সেরা চিঠি ( এক ) – প্রথম আলো ব্লগ প্রিয় চিঠি আয়োজন ২০১৪
প্রায় এক শত পনেরোটি চিঠিরও বেশি চিঠির মধ্য থেকে কয়েকটি চিঠি (অন্তত পাঁচ বা সাতটি চিঠি) প্রাথমিক ভাবে নির্বাচন করা আর সেখান থেকে একটি মাত্র চিঠি আয়োজনের জন্য নির্বাচন করা বহু পরিশ্রমের, বহুপথ হাঁটার সমান, শুধু হাঁটা নয় একটি গন্তব্যে পৌঁছিয়ে সকল যাত্রার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে একটি চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসা। অনেকগুলি চিঠির গভীরে প্রবেশ করে চিঠির আত্মার সাথে আত্মা মিলিয়ে কথা বলে একটি সার্থকতা খুঁজে পাওয়া যেত যদি প্রাথমিক ভাবে নির্বাচন করা সব কয়েকটি চিঠিকে সেরা চিঠি বলে প্রকাশ করা যেত, নিয়ম মেনে চলার পৃথিবীতে নিয়ম মেনে চলতে হয় তাই হাতে ক্ষমতা শুধু একটি চিঠিকে সেরা চিঠিকে হিসাবে মনোনিত করা। ঠিক কোন সাতটা চিঠি প্রথমিক ভাবে বাছাই করে এনেছিলাম সেগুলির নাম উল্লেখ্য না করাই উচিত।
চিঠি নির্বাচনে আমার পক্ষ্য থেকে দুইটি বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রথমত, যারা বিভিন্ন ভাবে ব্লগকে প্রাণ-বন্ত রাখেন অন্ততঃ গত ছয় মাস ধরে মন্তব্যে ও নিয়মিত পোষ্ট দিয়ে, ব্লগে নিয়মিত নন এমন লেখক বা লেখিকার চিঠি আমার কাছে নির্বাচনের বিবেচ্য বিষয় হয়ে আসে নি, আমার ধারণা ব্লগকে প্রাণ-বন্ত রাখাটা অনেক কঠিন ও ত্যাগের কাজ সেই দিক দিয়ে বিজয়ী তাদেরই হওয়া সাজে।
দ্বিতীয়তঃ, নারী লেখিকাদের লেখায় প্রাধান্য দেওয়া। বিশেষ ক্ষেত্রে আমরা মনে করি সমাজ পরিবর্তনে দশ জন লেখক যে অবদান রাখেন যেখানে একজন নারী লেখিকা একাই সেই ভুমিকা রাখেন এবং আমাদের লক্ষ্য রাখা উচিত ব্লগে নারী লেখিকা অর্ধেক না হলেও যেন অর্ধেকের কাছাকাছি থাকেন তারা। আমরা অনেক নারী লেখিকাকে তাদের মতমত প্রকাশে সব সময় বা অনেক সময় সহযোগীতা করি এমন কথা আমার জোড় দিয়ে বলতে পারি না।
২০১৩ তে আমি একজন নারী লেখিকার চিঠি নির্বাচিত করার কারণে এবার দৃষ্টি ছিল পুরুষ লেখকের দিকে লেখক দীপংকর চন্দ এবারে একটি শিশু মনের মধ্যে অত্যান্ত নিঁখুত ভাবে প্রবেশ করে আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো নামে চিঠিটিতে একটি শিশুর আড়ালে থেকে শিশুটির মাকে খুব হালকা অথচ মর্মান্তিক ভাবে, আমাদের মনে শোক-গাঁথা হৃদয় কাঁদানো অনুভুতিতে একটি চিঠি লিখেছেন। আমার কাছে দীপংকর চন্দের চিঠিটি সেরা একটি চিঠি হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। চিঠিতে লেখক দীপংকর চন্দ খুব ছোট্ট একটি মেয়ের মনে প্রবেশ করে চিঠি লিখতে শুরু করেছেন যার মা এখন আকাশের তারা বা আমাদের কবি গুরুর বিখ্যাত কবিতার মত
” তুমি কি কেবল ছবি শুধু পটে লিখা ।
ওই যে সুদূর নীহারিকা
যারা করে আছে ভিড়
আকাশের নীড় ;
ওই যে যারা দিনরাত্রি
আ লো-হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী
গ্রহ তারা রবি ,
তুমি কি তাদেরি মতো সত্য নও ।
হায় ছবি , তুমি শুধু ছবি ? ”
আমাদের আর বুঝার বাকি থাকলো না যে ছোট্ট মেয়েটির মা এখন আর পৃথিবীর পরে নেই। শিশুটি ঠিক ষ্পষ্ট করে আমাদের বুঝেতে পারে নি যে তার মা কোথায় আছেন !! যেমন আমাদের কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার এক গানে কি ভাবে তিনি চলে গেলেন তা তিনি বুঝতে পারেন নি, কিন্তু কিছু একটা অনুভব করতে পারছিলেন ঠিক তেমনি করে ছোট্ট মেয়েটিও হয়তো বলতে চেয়েছে কবিগুরুর ভাষায়–
সে চলে গেল, বলে গেল না– সে কোথায় গেল ফিরে এল না।
সে যেতে যেতে চেয়ে গেল কী যেন গেয়ে গেল–
তাই আপন-মনে বসে আছি কুসুমবনেতে।
সে ঢেউয়ের মতন ভেসে গেছে, চাঁদের আলোর দেশে গেছে,
যেখান দিয়ে হেসে গেছে, হাসি তার রেখে গেছে রে–
মনে হল আঁখির কোণে আমায় যেন ডেকে গেছে সে।
আমি কোথায় যাব, কোথায় যাব, ভাবতেছি তাই একলা বসে।
পোষ্টের চিঠি লেখিকা ছোট্ট মেয়েটি গানের কথার মত হয়তো ভাবতেছি তাই একলা বসে গানের এই লাইনের মত তার মাকে চিঠি লেখার বিষয় ভাবছে কিন্তু সে চিঠি লিখতে পারে না তাই সে চিঠিতে লিখেছে ” …চিঠি কিন্তু আমি লিখছি না আম্মু, ” আর এমন মেয়ের ধারণা হতেই পারে তার মা গানের কথার মত চাঁদের আলোর দেশে গেছে, সেখানে গেছে তার মা। হয় তো সেই বিখ্যাত নেশার ঘোরে থেকে মেয়েটি তার মাকে ডাকছে যেমন কবিগুরু লিখেছেন ” শিশু যেমন মাকে নামের নেশায় ডাকে,” কিম্বা ছোট্ট মেয়েটি বাবার কাছে অনেক যত্নে অনেক খেয়ালে বা আদরে থেকেও মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে একটি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্যে, একটি নিরাপদ বিশ্রামের জন্যে যেমন মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর সমাধি-লিপি কবিতায় লিখেছেন-
” ( জননীর কোলে শিশু লভয়ে যেমতি বিরাম ) ”
সব শিশুই একটি নিরাপদ বিশ্রাম খুঁজে আর সেটা হচ্ছে তার মায়ের কোল, শুধু শিশুরা কেন আমার যারা আজ বড় হয়েছি তারা কি একটি নিরাপদ বিশ্রাম খুঁজার জন্য মাকে খুঁজি না। অথবা মা চিরে তরে চলে যাওয়ার পরেও কি মাকে খুঁজি না !!!!
চিঠির লেখিকা লিখেছে ” আম্মু, আব্বুটা না অনেক পঁচা হইছে.. সারাদিন অফিসে থাকে.. দেরি করে বাসায় আসে.. আমি বকি তো.. অনেক বকি, তবু শোনে না.. তুমি কবে আসবা..”
তুমি করে আসবা !!! এই প্রশ্নের উত্তর কে দিবে !!
চিঠির লেখিকা আরোও লিখেছে আব্বুর শরীর খারাপ হইছে, খায় না ঠিক মতো, বলি দুধ খাও, কথা শোনে না.. বকি তো অনেক বকি, খালি হাসে আর লেখে.. আমি ঘুমাই ঘুমাই অনেক ঘুমাই, তবু আব্বু ঘুমায় না, আব্বু কী লেখে আম্মু.
তবু আব্বু ঘুমায় না, আব্বু কী লেখে আম্মু.……এই প্রশ্নের উত্তর কে দিবে !!
চিঠির লেখিকার নানান প্রশ্ন যেমন ” আব্বু বলতেছে ভাত নাকি আজকেও পুড়বে- তুমি আসবা তাড়াতাড়ি-“
তুমি আসবা তাড়াতাড়ি – চিঠির লেখিকার এই আবেদন, মায়ের প্রতি আদেশ এ সব কি পূর্ণ হবে কোন দিন !!!
চিঠির লেখিকার নানান প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই তবে আমরা জানি চিঠির লেখিকার মত আমাদের সমাজের আঁনাচে কাঁনাচে এমন অনেক শিশু আছে।
ঐ সব শিশুদের মনের কথা, মনের হাহাকার আমাদের জন্য বুঝা অনেক দুরূহ বিষয়, সন্তানের ভাষা আমাদের বুঝার সাধ্যের বাইরে, সাধ্যের বাইরে সন্তানের ভাষা যা তার মায়ের কাছে বলে।
কিন্তু এই পৃথিবী পরে কেন এমন রহস্যে ঘেরা এলোমেলো অনুভুতি ! যা আমাদের মন কে নাড়া দেয় !! আমাদের কাছে কী কোন উত্তর বা সমাধান আছে !!
প্রসিদ্ধ ইরানী কবি ওমর খৈয়াম লিখেছিলেন পরের চারটি লাইন ফার্সী ভাষায়।
বর লুহে নিশান বুদনিহা আস্ত্
পেইওয়াসাতে কলম য্ নিক ও বদ্ ফরসুদেহ্ আস্ত্
ধর রোজে আয্ ল্ হর আন্ চে বায়িস্ত্ বেদার
মগ খোরদান ও কশিদানে মা বিহুদেহ আস্ত্
বাংলা অনুবাদেঃ
“অদৃষ্ট যা লেখার তা আগেই লিখে রেখেছেন। ভালো মন্দের লিখনের কলম প্রতি নিয়ত লিখে যাচ্ছে। লিখনের একটি লাইনের অর্ধেক লাইনও বাতিল করা অসাধ্য। এর জন্য দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই চোখের পানি ফেলাও বৃথা।”
কবির দর্শনে ধরা পড়েছে জন্ম- মৃত্যুর মত বিষয়গুলি বা আমাদের ভাগ্য বা অদৃষ্টের উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রন নেই, সব কিছুই মেনে নেওয়ার বিষয় এর মধ্যে সুখ আনান্দকে গ্রহন করতে হবে অযথা বড় অভাবকে বা বড় আঘাতকে মেনে না নেওয়ার মধ্যে থেকে দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই, চোখের পানি ফেলাও বৃথা। আমাদেরকে আরও বেশি করে ভাবনায় ফেলেছেন কবি ওমর খৈয়াম বা আমাদেরকে মনকে চিন্তা চেতনাকে হালকা করার জন্য মানুষকে তিনি সৃষ্টি কর্তার হাতে গড়া হাড়ি-পাতিলের সংগে তুলনা করেছেন।
প্রসিদ্ধ ইরানী কবি আবুল ফতেহ্ গিয়াসউদ্দীন হাকিম ওমর খৈয়াম, অনেকটাই কুম্ভকারের দার্শনিক হিসাবে পরিচিত।
মূল রোবাই – এ ওমর খৈয়াম লিখেছেন –
“দর কারগাহ্ কুজেহ গরি বুদম দোশ
দীদম দোহেজার কুজেহ গোইয়া ও খাদোশ্
হর ইয়েক্ বেযবানে হাল বা মন্ গোফ তান্দ
কো কুজেহ খরও কুজেখরও কুজেহ ফরোশ।”
বাংলায় অনুবাদে –
গত রজনীতে আমি ( খৈয়াম) গিয়েছিলাম এক কুম্ভকারের কর্মশালায়।
দেখলাম দুই সহস্র মাটির পাত্র-কোনটা মুখর, কোনটা বা মূক।
প্রত্যেকেই নীরব ভাষায় আমাকে (খৈয়াম) প্রশ্ন করল।
কোথায় সেই কুম্ভকার, কোথায় সেই ক্রেতা! আর কোথায় বা সেই বিক্রেতা! ”
ওমর খৈয়ামের মতে জন্ম- মৃত্যুর মত আমাদের ভাগ্য বা অদৃষ্টের উপর আমাদের কোন নিয়ন্ত্রন নেই।
মানুষকে তিনি কখনো কখনো মাটির হাড়ি পাতিলের সাথে তুলনা করেছেন। তিনি সৃষ্টিকর্তাকে কুম্ভকার হিসাবে মনে করেছেন। একজন কুম্ভকার যেমন মাটি থেকে বিভিন্ন আকৃতিতে হাড়ি পাতিল তৈরী করেন। আবার তৈরী করা হাড়ি পাতিলগুলি এক সময় ভেংগে টুকরা টুকরা হয়ে আবার মাটিতে মিশে যায়, সে ভাবে আমরা মানুষ মাটি থেকে তৈরী হয়ে রক্তে মাংশে মানুষ হিসাবে পৃথিবীতে বিচরণ করে আবার মাটিতে মিশে যাই।
তৈরীর সময় কিছু কিছু হাড়ি পাতিল যেমন বাঁকা, আকৃতিতে বেআকৃতি হয় ঠিক তেমনি মানুষ জন্মের সময় কেউ কেউ বিকালাংগ, বোবা, বধির হয়ে জন্মায় এখানে মানুষের কোন হাত নেই। বা নেই কোন নিয়ন্ত্রন। খৈয়াম মনে করতেন মানুষের তাই এখানে কোন দুঃখ, কষ্টেরও কোন কারণ নেই, এর উদ্দেশ্যও খোঁজা অর্থহীন। এসবই কুম্ভকারের নিয়ন্ত্রনে ।
তবে যাই হোক দর্শণ দিয়ে আমাদের মত সাধারণ মানুষদের জীবন চলে না, আমরা চলতে চাই খুব স্বাভাবিক চাওয়ার মধ্যে দিয়ে, চিঠির লেখিকার মত আমাদের সমাজের আঁনাচে কাঁনাচে অনেক শিশু আছে, চিঠি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী দীপংকর চন্দ যে ভাবে একটি শিশু মনের ছবি আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, অংকন করেছেন তেমন করে যদি আমরা সকলে সত্যিকার অর্থে চিঠি লেখিকা শিশুটির মনের মধ্যে প্রবেশ করতে পারি তবেই আমরা একটি নূতন মাত্রার সমাজ বা ভুবন তৈরী করে সেখানে সুখ ময়, শান্তি ময় পরিবেশে বসবাস করতে পারি। চিঠি প্রতিযোগিতায় বিজয়ী দীপংকর চন্দের চিঠিটি আমাদের সমাজের একটি অংশের একটি আশার কাব্য যেখানে বেঁচে আছে, বেঁচে থাকবে মা হারা অগনিত শিশু, আমরা যেন সেই সব শিশুদের নিজেদের সন্তান, ভাই বা বোনের মত নিজেদের মনে, প্রাণে ধারণ করে রাখতে পারি। তাদের অভাব বোধকে দূর করতে পারি, তাদের ছোট্ট ছোট্ট আশাগুলিকে পূরণ করতে পারি- এই হোক আমাদের সকলের আশাবাদ।
তারিখ জুন ২৪, ২০১৪
রেটিং করুনঃ ,