লেখক: এম আর আলম সৈয়দপুর, নীলফামারী।
ঘরের একটি কক্ষে বাস করেন তাঁরা। আরেক কক্ষে বসানো হয়েছে সেলাই মেশিন। এসব মেশিনে তৈরি হচ্ছে জ্যাকেট, টি–শার্ট, জিনসের প্যান্টসহ নানা ধরনের শীতের পোশাক। নতুন কাপড় নয়, পোশাক কারখানার উচ্ছিষ্ট কাপড় (ঝুট) দিয়ে এসব তৈরি হয়। এর মধ্যে কিছু পোশাক বিদেশে বিক্রি হয়। কিছু বিক্রি হয় দেশের বাজারে। নিজেদের বাড়িতে ছোট এ কারখানা গড়ে তুলেছেন রিয়াজ–সালমা দম্পতি।
মাত্র তিনটি মেশিনে ভাগ্য খুলেছে রিয়াজ–সালমা দম্পতির। এখন তাঁদের কারখানায় ১৫টি মেশিন। প্রতি মাসে ৪০ হাজার টাকা আয় করেন তাঁরা। নীলফামারীর সৈয়দপুরে রিয়াজ ও সালমার পরিবারের মতো পাঁচ শতাধিক পরিবার ঝুট কাপড় থেকে পোশাক তৈরি করে এভাবে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। আর এ শিল্প এখন দেখাচ্ছে অফুরন্ত সম্ভাবনার স্বপ্ন। মূলত তাঁরা ভারত, ভুটান ও নেপালে পোশাক রপ্তানি করেন। প্রতিবছর গড়ে দেশ ও বিদেশের বাজারে অর্ধশত কোটি টাকার পোশাক বিক্রি করেন তাঁরা। ধীরে ধীরে এসব কারখানায় পোশাক তৈরি ও ব্যবসা বাড়ছে।
এ বিষয়ে সৈয়দপুরের রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক সমিতির সভাপতি আখতার হোসেন খান বলেন, এবারের শীত মৌসুমে সৈয়দপুরের পাঁচ শতাধিক কারখানা থেকে ৬০ হাজার জ্যাকেট, ৩০ হাজার ট্রাউজার, ১ লাখ থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট ও ১ লাখ শর্টস তৈরি করা হবে।
পৌর এলাকার কয়ানিজপাড়া, মুন্সিপাড়া, সৈয়দপুর প্লাজা, নয়াটোলা, হাতিখানা, মিস্ত্রিপাড়া, নতুন বাবুপাড়া পুরাতন বাবুপাড়া, গোলাহাট, বাঁশবাড়ী, বোতলাগাড়ী, নিয়ামতপুরসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে এসব পোশাক কারখানা। এসব কারখানায় সর্বনিম্ন দুটি থেকে সর্বোচ্চ ৪৫টি পর্যন্ত সেলাই মেশিন রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সৈয়দপুরের ক্ষুদ্র পোশাক কারখানার মালিকেরা ঢাকার মিরপুর, সাভার, গাজীপুর, টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানের পোশাক কারখানাগুলো থেকে ঝুট কাপড় কেজি দরে সংগ্রহ করেন। পরে এসব ঝুট কাপড় দিয়ে তৈরি হয় শীতের বিভিন্ন ধরনের পোশাক।
অফুরন্ত সম্ভাবনার স্বপ্ন
সম্প্রতি শহরের মুন্সিপাড়ায় রিয়াজ-সালমা দম্পতির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির একটি কক্ষে দুই সারিতে ১৫টি সেলাই মেশিন বসানো হয়েছে। এসবে খুটখুট শব্দ তুলে চলছিল জ্যাকেট সেলাইয়ের কাজ। শ্রমিকেরা ব্যস্ত। কেউ মাথা তুলে দেখছেন না। পোশাক কারখানার মালিক রিয়াজ জানান, ‘শীতের জন্য জ্যাকেট বানাচ্ছি। অনেক ব্যস্ততা। এখন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করাতে হচ্ছে।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা এসব কারখানাকে সরকার যদি নির্দিষ্ট জায়গায় আনার ব্যবস্থা করে দেয়, তাহলে এ শিল্পের সম্প্রসারণ ঘটবে এবং রপ্তানি আরও বাড়বে।
শহরের মুন্সিপাড়ার বিলাস গার্মেন্টসের মালিক লিটন জানান, ‘এখন আমার কারখানায় ৪০টি মেশিন আছে। কারিগর–হেলপার মিলে কাজ করে ৫০ জনের বেশি। শীতকালে বেশি অর্ডার পাওয়া যায়। কিন্তু সরকারি পর্যায়ে কোনো সুবিধা আমাদের নেই।’
সৈয়দপুর শহরের বাঁশবাড়ি মহল্লায় মো. সেলিম গড়ে তুলেছেন একটি মাঝারি আকারের তৈরি পোশাক কারখানা। ওই কারখানায় শুধু জ্যাকেট নয়, তৈরি হচ্ছে জিনসের প্যান্ট, হাফ প্যান্ট ও ট্রাউজার। কারখানাটিতে রয়েছে দেড় শতাধিক অটোমেটিক সেলাই মেশিন।
অফুরন্ত সম্ভাবনার স্বপ্ন
মো. সেলিম বলেন, ‘রপ্তানি আদেশের ওপর নির্ভরশীল হলে চলবে না। আমরা দেশের বাজারে সস্তায় বিপুল পরিমাণে সরবরাহ বাড়িয়েছি। দিন দিন চাহিদা বাড়ছে। বরিশাল, পটুয়াখালী, ঝালকাঠি, খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, কুষ্টিয়া থেকেও অর্ডার পাচ্ছি।’
ঝুট কাপড় দিয়ে তৈরি পোশাক বিক্রি হয় সৈয়দপুর শহরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মজিদ সড়কের একটি বিশাল বাজারে। সম্প্রতি এই বাজারে কথা হয় ঠাকুরগাঁও থেকে আসা পাইকারি পোশাক ব্যবসায়ী সিরাজুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সপ্তাহে একবার এখানে এসে জ্যাকেট ও ট্রাউজার কিনে নিয়ে যাই। এখান থেকে পাইকারি কিনে আমরা ঠাকুরগাঁও খোলাবাজারে বিক্রি করি। আবার সেখান থেকে বাংলাবান্ধা হয়ে অনেক ব্যবসায়ী এসব পণ্য ভারতে নিয়ে যান।’
বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, একটি ভালো মানের জ্যাকেট তৈরির মজুরি ১৫০-১৭০ টাকা। দিনে একজন কারিগর তিন থেকে চারটি জ্যাকেট তৈরি করতে পারেন।
রপ্তানিমুখী ক্ষুদ্র গার্মেন্টস মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান বলেন, ‘প্রতিবছর শীত মৌসুমে ভারতে পোশাক রপ্তানি করেন তাঁরা। বেশির ভাগ রপ্তানির ফরমাশ আসে ভারতের শিলিগুড়ি, আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয় থেকে। আমার কারখানায় কয়েক হাজার পোশাক তৈরি হয়।’ তিনি আরও বলেন, এবারের শীত মৌসুমে ৫০ কোটি টাকার জ্যাকেট ভারতে রপ্তানি হবে। এ ছাড়া সারা দেশে ১০০ কোটি টাকার তৈরি পোশাক রপ্তানি হবে বলে আশ করছেন তিনি।
সৈয়দপুর বণিক সমিতির সভাপতি ইদ্রিস আলী বলেন, সৈয়দপুরের ক্ষুদ্র পোশাক কারখানাগুলো রপ্তানি–বাণিজ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এটি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম খাতে পরিণত হয়েছে। তাই সরকারকে এ শিল্পের বিকাশে এগিয়ে আসা উচিত।
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:ডিসেম্বর ২২, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,