লেখক: বৈষ্ণ রায়, দ্য হিন্দুর সহযোগী সম্পাদক।
বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা নামটি শুনলেই অনেকে নড়েচড়ে বসেন। এ প্রতিযোগিতা নিয়ে আগ্রহ নেই এমন মানুষ কমই খুঁজে পাওয়া যায়। ২১ বছর পর আবারও মিস ইউনিভার্স পেল ভারত। বিশ্বসুন্দরীর মুকুট পেয়ে ভারতের অনেকে যখন আনন্দে মেতেছেন, তখন প্রতিযোগিতার অন্য আরেকটি দিক তুলে ধরেছেন দ্য হিন্দুর সহযোগী সম্পাদক সাংবাদিক বৈষ্ণ রায় বলেন, ‘করোনা মহামারি হয়তো আমাদের চিন্তাভাবনায় ছাপ রাখবে বলে ভেবেছিলেন অনেকে। অনেকে ভেবেছিলেন, এবার হয়তো মানুষ বিশ্বকে ভিন্নভাবে দেখবে। নারীর ফ্যাশন ও সৌন্দর্যের চেয়ে তাঁর মনুষ্যত্বের মূল্যায়ন করা হবে। কিন্তু করোনাও চিন্তাভাবনায় খুব বেশি বদল আনেনি। বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা বাণিজ্য হিসেবেই থেকে গেছে। সৌন্দর্যের বিচারে যখন নারীর ক্ষমতায়ন করা হয়, সেটি নারীর মানসিকতার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।’
বৈষ্ণ রায় বলছেন, কার নাক কতটা নিখুঁত, কার ত্বক কতটা মোলায়েম—এগুলোই বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার মাপকাঠি। কার সৌন্দর্য কত নিখুঁত, তা যাচাই করতে যখন পুরো একটি দল কাজ করে, তখন তা জীবনের বাস্তবতাকে কতটুকু তুলে ধরে, সে প্রশ্ন তুলেছেন বৈষ্ণ রায়। তিনি বলেন, শেষ বিচারে বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় নিখুঁত সৌন্দর্যের উদ্যাপন করা হয়। এ প্রতিযোগিতাকে অনেকটা নিখুঁত ম্যানেকিন তৈরির সঙ্গে তুলনা করেছেন বৈষ্ণ রায়।।
বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা ২০২১ দেখার সময় মিস প্যারাগুয়ে ও মিস ইন্ডিয়ার মধ্যে পার্থক্য বুঝতে পারছিলেন না বৈষ্ণ রায়। ক্যামেরা যখন ঘুরছিল, তখন দুই বিশ্বসুন্দরী একে অন্যের হাত ধরাধরি করেছিলেন। বৈষ্ণ রায়ের তখন তাঁদের দেখে মনে হচ্ছিল, স্কুলের দুই ছাত্রী। একপর্যায়ে মনে হয়েছে যমজ বোনের মতোও।
এমন মনে হওয়ার কারণটাও ব্যাখ্যা করেছেন বৈষ্ণ রায়। বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার বিভিন্ন ধাপগুলো অর্থহীন এবং প্রতিযোগীদের জন্য বেদনাদায়ক বলে মনে করেন তিনি। সেখানে সব প্রতিযোগীই একই রকম সাজে, পোশাকে থাকেন। তাঁদের শারীরিক গড়নও প্রতিযোগিতার শর্ত অনুসারে একই রকম হয়। বিশ্বসুন্দরীদের পোশাকও হয় পশ্চিমা আদলে। পাশ্চাত্যে যেটি সৈকতের পোশাক, সে ধরনের পোশাকেই থাকেন প্রতিযোগীরা।
প্রতিযোগিতার একমুহূর্তে যখন ভারতের বিশ্বসুন্দরী হারনাজ সান্ধুর সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনা চলছিল, তখন তিনি বলেন, এর বাইরে পৃথিবীতে আরও অনেক সমস্যা রয়েছে। তা নিয়ে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি। কিন্তু বৈষ্ণ রায় লক্ষ করেছেন, পৃথিবীর অন্য অনেক সংকটের কথা বললেও ইসরায়েলে বসে ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে কথা বলতে ভুলে যান হারনাজ। এবার ইসরায়েলের এইলাটে বসেছিল ৭০তম মিস ইউনিভার্সের আসর। কিন্তু ফিলিস্তিনে ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ ও সেখানকার সংকট নিয়ে প্রতিযোগী বা আয়োজকদের কেউই কোনো কথা বলেননি।
বৈষ্ণ রায় লক্ষ করেছেন, সেখানে কয়েকজন প্রতিযোগী ফিলিস্তিনের পোশাক পরেছিলেন। তাঁদের সঙ্গে ফিলিস্তিনের খাবারও ছিল। কিন্তু ছিল ইসরায়েল হ্যাশট্যাগ। বৈষ্ণ রায়ের মতে, এভাবে তাঁরাও ফিলিস্তিনকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলার প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছিলেন।
প্রতিযোগিতার একপর্যায়ে হারনাজ বলেছেন, নিজেকে অনন্য মনে করতে হবে। অন্যের সঙ্গে নিজের তুলনা বন্ধ করতে হবে। হারনাজের এ কথাকে স্ববিরোধী বলে মনে করেন বৈষ্ণ রায়। কারণ, হারনাজ এমন এক প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন, যেখানে ৮০ জনকে সবচেয়ে সুন্দর হিসেবে ঘোষণা করা হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে আবার শীর্ষ ১০ জনকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে। আর এর মধ্য থেকে সবচেয়ে সুন্দর হিসেবে একজনকে বাছাই করা হয়েছে। বৈষ্ণ রায় বলেন, একে অন্যের সঙ্গে তুলনাই এই প্রতিযোগিতার মূল বিষয়। সেখানে নিজেকে অনন্য ভাবার কথা বলা অর্থহীন বলে তিনি মনে করেন।
বৈষ্ণ রায় সুন্দরী প্রতিযোগিতার নিয়মকানুনকে কটাক্ষ করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীরা ক্যাট ওয়াকে অংশ নেয়। তাঁদের মধ্যে অনেকে হাইহিল পরেছিলেন। গাউন পরে ওই ঢঙে হাঁটা তাঁদের জন্য খুব কঠিন ছিল। তাঁদের পোশাক ও সাজে নিজ দেশের কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না। তাঁদের কিছুক্ষণ পরপরই হাসতে হচ্ছিল। তাঁর মতে, পুরো প্রক্রিয়াই ছিল নির্বোধের মতো, দুঃখজনক।
বৈষ্ণ রায়ের মতে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদের অনেকে শিশু ও নারী অধিকার নিয়ে কাজ করেছেন। তবে প্রতিযোগীদের কাজের কোনো উল্লেখ এখানে থাকে না। প্রতিযোগিতায় তাঁদের যাচাইয়ের মানদণ্ড হয় উচ্চতা, ওজন, শরীরের গড়ন, দাঁত ও নাক। কারণ, এখানে নারীরা তাঁদের শারীরিক বা বাহ্যিক সৌন্দর্যের জন্য পুরস্কৃত হন।
এ প্রতিযোগিতার নিয়ম ও যৌক্তিকতা নিয়ে যাঁরা সমালোচনা করেন, জবাবে তাঁদের বলা হয়, এটি নারীদের ক্ষমতায়নের সুযোগ।
এ প্রসঙ্গে বৈষ্ণ রায় উল্লেখ করেছেন নেলসন ম্যান্ডেলার নাতির কথা। তিনি যখন বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা বয়কটের ডাক দেন, তখন মিস ইউনিভার্স ইরাক তীব্র সমালোচনা করেন। প্রশ্ন তোলেন, নারী ও নারীদের ক্ষমতায়নের সংগঠন নিয়ে একজন পুরুষ কেন কথা বলবেন? তিনি বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতাকে নিজেদের দেশের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য নারীদের অংশগ্রহণের একটি সুযোগ বলে মত দেন।
বৈষ্ণ রায়ের মতে, ক্ষমতায়ন ও পছন্দ—এ দুটি শব্দ বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এ প্রতিযোগিতাকে তিনি মনে করেন প্রসাধনসামগ্রী ও ফ্যাশনের বাণিজ্যিকীকরণ। এ রকম ভোগাবাদী ব্যবস্থার সঙ্গে ক্ষমতায়নের বিষয়টি মেলানো দুঃখজনক বলে মনে হয় বৈষ্ণ রায়ের কাছে।
সাংবাদিক বৈষ্ণ রায় বলেন, ‘করোনা মহামারি হয়তো আমাদের চিন্তাভাবনায় ছাপ রাখবে বলে ভেবেছিলেন অনেকে। অনেকে ভেবেছিলেন, এবার হয়তো মানুষ বিশ্বকে ভিন্নভাবে দেখবে। নারীর ফ্যাশন ও সৌন্দর্যের চেয়ে তাঁর মনুষ্যত্বের মূল্যায়ন করা হবে। কিন্তু করোনাও চিন্তাভাবনায় খুব বেশি বদল আনেনি। বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতা বাণিজ্য হিসেবেই থেকে গেছে। সৌন্দর্যের বিচারে যখন নারীর ক্ষমতায়ন করা হয়, সেটি নারীর মানসিকতার ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে।’
বৈষ্ণ রায় বলছেন, কার নাক কতটা নিখুঁত, কার ত্বক কতটা মোলায়েম—এগুলোই বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতার মাপকাঠি। কার সৌন্দর্য কত নিখুঁত, তা যাচাই করতে যখন পুরো একটি দল কাজ করে, তখন তা জীবনের বাস্তবতাকে কতটুকু তুলে ধরে, সে প্রশ্ন তুলেছেন বৈষ্ণ রায়। তিনি বলেন, শেষ বিচারে বিশ্বসুন্দরী প্রতিযোগিতায় নিখুঁত সৌন্দর্যের উদ্যাপন করা হয়। এ প্রতিযোগিতাকে অনেকটা নিখুঁত ম্যানেকিন তৈরির সঙ্গে তুলনা করেছেন বৈষ্ণ রায়।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ডিসেম্বর ১৯, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,