কোটা আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সহিংস দমনপীড়ন বন্ধে বাংলাদেশের ওপর তীব্র হচ্ছে আন্তর্জাতিক চাপ। গত সপ্তাহে প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে সরাসরি গুলি করে পুলিশ, সেনাবাহিনী ও আধাসামরিক বাহিনী। এসব ঘটনার ভিডিও ক্লিপ ও ফটো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর এই চাপ তীব্র হচ্ছে। অনলাইন ভয়েস অব আমেরিকায় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ফেসেস গ্রোয়িং ক্রিটিসিজম ফর ভায়োলেন্ট ক্র্যাকডাউন অন স্টুডেন্টস’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়। এতে সাংবাদিক শেখ আজিজুর রহমান লিখেছেন, শিক্ষার্থীদের প্রতি নমনীয় হওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সহ অনেকে। ১লা জুলাই সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল করে হাইকোর্ট। এরপর শুরু হয় শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ। তাদের এই বিক্ষোভে যোগ দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও।
বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা সাধারণ জনগণের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পাচ্ছেন। বাংলাদেশে বেকারত্বের হার অনেক বেশি। যে দেশ এই উচ্চ বেকারত্ব মোকাবিলা করছে সেখানে সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে শতকরা ৩০ ভাগ কোটা সংরক্ষিত রাখা হয় মুক্তিযোদ্ধাদের নাতিপুতিদের জন্য।
বিজ্ঞাপন
তারা এই কোটা সংশোধন করে চাকরিক্ষেত্রে মেধাভিত্তিক ব্যবস্থার দাবি জানাতে থাকেন। তাদের এই আন্দোলন শান্তিপূর্ণ ছিল। কিন্তু নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ বুলেট, ছররা গুলি এবং কাঁদানে গ্যাস ছোড়ার পর তা সহিংস হয়ে ওঠে। পুলিশ এবং হাসপাতালের তথ্যমতে, ১৬ থেকে ২২শে জুলাইয়ের মধ্যে সহিংসতায় নিহত হয়েছেন কমপক্ষে ২০০ মানুষ। বহু মৃত্যুর তথ্য নিবন্ধিত হয়নি। কারণ, এসব নিহতের দেহ হাসপাতাল বা পুলিশ স্টেশনে যায়নি। বেসরকারি তথ্যে বলা হচ্ছে নিহতের সংখ্যা ৩০০ থেকে ৫০০’র মধ্যে।
এই অস্থিরতার জন্য গত সপ্তাহে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপি’কে দায়ী করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা দেয়ার জন্য তিনি পুলিশ, আধা-সামরিক বাহিনী এবং সেনাবাহিনীকে মোতায়েনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি বিক্ষোভকারীদের জঙ্গি (মিলিট্যান্ট) বলে অভিহিত করেন। ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতায় আছেন প্রধানমন্ত্রী। কর্তৃত্ববাদী এবং দুর্নীতির জন্য তাকে অভিযুক্ত করা হয়। গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ আছে তার দলের বিরুদ্ধে। তবে এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে তার দল।
২১শে জুলাই বেশির ভাগ কোটা বাতিল করে দেন সুপ্রিম কোর্ট। কোর্ট রায়ে বলেন, সরকারি চাকরিতে শতকরা ৯৩ ভাগ নিয়োগ দিতে হবে মেধার ভিত্তিতে। এর মধ্যদিয়ে বিক্ষোভকারীদের গুরুত্বপূর্ণ একটি দাবি পূরণ হয়েছে। তবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা বলছেন, তাদের সর্বশেষ দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত প্রতিবাদ অব্যাহত থাকবে। সোমবার তারা এক বিবৃতিতে বলেছেন- স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রীসহ চারজন মন্ত্রীকে মন্ত্রিসভা থেকে সরিয়ে দিতে হবে। তারা আরও দাবি করেছেন রাজপথে শিক্ষার্থীদের দিকে যেসব পুলিশ এবং ক্ষমতাসীন দলের ‘গুণ্ডারা’ গুলি করেছে, তাদেরকে গ্রেপ্তার করতে হবে এবং নিরস্ত্র প্রতিবাদীদের হত্যা করার জন্য তাদের বিচার করতে হবে।
এর জবাবে ছাত্রনেতা এবং বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার শুরু করে সরকার। ঢাকাভিত্তিক একটি মানবাধিকার গ্রুপ বলেছে- কয়েকদিনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কমপক্ষে ১০ হাজার মানুষকে। এর বেশির ভাগই শিক্ষার্থী। ছাত্রদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন এমন কমপক্ষে ৫০ জন সমন্বয়কের মধ্যে কমপক্ষে ১০ জনকে এরই মধ্যে আটক করেছে পুলিশ। এর মধ্যে একজন সমন্বয়ককে পুলিশ হেফাজত থেকে অল্প সময়ের জন্য ছেড়ে দেয়ার পর আবার আটক করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, নিরাপত্তা হেফাজতে তাদের ওপর নির্যাতন করা হয়েছে। তাদেরকে চাপ দেয়া হয়েছে আন্দোলন বন্ধ করতে। মঙ্গলবার বেশ কিছু ছাত্রনেতা এবং অধিকারকর্মী বলেছেন, সারা দেশে সেনা ও আধা-সামরিক বাহিনীর সহায়তায় তল্লাশি অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। তারা আটক করছে শিক্ষার্থীদের। তারা আরও বলছেন, ছাত্রদের মনোবল নষ্ট করতে এবং তাদের আন্দোলনের বিরুদ্ধে স্যাবোটাজ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে সরকার। বাংলাদেশভিত্তিক একজন অধিকারকর্মী বলেন, প্রতি রাতেই তারা বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করছে। সেখান থেকে শিক্ষার্থী এবং তরুণ যুবকদের তুলে নিচ্ছে আন্দোলনে যোগ দেয়ার অভিযোগে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিশোধ নেয়ার ভয়ে এই অধিকারকর্মী নিজের নাম প্রকাশ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। তিনি আরও বলেছেন, যাদের এভাবে তুলে নেয়া হয়েছে তাদের অনেককেই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর অর্থ হলো তারা জোরপূর্বক গুমের শিকার হয়ে থাকতে পারেন। রিমান্ডের নামে আটক কর্মীদের ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, এসব শিক্ষার্থী এবং তরুণ অধিকারকর্মীদের জামিন বাতিল করে এবং তাদেরকে রিমান্ডে পাঠানোর মাধ্যমে নির্যাতনে সহযোগিতা করছে বিচার বিভাগ।
হাজার হাজার শিক্ষার্থী এবং বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গণগ্রেপ্তারের বিষয়ে সোমবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরাঁ। তার মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিক বলেছেন- বাংলাদেশ পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন গুতেরাঁ। ডুজাররিক আরও বলেছেন, রাজধানী ঢাকা এবং নিউ ইয়র্কে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আমরা কর্তৃপক্ষকে আমাদের উদ্বেগ জানিয়ে দিয়েছি। জাতিসংঘে শান্তিরক্ষা মিশনে শীর্ষ স্থানীয় সেনা পাঠানো দেশ বাংলাদেশ। তারা মানবাধিকারকে সম্মান জানাবে এবং সমুন্নত রাখবে এটা আমরা দেখতে চাই।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক স্মৃতি সিং সোমবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সাহস যে-ই দেখাবে তার কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দিতে কর্তৃপক্ষ ডাইনিবিদ্যা (উইচহান্ট) ব্যবহার করছে। এরই অংশ হিসেবে প্রতিবাদী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গণগ্রেপ্তার এবং খেয়ালখুশিমতো আটক চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, মানবাধিকার চর্চার প্রতিশোধ নিতে এসব গ্রেপ্তার পুরোটাই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
আন্তর্জাতিক সমালোচনার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করে ভয়েস অব আমেরিকা। কিন্তু এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত কোনো জবাব পাওয়া যায়নি। ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রফেসর এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলী রীয়াজ বলেন, এবারের এই অভ্যুত্থানের কারণ হলো জনগণের মধ্যে অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সহ ভোটাধিকার হীনতার অনুভূতি। তিনি ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, বিপুল পরিমাণ মানুষ অর্থনৈতিক করুণ দশার মুখোমুখি। অন্যদিকে শাকসগোষ্ঠীর সঙ্গে যাদের যোগ আছে তারা লুটপাট করছে এবং অন্য দেশগুলোতে অর্থ পাচার করছে। রাজনৈতিক দিক থেকে পর পর তিনটি জালিয়াতির নির্বাচন তাদেরকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অংশ নেয়ার কোনো সুযোগই দেয়নি। এই অসন্তোষই বিস্ফোরিত হয়েছে, যা রূপ নিয়েছে আন্দোলনে।
সূত্র: মানবজমিন।
তারিখ:আগষ্ট ০১, ২০২৪
রেটিং করুনঃ ,