাতে গড়া। তুমি যাতে অরক্ষিত হয়ে না পড়। অনিরাপত্তায় পড়ে না যাও তাই অনেক কিছুই লিখে আবার মুছে দিয়েছি।
তেরটা বছর ধানমন্ডির বাসাটায় কাটিয়ে তুমি তোমার বাবা মার সাথে অন্য এক বাসায় চলে গেলে। প্রায় শিশু থেকে কিশোরী, কিশোরী থেকে তরুনী। ধানমন্ডির ….. নম্বর বাসাটা থেকে তোমার মন কখনই যায় নি। কখন্ই যাবে ন। অনেক বারেই এসেছো এ বাসাটায়। তুমি দেখেছো তোমার প্রিয় পেয়ারা গাছটি যে গাছটির অনেক উঁচুতে উঠে যেতে দ্রুত। পেয়ারা পেরে পেয়ারা গাছটিতে হেলান দিয়ে তুমি পেয়ারা চিবাতে প্রফুল্ল মনে। তোমার সখের মেহিদী গাছ।
বাড়িটি আরো পুরাতন হয়েছে। ছোট্ট গাছগুলি আরো বড় হয়েছে। তোমাকে উপলক্ষ্য করে যে কয়েকটা গাছ লাগানো হয়েছিল সবই অনেক বড় হয়েছে। বাড়িটিকে এখন মনে হয়, একটি বাগান বাড়ি। এ বছর গত মিলাদে বন্ধুরা, বন্ধুর এক বউ এসেছিল। বাসাটা ঘুরে ঘুরে দেখল। ছাদ। ছাদ থেকে লেক দেখল। সামনের বাগান। তোমার প্রিয় শিউলি গাছ, পেয়ারা গাছ। সাজনা গাছ। গাছে ধরা কটা সাজনাও ছিঁড়ল। ক্লিক ক্লিক শব্দে বেশ কটা ছবি তুললো। ছাদের কাছের আম গাছটি থেকে চোট্ট কটা আম ছিড়লো। আমাদের দিকের অর্জুন গাছটা দেখল।
আগের মত কয়েকদিন আগেও একটা বানর এসেছিল। পেয়ারা গাছটিতে বেশ সময় ধরে বসে ছিল। বাসায় বানর আসা তুমি আগেও দেখেছ। কৌতহল মনে।
তোমার প্রিয় শিউলি গাছ, পেয়ারা গাছ, কুল-বড়ই গাছ সবই আছে। শুপাড়ি গাছ গুলি, সাজনা গাছ সবই আছে। এবারো তোমাদের ছাদের কাছের আম গাছ গুলিতে মৌ এসেছে। আমও এসেছে।
ধানমন্ডির বাসাটায়। প্রথম দেখা। বাসা নং …… সড়ক নং …..। তখন তুমি কেবল এগারো বছরে। খুব চঞ্চল। খালাতো আর মামাতো বোনদের নিয়ে বাসার খালি জায়গায়, পেয়ারা গাছে, ওয়ালের উপর দিয়ে দলবল নিয়ে। তোমার চলাচল। দলবল। দলবলের নেত্রী হয়ে, দল বলের লিডার হয়ে।
চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেনীতে তুমি তখনো্ খুব চঞ্চল, প্রফুল্ল। হাসিখুশির মেয়ে। ধীরে ধীরে উচ্চাতা বাড়ছে। থপ থপ করে এটা হাঁটার ধরণ। স্থির ভাবে তাকানো। নানান কৌতহল। তোমার স্বাস্থ্য বেশ ভালো। বাসার সামনের লেনে চক দিয়ে সাদা সাদা দাগ টেনে টেনে লাফিয়ে লাফিয়ে খেলা। ছাদে Skipping Ropes দিয়ে খেলা।
তখন লম্বা স্কুল বন্দের দিন। চৌবাচ্চাটার পাশে। পেয়ারা গাছ, বড়ই গাছের নিচে খালাতো বোনদের নিয়ে তোমার বন-ভোজনের রান্না বান্না আগুন জ্বালিয়ে। কখনো ছাদে শীত কালে, আগুন জ্বালিয়ে।
শ্রাবণ মাস মুষুল ধারে বৃষ্টি। তোমাদের শিড়ির দিকে বাড়ির প্রাচিরটি ভেংগে পড়ল। তোমার খুব আনান্দ। এবারে প্রাচির ছাড়া লেক দেখতে পাচ্ছ। লেকের পানি ছুঁতে পারছ। বড়শি দিয়ে মামাতো বোন সহ মাছ ধরারও চেষ্টা করেছ। তুমি বাড়ি ছোট্ট মেয়ে। এসব করাই তোমারই সাজে।
ষষ্ঠ শ্রেনী থেকে তোমার কথা বলা কমে আসলো, হাতে গনা গনা কথা বলা। বাসার ভিতরের লেনে পাশাপাশি চলার সময় হঠাৎ করেই ৪৫ ডিগ্রী কোনে দিক পরিবর্তন করে অন্তত চার ফুট দূর দিয়ে তুমি হাঁটতে। হঠাৎ দৃষ্টি সরিয়ে ফেলতে। তুমি ছিলে ” চকতি চাহনি ছল করে দেখা অনুক্ষণ”
তোমার মা তোমাকে পড়াতেন। তোমাদের বাসায় প্রায় কাজে যেত হত। তোমাদের খাবার ঘরে তুমি একদিন আমর সামনে বসা। সামনা সামনি। মুখোমুখি। তোমার মা কিছু ক্ষণের জন্য নেই। তুমি অংকের খাতা নিয়ে একা আমার সামনে বসা। শুধু আংগুলে এক, চার, সাত বার বার গোনা।
তুমি আরো শান্ত, আরো স্থির হলে যখন তুমি সপ্তম শ্রেনীতে। হাতে গনা গনা কথা বলা। বিদ্বান বাবার মেয়ে তুমি। রবি ঠাকুরের মত মন তোমার। লেখা পড়ায় মন ছিল না। তুমি কবিতা লিখতে না। বড় বোন, ভাই এর মত লেখা পড়ায় তুখোর ছিলে না। মায়ের পড়ার চাপে তোমার চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ত। কোন কথা বলতে না। তুমি পড়াশুনায় ভালো ছিলে না। তোমাকে লেখা পড়ায় আরো পক্ত করার জন্য তোমাকে আবারো সপ্তম শ্রেনীতে রাখা হলো।
অষ্টম শ্রেনীতে। বেশ বড় হয়েছ। তোমার ঘরের জানালা থেকে তুমি দাঁড়িয়ে বাসার সামনের দিকটাতে তাকিয়ে থাকতে। হঠাৎ দ্রুত সরে যেতে। আমরা, তোমার ভাই সহ যখন ব্যডমিন্টন খেলতাম। বিকালে ঘরের জানালা থেকে তুমি আমাদের খেলা দেখতে। আবার খুব কাছে এসেও খেলা দেখতে। ছাদ থেকে। সব সময়ই তোমার প্রিয় ……..য়া তোমার পাশে থাকতো।
তোমার জালানা থেকে লেকের পাড় দেখা যেত। আমরা বন্ধুরা মিলে যেখানে দাঁড়াতাম। বসতাম। সেখান থেকে তোমাকে দেখার আগেই তুমি তোমার জালানা থেকে দ্রুত আড়াল হতে।
নবম দশম শ্রেনীতে। বেশ পড়ার চাপ। প্রায় প্রতি দিনেই হরতাল। সন্ধ্যা হওয়ার আগে আমরা ….. নং রোডের বাসার সামনে থেকে লেকের পাড় পর্যস্ত হাঁটাহাটি করতাম। তোমার প্রিয় ……..য়া সহ তুমিও হাটতে। কোন কোন দিন তোমার মায়ের সাথে। মগরীবের আজানের সময় খুব দ্রুত রুমে ফিরতে। খু্ব ছোট্ট থেকে নামাজে কখোনো অনিয়মিত হতে না।
কারফিউ। দেখা মাত্র গুলির নির্দেশ এসব দিন গুলিতে আমরা ঘর থেকে বের হতাম না। সে দিন গুলিতেও আমরা তখন ধানমন্ডির বাসাটায়। টিভি খবরে, রেডিওতে আমাদের, পরিবারের সবার মন থাকত। একটা উৎকন্ঠা কাজ করত সবার মধ্যে। কখনো কখনো এর চেয়েও আরো বেশি উৎকন্ঠা কাজ করেছে আমাদের মনে।
তুমি কিশোরী থেকে তরুনীর পথে। গায়ের রঙ আরো সাদা হয়েছে। স্বাস্থ্য ছোট্ট বেলা খেকেই বেশ ভালো। টনসিলের সমস্যটা ছিল। বিখ্যাত শিশু বিশেষজ্ঞ ড. ………. খান তোমার চিকিৎসা করাতেন। কয়েক দিন থেকে তোমার জ্বর। তোমার বাবা খুব ব্যস্ত থাকতেন। একই বাসায় থেকেও তোমার বাবা জানতেন না তোমার জ্বর। টনসিলের জন্য। তোমার বাবা তোমাদের বড় রান্না ঘরে। সেখানেই তোমার মা উত্তর দিলেন। তোমার বাবা পত্র প্রচন্ড শব্দে রান্না ঘরের সমস্ত কাঁচের জিনিস পত্র ভেংগে ফেললেন। হঠাৎ তোমাদের বাসাটা চুপচাপ। তুমি জানতে তোমার বাবা তোমাকে কত ভালোবাসতেন।
এবার তুমি তোমার প্রিয় বালিকা বিদ্যালয় থেকে হোম ইকনোমিক্স কলেজে ভার্সিটিতে। এস. এস. সি তে তুমি তেমন ভালো রেজাল্ট করলে না। তবুও তোমার বাবা খুব খুশি ছিলেন। কিন্তু, তুমি ভালো রেজাল্ট করলে এইস. এস. সিতে।
পরীর মত সুন্দরীদের যে বর্ণনা, সেই বর্ণনার মত সুন্দরী তুমি ছিলে না। তোমার নিচ তলার আন্টি সব সময় সে কথাই বলতেন। তিনি ( তোমার নিচ তলার আন্টি ) পরীর বর্ণনার মত সুন্দরী ছিলেন। তোমার নিচ তলার আন্টিদের সাথে আমার প্রায় দুই যুগের বেশি সময় ধরে অরক্তের সম্পর্ক। তোমার নিচ তলার আন্টি আমাকে কখনো অপুত্র হিসাবে দেখেন নি। আজও না। এটা তোমারো জানা। তোমার নিচ তলার আন্টির একমাত্র মেয়ে তোমার চেয়ে তিন বছরের ছোট্ট ছিল। আকস্মিক ভাবে সে চির দিনের ঠিকানায় চলে গেল। বাড়িটাতে পাথর শোক। একটানা মিলাদ মহফিল চলল ৪০ দিন পর্যন্ত। তুমিও চওড়া ওড়না মাথায় দিয়ে মিলাদে আসতে, তোমার মায়ের সাথে তোমার প্রিয় ……য়ার সাথে। তবুও বাসাটার শোক কাটত না।
আজও শুধু তোমার নিচ তলার আন্টিদের বাসাই যাওয়া নিয়মিত। ওনারা এখন গুলশানে। গুলশানে যাওয়ার সময় আমার স্বহধর্মনি প্রিয় সব রান্না করে নিয়ে যান। অসুস্থ তিনি। কখনো কখনো গুলশানে গেলে তোমার প্রসগং উঠে আসে। নব্বই এর দশকের দিনগুলিতে আমাদের আন্টি বা তোমার নিচ তলার আন্টি অস্পষ্ট ঈগিতে আমাকে “না” বলতেন। তুমি বড় লোকে মেয়ে তাও বলতেন। সাজ গোজ তোমার অনেক পছন্দ। সখ। দামি সব গয়না পড়ার সখ। তোমার মা কিনেও দিতেন।
প্রতি বছরে আগস্ট মাসের মিলাদ মহফিলে তুমি আসতে। ২০০৯ এ আমাদের বাড়িটিতে এ্যপ্রিলে আরো একটা মিলাদ মহফিলে যোগ হলো। সে মিলাদ মহফিল্ও তুমি এসেছিলে।
২০০৯ ফ্রেব্রুয়ারীতে সকালে বিডিআর সদর দপ্তরে প্রচন্ড গোলাগুলি। তুমি থাকলে তোমার প্রিয় জানালা থেকে সবই দেখতে পেতে। সেদিন আমরার সবাই আতংকিত হলাম। সেদিনের ………..মোড় টাতে যেখান থেকে আমরা রিক্সা নিতাম। সেখানে মিডিয়ার গাড়ি। সেনা বাহিনীর টহল। এলাকা থমথমে। অনেকে এলাকা ছেড়েছে। …. নং রোডের মাথায় পশ্চিম দিকে তাক করা কামান। কামান চালকের স্থির দৃষ্টি। আমাদের ঘরে বড় চাচী অসুস্থ। বিকালে নির্দেশ আসলো্ এলাকা ছাড়ার। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম বড় চাচীকে স্কোয়ারে ভর্তি করাব। বড় চাচীকে স্কোয়ারে ভর্তি হলেন। ৪১ দিন স্কোয়ারে হাসপাতালে থেকে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ….নম্বর বাসায় ফিরলেন। তবে নিশ্বাস ছাড়া। তুমি বেশ সকালে বড় চাচীকে শেষ দেখা দেখতে আসলে। বড় চাচীকে দেখলে।
তখনো তোমর মন পড়ে ছিল। তোমার প্রিয় জালানায়। যেখানে তুমি দাঁড়াতে। খানিক ক্ষণ দাঁড়িয়ে তোমার প্রিয় শিউলি গাছ, পেয়ারা গাছ, বড়ই গাছ। শুপাড়ি গাছ গুলি, সাজনা গাছ। সবই তুমি দেখলে। তোমার মেহেদী গাছ।
মেহেদী হাতে দেওয়া তোমার খুব সখ ছিল। বিশেষ করে সবেবরাতের রাতে। কলিং বেল বাজিয়ে তুমি দাঁড়িয়ে থাকতে। দরজা খুলে দিতেই মেহেদী পাতার ছিঁড়ার ইচ্রছার কথা বলতে। হ্যা সূচক উত্তর পেলে তোমার মুখে একটি সরল হাসি ফুটত।
যে হাসিতে তোমার মনের, অন্তরের সমস্ত জায়গাগুলি অতি স্বচ্ছ ভাবে দেখা যেত। কত স্বচ্ছতা তোমার মনে। অন্তরে।
এমন হাজার লাইন দিয়ে লিখেও এ চিঠি লেখা শেষ হবে না।
তোমার সঠিক আকার আমার জানা নেই। হিমালয়ের উচ্চতায় তুমি উঠানো ছিলে। তুমি সেখানেই আছো। একবার সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠলে তাঁকে আর নামানো যায় না।
……. সকালে রাস্তায় হাঁটতে তোমার মায়ের সাথে আমার বোনের দেখা হয়। তোমার মা সব সময় আমার বোনের কাছে আমার খবর জানতে চায়। কখন !! কোথায় !! কি !! এই সব। তোমার মায়ের প্রতি শ্রদ্ধায় আমার মন ভরে উঠে।
এ বছর ৬ ই এপ্রিল মিলাদ মহফিল ছিল। মিলাদে তোমার প্রিয় ……য়া এসেছিল। ……য়ার ছেলে অনেক বড় হয়েছে। তোমার প্রিয় ……য়ার সাথে কথা হল। তুমি কিছু সময়ের জন্যে দেশের বাইরে। বিদেশে তোমার বাবা ও মায়ের চিকিৎসা চলছে। তোমার বাবা ও মায়ের জন্য রইল আমার দোয়া।
পুরানা কথায়, পুরানা স্মৃতিতে, পুরানা দিনে ফিরে গেলে যে ব্যথা থাকে, কতক গুলি যে দীর্ঘ শ্বাস থাকে, আজ তা স্পষ্ট হলো।
ভালো থাকবে।
তারিখ : এপ্রিল ১৮, ২০১২ (স)
রেটিং করুনঃ ,