ঘুড়ির নাম কোভিড ১৯, তাতে করোনাভাইরাসের নকশা আঁকা। আরেকটি ঘুড়িতে আঁকা মাস্কের ছবি, সেটিতে লেখা—নো মাস্ক, নো কাইট। আজ বৃহস্পতিবার সাকরাইন উৎসবে পুরান ঢাকার আকাশে উড়েছিল এমন করোনাময় নানা ঘুড়ি। যেন ঘুড়ির মতোই করোনাকে উড়িয়ে দেওয়ার আয়োজন।
উৎসবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসও বললেন তেমনটাই, ‘করোনা পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন ধরে আমরা বড় কোনো উৎসব করতে পারছিলাম না। সাকরাইনে ঘুড়ি উৎসবের মাধ্যমে আমরা করোনাকেও উড়িয়ে দিতে চাই।’ বেলা তিনটায় সূত্রাপুরের পাতলা খান লেনের একটি বাড়ির ছাদে হয় এ অনুষ্ঠান।
পৌষের শেষ দিন বাংলাদেশসহ পুরো উপমহাদেশেই পৌষসংক্রান্তি উৎসবের আয়োজন করা হয়। রাজধানীর পুরান ঢাকায় এ উৎসবকে বলা হয় সাকরাইন। এ উপলক্ষে দিনমান ছাদে ছাদে চলে ঘুড়ি ওড়ানো। গানবাজনার অনুষ্ঠান। সন্ধ্যার পর সেই উৎসবই পরিণত হয় আলোর খেলায়। অন্যান্যবারের মতো আজও এ উৎসব উদ্যাপন করা হয়।
বেলা তিনটার দিকে যাত্রাবাড়ীর দয়াগঞ্জ পার হয়ে গেন্ডারিয়ায় ঢুকতেই দেখা গেল, আকাশজুড়ে ঘুড়ির মেলা। লাল, নীল, বেগুনি নানা বাহারি তার রং। একে একে বানিয়ানগর, সূত্রাপুর, লক্ষ্মীবাজারসহ পুরো এলাকার বেশির ভাগ ছাদেই ছেলে-বুড়ো, তরুণ-তরুণীর ভিড়। ছাদে গানবাজনার তালে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলেন তাঁরা।
কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, ঘুড়িগুলোর নামও বেশ চমৎকার। রয়েছে চোখদার, পানদার, বলদার, দাবাদার, লেজওয়ালা, পতঙ্গ ইত্যাদি নামের ঘুড়ি। উৎসব শুরুর দু-এক দিন আগেই এসব ঘুড়ি কিনে রেখেছিলেন শিশু-কিশোর, তরুণ-তরুণীরা।
পাতলা খান লেনে একটি বাড়ির ছাদে এমনই একটি চোখদার ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলেন কানিজ ফাতেমা নামের এক তরুণী। তিনি জানান, এটা তাঁর চাচার বাসা। উৎসব উপলক্ষে সব চাচাতো ভাইবোন এখানে জড়ো হয়েছেন। ছোটবেলা থেকেই সাকরাইনে ঘুড়ি ওড়াতেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না।
লক্ষ্মীবাজারের ঠাকুর দাস লেনের একটি বাসার নবম তলার ছাদে গিয়ে দেখা গেল, বড় বড় সাউন্ড বক্সসহ গানবাজনার নানা আয়োজন। এ আয়োজনের উদ্যোক্তা চার তরুণ। তাঁদের একজন আরমান হোসেন। তিনি বলেন, বাসার সবার কাছে চাঁদা নিয়ে এ আয়োজন করা হয়েছে। দিনভর ঘুড়ি ওড়ানোর পর রাতেও রয়েছে আয়োজন। সন্ধ্যার পর ফানুস ওড়ানো হবে। চলবে আতশবাজিও।
সন্ধ্যার পর পর্যন্ত থেকে দেখা গেল, দিনে যে উৎসব ছিল ঘুড়ি ওড়ানোর, রাতে তা-ই পরিণত হয়েছে আলোর খেলায়। বেশির ভাগ বাড়ির ছাদই আলোকসজ্জা করা। কোনো বাড়ির ছাদ থেকে ফোটানো হয় আতশবাজি, কোনো বাড়ির ছাদ থেকে ওড়ানো হয় ফানুস। কোথাও কোথাও মুখে কেরোসিন নিয়ে মশালে ফুঁ দিয়ে তৈরি করা হয় আগুনের হলকা।
পুরান ঢাকার স্থানীয় কয়েকজন জানালেন, পৌষসংক্রান্তির এ উৎসব কয়েক শ বছরের পুরোনো। আগে এ উৎসব মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন উদ্যাপন করত। তবে কালক্রমে তা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবার উৎসবে পরিণত হয়েছে।
হিন্দু সম্প্রদায়ের কয়েকজন বললেন, কয়েক পুরুষ ধরেই তাঁরা এ উৎসব দেখছেন, নিজেরাও অংশ নিচ্ছেন। তবে তাঁরাও ছোটবেলায় এ উৎসব যেমন দেখেছেন, এখন তাতে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আগে এ উৎসব উপলক্ষে বাড়ির জামাইদের দাওয়াত করা হতো। তাঁরা কেউ গুড়ের কলস, কেউ দুধের কলস, কেউ মাছ-মাংস, কচ্ছপ এসব আনতেন। তাঁরা সকালবেলা উঠেই হলুদ দিয়ে গোসল করতেন। এরপর ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াতেন। শ্বশুরবাড়ি থেকে জামাইদেরও ঘুড়ি দেওয়া হতো। জামাইয়েরা ঘুড়ি কাটাকাটি খেলতেন। তাতে উৎসাহ দিতেন বউয়েরা। সন্ধ্যায় ছাদ থেকে নেমে যেতেন তাঁরা। রাতে চলত জামাইদের আনা খাবার-দাবারের আয়োজন।
সূত্রাপুর এলাকার পলাশ সরকার বললেন, আগে পৌষসংক্রান্তিতে রাতের ফানুস বা আতশবাজির আয়োজন থাকত না। তবে দিনভর ঘুড়ি ওড়ানো ছিলই। তখন সাউন্ডবক্স ছিল না, তবে মাইক ছিল। সেই মাইকে চলত গানবাজনা।
কয়েক বছর ধরে দুই দিনব্যাপী সাকরাইন উৎসবের আয়োজন করা হচ্ছে। এবারও স্থানীয়দের আয়োজন দুদিনের। তবে স্থানীয়দের পাশাপাশি এবার প্রথমবারের মতো ডিএসসিসির পক্ষ থেকে একযোগে ৭৫টি ওয়ার্ডে এ আয়োজন করা হয়।
ডিএসসিসির মেয়র তাপস বলেন, ‘করোনার কারণে পুরো বিশ্ব থমকে রয়েছে। আজ ঐতিহ্যবাহী সাকরাইন উৎসবের মাধ্যমে ঢাকার পুরো আকাশ আমরা রঙিন করে দিয়েছি। এ আয়োজনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীকে জানাতে চাই, করোনার মধ্যেও আমরা আনন্দ করতে জানি, উৎসব করতে জানি, আমাদের ঐতিহ্য সংরক্ষণ করতে জানি।’
সূত্র: প্রথম আলো
ছবি নেট থেকে সংগৃহিত
তারিখ: জানুয়ারী ১৪, ২০১১ (৩০ পৌষ)
রেটিং করুনঃ ,