১০ হাজার ঘণ্টায় সাফল্যের মন্ত্র
পাঁচ বছর বয়সে বাবা মারা যান হেরাল্ড স্যান্ডার্সের। সংসার চলে না। মাকে অনেক জায়গায় কাজ করতে হয় সংসার চালাতে। ১০ বছর বয়সেই কাজে নামলেন হেরাল্ড। লেখাপড়া বেশি দূর এগোয়নি। ১৮ থেকে ২২ বছর পর্যন্ত অনেক কিছু করার চেষ্টা করেন হেরাল্ড। গাড়ি চালানো, বিমার পলিসি বিক্রি থেকে শুরু করে সেনাবাহিনী। কোনো কিছুতেই সুবিধা করতে পারেননি। ৪০ বছর বয়সে আমেরিকার কেনটাকি রাজ্যে পেট্রল স্টেশনের ব্যবসা শুরু করেন। সঙ্গে রোজগার বাড়াতে দোকানের বাইরে একটা টেবিলে খাবার বিক্রি। ভাজা মুরগির মাংস। বেশ জনপ্রিয় হয়। আস্তে আস্তে খাবারের স্বাদ, মান আর দ্রুত উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখেন হেরাল্ড। নিজের রান্নার পদ্ধতি আর মসলা অন্য রেস্তোরাঁয় বিক্রির চেষ্টা শুরু করেন। অধিকাংশ রেস্তোরাঁ রাজি হচ্ছিল না প্রথম দিকে তাঁর রান্নার পদ্ধতি বা মসলা কিনতে। বয়স ইতিমধ্যেই ৬০ পেরিয়ে গেছে। নিউ ইয়র্কার সাময়িকীর এক নিবন্ধে বলা হয়েছিল, হেরাল্ড আমেরিকার রাস্তায় বছরে প্রায় দুই লাখ মাইল পথ ঘুরতেন—দোকান থেকে দোকানে। বছরের পর বছর চেষ্টা করে একপর্যায়ে ২০০ রেস্তোরাঁর সঙ্গে চুক্তি করেন। ১৯৬৪ সালে দুই মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করা এই কোম্পানিই আজকের কেএফসি বা কেনটাকি ফ্রায়েড চিকেন।
কোনো কিছু শুরু করতে বা সাফল্য অর্জন করতে বয়স কোনো সমস্যা নয়। ইচ্ছা, একাগ্রতা আর অনুশীলনই আসল কথা।
কম বয়সে শুরু করলেও তেমন কোনো সুবিধা পাওয়া যায় না অনুশীলন ছাড়া। সাম্প্রতিক গবেষণা তেমনটিই বলছে। সংগীতের বিস্ময়বালক মোৎসার্ট। পাঁচ বছর বয়সে একাধিক সংগীতযন্ত্র বাজাতে পারতেন। বিঠোফেন, ভিনসেঞ্জো, বেলিনি—ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সংগীতজ্ঞদের মধ্যে অন্যতম। খুব কম বয়সে শুরু করেন সংগীতসাধনা। গবেষকদের একটা বড় অংশ মনে করতেন, তাঁরা এমন একটা বয়সে সংগীতচর্চা শুরু করেছিলেন, যখন নতুন কিছু শেখা অনেক সহজ। তাঁদের অনেকেরই নিকট পরিবার, অর্থাৎ বাবা বা মা সংগীতের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নেদারল্যান্ডসের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা সম্প্রতি কম ও অপেক্ষাকৃত বেশি বয়সে শুরু করা সংগীতজ্ঞদের ওপর গবেষণা করে দেখতে পেয়েছেন, বয়স নয়, অনুশীলনই সাফল্যের মূলে। কতটা সময় ধরে আপনি নিয়মিত সংগীতচর্চা করছেন, তার ওপর সাফল্য নির্ভরশীল।
অত্যন্ত প্রতিভাবান ব্যক্তিদেরও কি একইভাবে অনুশীলন করতে হয়? উত্তরটা হলো হ্যাঁ। যেমন ধরুন, মাধ্যাকর্ষণের ধারণার জনক বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটনের কথা। প্রচলিত গল্পটা এমন যে একটি আপেলগাছের নিচে দাঁড়ানো নিউটন আপেল পড়তে দেখে সঙ্গে সঙ্গেই মাধ্যাকর্ষণের সূত্রটি আবিষ্কার করেন। আসলে ব্যাপারটি একটু অন্য রকম। ১৬৬৬ সালে নিয়মিত হাঁটার সময় নিউটন একটি আপেল পড়তে দেখে ভাবলেন, আপেলগাছ থেকে সোজাসুজি, অর্থাৎ সরলরেখা বরাবর মাটিতে পড়ছে কেন? ডানে বা বাঁয়ে কেন পড়ে না? ওপরে কেন ওঠে না? এ ঘটনা মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে তাঁর ভাবনাকে উসকে দেয়। এরপর মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে বছরের পর বছর বিস্তর গবেষণা করেন নিউটন। ২১ বছর পরে ১৬৮৭ সালে তাঁর সাড়া জাগানো দ্য প্রিন্সিপিয়া: ম্যাথমেটিক্যাল প্রিন্সিপলাস ন্যাচারাল ফিলোসফি বইতে মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে তাঁর ভাবনার বিস্তারিত প্রকাশ করেন।
যেকোনো বিষয়ে চূড়ান্ত দক্ষতা অর্জন করতে কতটা অনুশীলন করতে হয়? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে অনেক গবেষণা হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সফল ব্যক্তিদের নিয়ে। উত্তরটা হলো অন্তত ১০ হাজার ঘণ্টা। একাধিক গবেষণা বলছে, যদি কেউ ১০ হাজার ঘণ্টা নিয়মিত যেকোনো বিষয়ে অনুশীলন করেন, নিজের ভুলগুলো শুধরে নেন, তাহলে সাফল্যের সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যায়। এ ধারণা বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন ম্যালকম গ্ল্যাডওয়েল তাঁর অত্যন্ত জনপ্রিয় বই আউটলায়ার্সে।
১০ হাজার ঘণ্টা অনুশীলন, অর্থাৎ দিনে তিন ঘণ্টা করে ৩ হাজার ৩৩৩ দিন বা ১০ বছরের কিছু বেশি সময় অনুশীলন করলে যেকোনো বিষয়ে বিশেষ বিশেষজ্ঞ হওয়ার বা দক্ষতা অর্জন করার সম্ভাবনা উজ্জ্বল।
শচীন টেন্ডুলকারের কথাই ধরুন। ক্রিকেটের বরপুত্র। দুই দশক ধরে বিশ্ব ক্রিকেটের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন। কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে মুম্বাইয়ের ভিড়ে ঠাসা গণপরিবহনে বছরের পর বছর কিশোর বয়স থেকে খেলতে আসতেন শিবাজী পার্ক স্টেডিয়ামে। কোচ রমাকান্ত আচরেকার একটি মাঠ থেকে আর একটি মাঠে নিয়ে যেতেন বালক শচীনকে। শচীন নিজেই বলেছেন, বছরের পর বছর দিনে ১২ ঘণ্টা করে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
ষাটের দশকে আমেরিকার হাতে গোনা কয়েকটি স্কুলে কম্পিউটার ছিল। এ রকমই একটা স্কুল সিয়াটলের লেকসাইড। সেখানে ছাত্ররা স্কুলের পরও কম্পিউটারে প্রোগ্রাম লেখা শিখতে পারত। চাহিদার তুলনায় কম্পিউটারের সংখ্যা হাতে গোনা। জনপ্রতি বরাদ্দ মাত্র কয়েক ঘণ্টা। অষ্টম শ্রেণির এক ছাত্রের জন্য এ সময় নিতান্তই অপ্রতুল। চোখের নিমেষেই শেষ। মা পাশের বিশ্ববিদ্যালয় ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনে একটি কম্পিউটার ল্যাব ভাড়া করলেন। পরে দেখা গেল অষ্টম শ্রেণির ওই ছাত্র সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ৮ ঘণ্টা কম্পিউটারে প্রোগ্রাম লিখতেন। ওই ছাত্র আর কেউই নন, বিল গেটস। মাইক্রোসফটের প্রতিষ্ঠাতা। যাঁর কল্যাণে আমি, আপনি অনায়াসে আজ কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারছি।
বিখ্যাত মানুষ ছাড়াও নিজের কাজের ক্ষেত্রে সফল হাজারো মানুষ রয়েছেন আমাদের চোখের সামনে। আমাদের প্রাইমারি স্কুলে বাদাম বিক্রি করতেন খালেক ভাই। শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা—সব সময়ই খালেক ভাই সকালে আসতেন। কয়েক ঘণ্টা পর পাশের হাইস্কুলে গিয়ে বসতেন। মুখে সব সময় হাসি। স্কুল ছুটির পর শহরের স্টেডিয়ামে কোনো খেলা থাকলে সেখানেও হাজির খালেক ভাই। বাদাম বিক্রির ব্যবসা বাড়িয়ে একসময় খালেক ভাই মুদিদোকান করলেন। ব্যবসা বাড়ল। শহরের ভালো জায়গায় বাড়ি হলো। এখানেও ১০ হাজার ঘণ্টা। আমি অন্তত ১০ বছর খালেক ভাইকে স্কুলের সামনে বাদাম বিক্রি করতে দেখেছি।
মূলমন্ত্র—লেগে থাকা। বছরের পর বছর। নিরবচ্ছিন্নভাবে। নতুন প্রজন্মকে এ লেগে থাকা আর অনুশীলনের শিক্ষা দেওয়া খুবই জরুরি।
লেখক: ড. সুব্রত বোস প্রবাসী বাংলাদেশি এবং বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানির রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট
সূত্র: প্রথম আলো
তারিখ: জুন ১৫, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,