লেখক: মিরাজ আহমেদ, সহযোগী অধ্যাপক।
অর্থনীতি বিভাগ, গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিকস
বর্তমান সময়ে পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে ‘একঘরে’ করার জন্য আন্তর্জাতিক লেনদেন–ব্যবস্থা সুইফট (সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টার ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন) থেকে বাদ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এরপর রাশিয়ান অর্থনীতিতে তার প্রভাব নিয়ে নানা মানুষের নানা মত রয়েছে।
তবে সুইফট থেকে রাশিয়াকে বাদ দেওয়ার চিন্তা নতুন নয়। ২০১৪ সালের আগস্টে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় নেতাদের কাছে এমন একটি বিকল্প বিবেচনা করার জন্য আবেদন করেছিল। রাশিয়ার সাবেক অর্থমন্ত্রী আলেক্সি কুদ্রিন তখন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে এ ধরনের পদক্ষেপের ফলে রাশিয়ার জিডিপি ৫ শতাংশ সংকুচিত হতে পারে। যেভাবেই হোক, তখন সেই প্রস্তাব ধামাচাপা পড়ে যায়। এমনকি তখনো সুইফট থেকে রাশিয়াকে বিচ্ছিন্ন করাকে একটি বড় ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ এটিকে ‘যুদ্ধ ঘোষণার’ সমতুল্য বলে মনে করেছিলেন।
এরপর থেকে, এই ‘অর্থনৈতিক পারমাণবিক’ বিকল্পটি বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা কম ছিল, কারণ পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্য আন্তসংযোগ ঢাল হিসেবে কাজ করেছে। রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলে যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানি সবচেয়ে বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হতো। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানির ব্যাংকগুলো রাশিয়ান ব্যাংকগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য সুইফট ব্যবহার করে।
ইরানকে (সুইফট থেকে বাদ দেওয়া) একটি সতর্কতামূলক অবস্থা বিবেচনা করে মস্কো তার অভ্যন্তরীণ আর্থিক ব্যবস্থাকে সুরক্ষিত করার পদক্ষেপ নিয়েছিল। ইরানি ব্যাংকগুলো সুইফট থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পরে, দেশটি তার তেল রপ্তানি আয়ের প্রায় অর্ধেক এবং বৈদেশিক বাণিজ্যের ৩০ শতাংশ হারায়। একইভাবে এটা সহজেই অনুমেয় যে রাশিয়াকে সুইফট থেকে বাদ দেওয়া হলে দেশটির অর্থনীতিতে তার প্রভাব বিধ্বংসী হবে, বিশেষ করে স্বল্প মেয়াদে। আমেরিকাতে বিলিয়ন ডলারের হাইড্রো কার্বন রপ্তানির ক্ষেত্রে রাশিয়া সুইফটের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল।
সুইফটে নিষিদ্ধ হলে রাশিয়ার অনেক আন্তর্জাতিক লেনদেন বন্ধ হবে, বাজারে রাশিয়ার মুদ্রার অস্থিরতা বাড়াবে। এ ধরনের পরিস্থিতির কথা আগাম চিন্তা করে ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া ঝুঁকি এবং সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতি কমানোর জন্য বেশ কয়েকটি পাল্টা ব্যবস্থা চালু করে। যেমন যদি রাশিয়ান ব্যাংকগুলো ভিসা ও মাস্টারকার্ডের লেনদেন–ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়, তাহলে সব দেশীয় লেনদেন জাতীয় পেমেন্ট কার্ডের মাধ্যমে করা যেতে পারে। যদিও আন্তর্জাতিকভাবে এ ব্যবস্থা চালু করা খুবই কঠিন কাজ হবে। ২০১৪ সালের এপ্রিলে বেশ কয়েকটি রাশিয়ান ব্যাংককে যুক্তরাষ্ট্র কালো তালিকাভুক্ত করেছিল। ভিসা ও মাস্টারকার্ড উভয়ই এসব ব্যাংকের পরিষেবা স্থগিত করেছিল। পরের মাসে রাশিয়ান সরকার ন্যাশনাল পেমেন্ট কার্ড সিস্টেম চালু করে একটি নতুন আইন পাস করে, যা পরে মীর (‘ওয়ার্ল্ড’) নামে পরিচিত হয়। এটি রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সম্পূর্ণ মালিকানাধীন।
২০১৪ সাল থেকে মির সিস্টেম থেকে ৭ কোটির বেশি কার্ড ইস্যু করা হয় এবং দেশটির সব ধরনের অভ্যন্তরীণ কার্ড লেনদেন মিরের অংশীদারত্ব বেড়ে যায়। মির কার্ডগুলো এখন পেনশনভোগী, সরকারি কর্মচারী এবং অন্যদের লেনদেনের জন্য আদর্শ।
কিন্তু রাশিয়ার বাইরের লেনদেন এখনো মির কার্ডের মাধ্যমে করা সহজ নয়। মিরের পরিষেবা শুধু আর্মেনিয়া ও রাশিয়া-সমর্থিত দক্ষিণ ওসেটিয়া এবং আবখাজিয়ার জর্জিয়ান অঞ্চলে ব্যবহৃত হয়। স্বল্প পরিসরে তুরস্ক, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান ও কাজাখস্তানে ব্যবহারও হয়তো সম্ভব। আরও বেশি আশাবাদী হলে স্বল্প এবং মধ্য মেয়াদে, সুইফটকে রাশিয়ান সমতুল্য সিস্টেম ফর ট্রান্সফার অব ফিন্যান্সিয়াল মেসেজ (এসপিএফএস) দিয়ে প্রতিস্থাপিত করার চিন্তা করা যেতে পারে। ২০১৪ সালে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিল। যার লক্ষ্য ব্রাসেলস ভিত্তিক আন্তব্যাংক লেনদেন স্থানান্তরের কার্ডগুলোকে প্রতিস্থাপন করা। ২০২০ সালে এসপিইএসের মাধ্যমে প্রায় দেড় কোটি তথ্য বার্তা আদান-প্রদান হয়েছে, কিন্তু সুইফটের তুলনায় এ ব্যবস্থাটি বড্ড ফ্যাকাশে। ৪০০টির বেশি আর্থিক প্রতিষ্ঠান রাশিয়ান এই বিকল্প লেনদেন–ব্যবস্থায় যোগ দিয়েছে, যার বেশির ভাগই রাশিয়ান ব্যাংক। তবে রাশিয়ায় পরিচালিত মূল বিদেশি ব্যাংকগুলো যেমন ইউনিক্রেডিট, রাইফেইসেন ব্যাংক এবং এমনকি রাশিয়ান দেশীয় টিঙ্কফ ও ভোস্টোচনি ব্যাংক এখনো এই সিস্টেমে যোগ দেয়নি।
বর্তমানে, রাশিয়ার অভ্যন্তরীণ লেনদেনের ২০ শতাংশ এসপিইএসের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়। ২০২৩ সালের মধ্যে যা ৩০ শতাংশে উন্নীত করতে চায় রুশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে আকর্ষণীয় বিকল্প করে তুলতে হলে ব্যবস্থাটির প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতাগুলোর সমাধান করতে হবে। যেমন এটার কার্যক্রম সাপ্তাহিক কাজের ঘণ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ (৯-৫), যেখানে সুইফট ৭ দিনের ২৪ ঘণ্টায় কাজ করে।
এসপিইএস সর্বোচ্চ মাত্র ২০ কিলোবাইট বার্তা আদান প্রদান করতে পারে। এসপিইএসের সীমাবদ্ধতার কারণে চায়নিজ ক্রস বর্ডার ইন্টার ব্যাংক পেমেন্ট সিস্টেমকে (সিআইপিএস) রাশিয়ান ব্যাংকগুলোর জন্য আরও বাস্তবসম্মত বিকল্প হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে।
সুইফটের বিকল্প হিসেবে কাজ করার আগে সিআইপিএসকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে। কারণ, ব্যবস্থাটি এখনো সুইফটের আকারের তুলনায় মাত্র দশমিক ৩ শতাংশ। তা সত্ত্বেও সুইফটের বিকল্প হয়ে উঠতে পারে এ ব্যবস্থাটি অন্তত, ইউরেশিয়াতে। এখানে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো চায়নিজ সিআইপিএস ও রাশিয়ান এসপিইএস কি যৌথভাবে সহযোগিতা করবে, নাকি লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী চীনা ব্যবস্থাটি রাশিয়ান অ্যানালগকে সম্পূর্ণরূপে অপ্রয়োজনীয় করে তুলবে। এখন পর্যন্ত ২৩টি রাশিয়ান ব্যাংক চায়নিজ সিআইপিএসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। অন্যদিকে শুধু একটি চায়নিজ ব্যাংক বর্তমানে রাশিয়ার এসপিইএসের সঙ্গে যুক্ত।
অনেক রাশিয়ান অর্থনীতিবিদ আবার বিকল্প আন্তসীমান্ত লেনদেন নিশ্চিত করতে ডিজিটাল রুবল প্রবর্তনের গতি বাড়াতে পুতিন সরকারকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। যদিও ডিজিটাল রুবলের প্রবর্তন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২০ সালের অক্টোবরে অনুমোদন করেছিল। বিকেন্দ্রীকৃত ক্রিপ্টোকারেন্সির বিপরীতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডিজিটাল মুদ্রাগুলো রাশিয়ান কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ডিজিটাল রুবলের প্রথম প্রোটোটাইপটি যদিও ২০২১ সালের শেষের দিকে প্রথমবারের মতো পরীক্ষা করা হয়।
যেখানে ১২টি ব্যাংক লেনদেনের আবেদন করে এবং ২টি ব্যাংক নির্বিঘ্নে তাদের গ্রাহকদের লেনদেন সম্পন্ন করে। সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকার ডিজিটাল মুদ্রার জন্য অনুরূপ পরিকল্পনা করছে। তবে রাশিয়ার আরও বেশি অনুপ্রেরণা রয়েছে। কারণ, এটির লক্ষ্য মার্কিন ডলারের ওপর নির্ভরতা হ্রাস করা, বিশ্বব্যাপী রুবলের লেনদেন বৃদ্ধি করা এবং পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি হ্রাস করা।
ডিজিটাল রুবল হয়তো অ্যানালগ সংস্করণের মতোই হবে এবং দেশের বাইরে অর্থ প্রদানের মাধ্যম হিসেবে সহজে গ্রহণ করা হবে না।
মার্কিন প্রতিযোগী দেশ, রাশিয়া, ইরান ও তুরস্কের মতো প্রতিপক্ষের মধ্যে ডিজিটাল লেনদেন হয়তো সম্ভব, কিন্তু সেটা আঞ্চলিক পর্যায়ে থাকবে। ডিজিটাল মুদ্রার ব্যবহারে মার্কিন নিষেধাজ্ঞাকে সম্পূর্ণভাবে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার ক্ষমতাও সীমিত।
মার্কিনকেন্দ্রিক অর্থ লেনদেন–ব্যবস্থার ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য রাশিয়ার প্রচেষ্টা বৈশ্বিক আর্থিক বাজারে মার্কিন আধিপত্যকে পেছনে ঠেলে ইউরোপের সাম্প্রতিক প্রচেষ্টা লাভবান হতে পারে। ইরানের ওপর ওয়াশিংটন আবার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করায় অসন্তুষ্ট ইইউ। সুইফটের বিকল্প হিসেবে ইন্সট্রুমেন্ট ফর সাপোর্টিং ট্রেড এক্সচেঞ্জ চালু করেছে। যদিও এই উদ্যোগগুলো কার্যকর বিকল্প হয়ে ওঠার আগে অনেক কাজ করা দরকার। নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে, যুক্তরাষ্ট্র সহজেই ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে তার আর্থিক শক্তিকে অস্ত্রোপচার করতে পারে, এমন একটি ধারণা ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রচলিত আছে। যেটা আমেরিকার পেমেন্ট গেটওয়ের একটি সমান্তরাল ব্যবস্থা তৈরি করতে ইইউকে সাহসী করেছে। মস্কো ও বেইজিংয় এ চেষ্টাকে স্বাগতই জানাচ্ছে।
লেখক
সহযোগী অধ্যাপক
অর্থনীতি বিভাগ
গুয়াংডং ইউনিভার্সিটি অব ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইকোনমিকস।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ ফেব্রুয়ারী ২৮, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,