শ্রীযুত জলসা সম্পাদক মহাশয় সমীপেষূ,
মহাশয়,
সচরাচর আমি পাঠকদের জন্যই আপনার কাগজে লিখে থাকি (এবং আপনার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আছি, যে প্রতি সংখ্যায়ই কিছু লেখা দেব)। আপনার পড়ার জন্য নয়। কারণ আমি নিন্দুকের মুখে শুনেছি, সম্পাদকেরা এত ঝামেলার ভিতর পত্রিকা প্রকাশ করেন যে তারপর প্রবন্ধগুলো পড়ার মত মুখে আর তাঁদের লালা থাকে না। কথাটা হয়তো একেবারে মিথ্যা নয়। কারণ যেদিন আমি
তিন্তিড়ী পলাণ্ডু লঙ্কা লয়ে সযতনে
উচ্ছে আর ইক্ষুগুড় করি বিড়ম্বিত
প্রপঞ্চ ফোঁড়ন লয়ে
রন্ধন কর্ম সমাধান করি, সেদিন আমারও ক্ষিদে সম্পূর্ণ লোপ পায়।…অন্তত আমার লেখা যে আপনি একেবারেই পড়েন না, সে-বিষয়ে আমি সুনিশ্চয় – কারণ পড়া থাকলে দ্বিতীয়বারের জন্য লেখা চাইতেন না। ন্যাড়া একাধিক বার যেতে পারে বেলতলা – নিমতলা কিন্তু যায় একবারই।…
…যে দোষ আপনি করেছেন, তার গালমন্দ আপনিই খাবেন, এ তো হক্ কথা, এ তো আপনার ন্যায্য প্রাপ্য। তাই তাতে আপনার ক্ষোভ থাকাটা অশোভন, কিন্তু সংসারটা তো ন্যায়ের উপর চলে না, সে কথা তো আপনার বিলক্ষণ জানেন – তাই মাঝে মাঝে অন্যায় অপবাদ সইতে হয়।…
…গেল মাসে মিস গেছে তার জন্য আমি সম্পূর্ণ দায়ী নই। বড় লেখক হলে আমি অনায়াসে বলতে পারতুম, ‘মশাই, ইন্স্পিরেশন্ আসেনি – আমি কি দর্জি না ছুতোর অর্ডার-মাফিক মাল দেব?’ তা নয়। আমি সাধারণ লেখক। আমি আজ পর্যন্ত কখনো ইন্স্পায়ার্ড হয়ে লিখিনি। আমি লিখি পেটের ধান্দায়। পূর্বেই বলেছি, চতুর্দিকে আমার পাওনাদার। কে বলে আমি টাকার মূল্য বুঝিনে। একটু বেশি ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে, তবু না বলে উপায় নেই, আপনি হয়তো লক্ষ্য করেননি, আমি চাকরিতে থাকাকালীন কোনো প্রকারের ‘সাহিত্যসৃষ্টি’ করিনে – চাকরিতে থাকাকালীন আমার কোন বই বেরয়নি। তখন তো পকেট গরম, লিখতে যাবে কোন মূর্খ। অতএব ইন্স্পিরেশনের দোহাই কাড়লে অধর্ম হবে।…
…বেশীরভাগ সময়ই চলে যায় টুকিটাকি লিখে হাঁড়ির চাল জোগাড় করতে। তদুপরি আমার লেখার মন নেই, আছে পড়ার শখ। অবকাশ পেলেই মনে হয়, আরেকটু পড়ে নিই। এখন প্রচণ্ড এক মৌতাত। এর থেকে এ জীবনে আর নিষ্কৃতি পাব না।…
…আমার মা বলতো, আমাকে দেখলে যতটা বোকা বলে মনে হয়, আমি ততটা বোকা নই; আর বড়দা বলতো, আমাকে দেখলে যতটা বুদ্ধিমান বলে মনে হয়, আমি ততটা বুদ্ধিমান নই। কোন্টা ঠিক জানিনে, তবে আমার স্মৃতিশক্তিটি ভালো সে-কথাটা উভয়েই স্বীকার করতেন।…
…দম্ভভরে বলছি, আমি শঙ্কর কপিল পড়েছি, কান্ট হেগেল আমার কাছে অজানা নন। অলঙ্কার নব্যন্যায় খুঁচিয়ে দেখেছি, ভয় পাইনি। উপনিষদ, সুফীতত্ত্বও আমার কাছে বিভীষিকা নয়। আমার পরীক্ষা নিয়ে সত্যেন বোসের এক সহকর্মী আমাকে বলেছিলেন, তিন বছরে তিনি আমায় রিলেটিভিটি কলকাতার দুগ্ধবত্তরলম্ করে দিতে পারবেন। পুনরূপি দম্ভভরে বলছি, জ্ঞানবিজ্ঞানের হেন বস্তু যেই যার সামনে দাঁড়িয়ে হকচকিয়ে বলেছি, এ জিনিস? না এ জিনিস আমাদ্বারা কক্খনো হবে না। আপ্রাণ চেষ্টা করলেও হবে না।…
…গুরুচণ্ডালী নিয়ে আলোচনা একাধিক স্থলে দেখেছি। চলতি ভাষা আরম্ভ হওয়ার পূর্বে এটাকে অমার্জনীয় অপরাধ ও অনুশাসন রূপে সম্মান করা হত। যদিও, যে দ্বিজেন্দ্র নাথকে রবীন্দ্রনাথ বাংলাভাষার সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ রূপে সশ্রদ্ধ সম্মান জানাতেন, তিনি স্বয়ং সে অনুশাসন তার কঠিনতম সংস্কৃত পদে পরিপূর্ণ বাংলা-দর্শন গ্রন্থে পদেপদে লক্ষ্য করতেন ও সবাইকে সে উপদেশ দিতেন। অধীন দ্বিজেন্দ্রনাথের আদেশ বাল্যকাল থেকে মেনে নিয়েছি।…ভাষার দিক দিয়ে আমি একটু সংস্কারের চেষ্টা করেছি। গুরু ও চণ্ডালকে এক পংক্তি ভোজনে বসিয়ে দিয়েছি – গুরুচণ্ডালী দোষ যে আসলে গুণ, গৌড়জনকে তা বোঝাবার চেষ্টা করেছি।…
…স্বীকার করলাম, বাংলাভাষায় হিন্দুর উত্তরাধিকারিত্ব আছে যথেষ্ট পরিমাণে, কিন্তু এটাই তো শেষ কথা নয়। আমি বলব হিন্দুত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করতেই সৃষ্টি হয়েছে বাংলাভাষার।…মাতৃভাষা যদি শিক্ষার মাধ্যমের মর্যাদা না পায়, তবে শিক্ষা বস্তুটা অনিবার্যভাবে উপর তলার লোকেদের একচেটিয়া অধিকারে চলে যাবে এবং শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের ফলে শুরু হবে শ্রেণী সংঘাত। জন্ম নেবে নবতর অর্থনৈতিক সমস্যা। দারিদ্র-পীড়িত লোকের কাছে শিক্ষা হবে ব্যয় বহুলতার কলংকে কলংকিত। আকাশচুম্বি বস্তুকে ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হবে দেশের বৃহত্তর ছাত্রসমাজ। শিক্ষার আঁতুড় ঘরে জীবনের সব আশা আকাঙ্ক্ষার সমাধি রচনা করে চিরদিনের জন্য তারা স্থবির হয়ে যাবে। মিথ্যে হয়ে যাবে লক্ষ-কোটি জীবনের হাজারো সম্ভাবনাময় সৃজনীশক্তি, তৈলহীনতার অভিশাপে অভিশপ্ত হবে। একে কিছুতেই রোধ করা যাবে না।…
প্রিয় সইফুল (সয়ফ্-উল আলম খান, মুজতবা আলীর স্কুল জীবনের সহপাঠী ও বন্ধু। আইনজীবি),
অনেকদিন ধরে ভাবছি তোমাকে একটা দীর্ঘ পত্র লিখবো কিন্তু লজ্জার কথা হলেও অস্বীকার করার জো নেই সে সময় করে উঠতে পারিনি।
…তারপর চিরন্তন ভাবনা শুরু হল, কি লিখি। বসন্তকাল এসেছে যদিও বৈজ্ঞানিক জগতে থাকার দরুন মানুষের বসন্তকালে যে স্পৃহা জাগে সেটা কমে গিয়েছে তবুও অনেকেই তো আছে – তার ধাক্কা পাচ্ছি, কাজেই যখন রবিবাবুর নতুন গান –
“যদি তারে নাই চিনি গো
সে কি আমায় নেবে চিনে
এই নব ফাল্গুনের দিনে –”
শুনি, তখনই মন কেমন ধারা খারাপ হয়ে যায় কিছুই ভাল লাগে না। তাই একজনকে পাশে পাবার ভারী ইচ্ছা হয় – সে যেই হউক। তবে কপাল কোন শ্রীমতী এখনো ঘাড়ে চাপেননি, না হয় আমাকে এ সব লিখতে দেখলে কোন কাণ্ডই কোরে বসতেন।
চণ্ডীদাস পড়ছিলুম। বড্ড ভাল লাগে। এত simple যে অবাক হয়ে যেতে হয় কেমন করে এত সহজ সরল ভাষায় কবিতা লিখে অমর হয়ে গেল। না আছে শব্দের ঝংকার, না আছে তুলনার বৈচিত্র্য।…
প্রিয় সইফুল,
…তাইত একপাতা হয়ে গেল। কিন্তু লিখলুম কি? সেই পুরাতন ও নিত্যনতুন আদি রস সম্বন্ধে কতকগুলো বাজে কথা। তার অর্থও নেই তা করে অর্থও পাওয়া যায় না।
লেখাপড়া ভালো চলচে না। শরীর ও মন দুইই ভালো বটে কিন্তু তবুও কেমন পড়াশুনায় মন বসে না। সেটা নিশ্চয়ই আমারই দোষ কিন্তু দোষটা আবিষ্কার করতে পারলেই সেটা কেটে যায় না। কি বল?
শাস্ত্রী মশাই (বিধুশেখর শাস্ত্রী) আমাকে একটা বৌদ্ধ সন্ন্যাসীকে ইংরিজী পড়াবার জন্য দিয়েছেন। ভদ্রলোকটি বর্ম্মদেশীয়। ভাষা জানেন পালি ও বার্মিজ। কাজেই ইংরিজী পড়ানো যে কতবড় ঝকমারি তা তুমি বুঝতেই পারবে না। একটা শব্দ বুঝাবার জন্য কতপ্রকার যে হাত পা নাড়িয়ে লম্ফ-ঝম্ফ করতে হয় তার কোনো ইয়ত্তাই নেই।
রবিবাবু একটা নূতন ড্রামা লিখেছেন সেটার নাম বোধ হয় যক্ষপুরী (রক্তকরবী প্রসঙ্গে)। সেদিন সেটা পড়লেন। খুব ভালোই লাগল। তবে বড্ড Complicated বলে মনে হয়। দেখা যাক বেরুলে লোকে কি বলে। তবে কেউ কেউ বলে মুক্তধারার চাইতে নাকি সহজ হয়েছে।
আমার মাথাটা যেন কে চাবি বন্ধ করে দিয়েছে। কিছুই বেরুচ্ছে না। কেন যে এমন কাহিল অবস্থা হ’ল কিছুই বুঝতে পারছি নে।…
প্রিয় সইফুল,
…বসন্ত আসায় সব নতুন পাতায় শালগাছগুলি ভরে গিয়েছে। পাখীর কাকলী শুনা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে কোকিলের আওয়াজ। প্রেম ত কোরেচি কিন্তু কোকিলের আওয়াজ শুনে ত প্রাণে কোনো নূতন ভাবোদয় হয় না। ছ্যাকড়া গাড়ীর ঘোড়ার কানে বাজনার আওয়াজ ভাল লাগে না। সমস্ত জীবন গাড়ীর আওয়াজে কান তার খারাপ হয়ে গিয়েচে। সংসার-কোলাহল কানটা এত খারাপ করে দিয়েচে যে কোকিলের আওয়াজ তাতে কোন সুরেরই সৃষ্টি করে না।
আমার মনটা কেমন ভারগ্রস্থ হয়ে গেচে। তবে টাইলের লাল রঙ যেমন ধুলোয় কিছুদিনের জন্য আচ্ছন্ন হয়ে থাকলে কোনো দুঃখের কারণ নেই – এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেলেই ফের সাফ হয়ে যায়। তেমনি ভরসা আছে, মনের এই জড়তা কেটে যাবে। কিন্তু সে ঝড়, কি-রথে হয়ে আসবে কে বলতে পারে।…
____________
যেগুলো থেকে লেখা…
প্রসঙ্গ : মুজতবা আলী, বিজনবিহারী পুরকায়স্থ সম্পাদিত, নবপত্র প্রকাশন
ভবঘুরে ও অন্যান্য, সৈয়দ মুজতবা আলী, তন্ময় প্রকাশনী
কত না অশ্রু জল, সৈয়দ মুজতবা আলী, ষ্টুডেন্ট ওয়েজ
অন্তরঙ্গ আলোকে সৈয়দ মুজতবা আলী, সৈয়দ মহবুব আলী, উৎস প্রকাশন
সংগৃহিত।
তারিখ: অক্টোবর ০৮, ২০২০
রেটিং করুনঃ ,