বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেছেন, অর্থনীতিতে গভীর সংকট চলছে। কাঠামোগত সমস্যা, সুশাসনের অভাব, সময় মতো সংস্কারের পথে না যাওয়াই এর মূল কারণ। রেহমান সোবহান বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে ধার দেওয়া হচ্ছে সমাজের ধনিক শ্রেণির কাছে, যাঁরা তা পরিশোধ করছেন না; আর আর্থিক খাতের কিছু সমস্যা ক্যানসারের মতো, এগুলো চিহ্নিত করে তা সারানোর উদ্যোগ নিতে হবে।
সিপিডির আয়োজনে গতকাল শনিবার ঢাকার মহাখালীর ব্র্যাক-ইন সেন্টারে ‘সংকটে অর্থনীতি: কর্মপরিকল্পনা কী হতে পারে?’ শীর্ষক সংলাপে রেহমান সোবহান এসব কথা বলেন। রেহমান সোবহানের সঞ্চালনায় সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। সংলাপে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান, বিশেষ অতিথি ছিলেন আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী।
সংলাপে আলোচক ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর, বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ও বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) রূপালী চৌধুরী।
সিপিডি বলেছে, প্রভাবশালী কিছু ব্যবসায়ীর প্রভাব ও সরকারের দুর্বল তদারকব্যবস্থার কারণে মূল্যস্ফীতির কঠিন চাপে দেশের সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে হয়েছে জ্বালানি তেলের দামের নাটকীয় উত্থান। উন্নয়নশীল তো বটেই, কিছু উন্নত দেশ থেকেও বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের দাম বেশি। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।
এমন বাস্তবতায় যথাযথ সামস্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনা ও অর্থনৈতিক সুশাসনের পথে হাঁটার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। এ জন্য ভাসমান মুদ্রা বিনিময় হার, সুদের হারের সীমা তুলে দেওয়া, বাজেটকে নতুন করে দেখা এবং মুদ্রানীতি ও রাজস্বনীতির মধ্যে সমন্বয়ের নিশ্চয়তা তৈরি—এই চার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছে সংস্থাটি।
সংলাপে বলা হয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) আয় তেমন বাড়ছে না। তার ওপর ভর্তুকি বাজেটে ঘোষিত ৮২ হাজার কোটি টাকার বেশি হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিদেশে লোক যাচ্ছে বেশি; কিন্তু প্রবাসী আয় আসছে কম। ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বাড়ছে। ন্যূনতম মজুরি যা দেওয়া হচ্ছে, তাতে শ্রমিকদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
অথচ দেশের অর্থনীতির এই কঠিন সময়ে সামষ্টিক অর্থনীতির যথাযথ ব্যবস্থাপনা অনুপস্থিত বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে সিপিডি। সংস্থাটি বলেছে, ‘অর্থনীতিতে রয়েছে সুশাসনের অভাব। আবার রয়েছে যথাযথ নেতৃত্বের ঘাটতি। অর্থমন্ত্রী একজন আছেন, কিন্তু কে যে আছেন…বেশির ভাগ সময়ই তাঁকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে দেখতে পাওয়া যায় না, যা দুঃখজনক।’
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান শুরুতেই বলে নেন, তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আসেননি। তিনি বলেন, ‘সিপিডির মতো সংস্থাগুলো যেভাবে চায়, তার সঙ্গে বাস্তবতার “ভয়ংকর ফারাক”। তৃণমূল পর্যায়ে গিয়ে দেখছি ও শিখছি। প্রতি সপ্তাহে আমি নির্বাচনী এলাকায় (হাওরাঞ্চল) যাই। গ্রামের মানুষ চান রাস্তাঘাট, স্কুল ভবন ও খাবার পানি। এসব তাঁরা পাচ্ছেন।’
এম এ মান্নান বলেন, ‘দেশের অর্থনীতি অর্থমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর চালাচ্ছেন না। চালাচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমি আজ অসুস্থ, অফিসে গেলাম না, তার জন্য সরকার পড়ে থাকবে না। আমরা অর্থনীতি চালাচ্ছি জেনেশুনে এবং নিত্য হালনাগাদ করার প্রচেষ্টার মধ্যেও আছি।’
আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়–সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘অর্থনৈতিক যুদ্ধাবস্থার মধ্যে আছি। অথচ অর্থমন্ত্রীকে দেখতে পাচ্ছি না। তিনি না থাকা মানে তাঁর মন্ত্রণালয়ের না থাকা। এভাবে চললে বড় বিপদে পড়ে যেতে পারি।’
মূল্যস্ফীতিতে গরিবের কষ্ট
উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে চিংড়িশিল্প, হোটেল-রেস্তোরাঁ, সাবান ও প্রসাধনশিল্প, চা-বাগান, কাপড় সেলাইয়ের দোকান, অটোমোবাইল কারখানা, পোশাক কারখানা, চামড়া ও চামড়াজাত শিল্পকারখানাসহ সব ধরনের কারখানার শ্রমিকেরা কম খাবার খাচ্ছেন। এসব শিল্প খাতের ন্যূনতম মজুরি বাড়ানো দরকার। এ ছাড়া করপোরেশনগুলোর চাকরিজীবীদের জন্যও আরেকটু বেতন-মজুরি বৃদ্ধি দরকার।
সিপিডি বলে, ইতিবাচক দিক হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্য, সার ও তেলের দাম কমতির দিকে। তারপরও সরকারের উচিত এ সময়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে সরাসরি নগদ টাকা পৌঁছানো। এ ছাড়া নিম্ন আয়ের মানুষদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবলয় শক্তিশালী করতে হবে। এ সময়ে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে দরকার ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রণোদনা দেওয়া।
পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, সমস্যা নীতি প্রণয়নের। ভারতের মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৮৮ শতাংশ। তারপরও তারা সুদের হার বাড়িয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, অভ্যন্তরীণ চাহিদা যেহেতু বাড়ছিল, তাহলে এর ব্যবস্থাপনাটাও দেখার দায়িত্বের কথাও এসে যায়। মূল্যস্ফীতি যখন বাড়তে থাকল, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তখন কী করল?
জাহিদ হোসেন বলেন, ‘যে মুদ্রানীতির কথা আমরা শুনেছিলাম, তাতে সংকোচনের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু তথ্যউপাত্তে তা আর দেখা যায়নি।’
টাকার মূল্যমান কৃত্রিমভাবে ধরে রাখা
আমদানিতে স্বচ্ছতা আনা দরকার বলে মনে করছে সিপিডি। তারা এ–ও বলছে, আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট নয়।
জুলাই-নভেম্বরে যত লোক বিদেশে গেছেন, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি তেমন নেই। হুন্ডি এতে প্রভাব ফেলছে। অথচ প্রবাসী আয় আনতে ২ দশমিক ৫ শতাংশ নগদ সহায়তা ও ব্যাংক মাশুল মওকুফ করা হয়েছে। আর নিট রিজার্ভকে বিবেচনায় নিলে চার মাসের আমদানি ব্যয় পরিশোধের অবস্থা আছে।
প্রতিবেশী ভারত ও প্রতিযোগী ভিয়েতনাম তাদের মুদ্রার অবমূল্যায়ন করলেও ডলারের তুলনায় টাকাকে কৃত্রিমভাবে শক্তিশালী করে রাখা হয়েছিল এবং বাংলাদেশ ব্যাংক এ ব্যাপারে যথাসময়ে যথাপদক্ষেপ নিতে পারেনি বলে সিপিডির প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘অন্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এখানে ভুল নীতি প্রণীত হচ্ছে। হোটেলে বসে মুদ্রানীতির প্রধান চলকগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। অদ্ভুত! কোনো দিন এ রকম ঘটনা আগে শুনিনি।’
সূত্র:প্রথম আলো।
তারিখ:ডিসেম্বর ১৮, ২০২২
রেটিং করুনঃ ,