সর্বশেষ এবং ১৭ তম মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহ ( দুই ) যিনি মির্জা আবু জাফর সিরাজ-উদ্দিন মোহাম্মাদ বাহাদুর শাহ জাফর নামে পরিচিত তার জীবনের বেদনাদায়ক অধ্যায়ের কিছু খন্ডিত কথা
“কিৎনা বদনসিব হ্যাঁয় জাফর…দাফনকে লিয়ে দোগজ জামিন ভি মিলানা চুকি ক্যোয়ি ইয়ার মে।”
অর্থাৎ,
“কী দুর্ভাগ্য জাফরের, স্বজনদের ভূমিতে তার দাফনের জন্য দু’গজ মাটি, তাও মিলল না”।
শত বছর পর ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী মায়ানমার সফরে গিয়ে তার সমাধি সৌধ পরিদর্শন করে পরিদর্শক বইতে লিখলেন,
“হিন্দুস্তানে হয়তো তুমি দু’ গজ মাটি পাওনি। কিন্তু তোমার আত্মত্যাগ থেকেই আমাদের স্বাধীনতার আওয়াজ উঠেছিল। দুর্ভাগ্য তোমার নয় জাফর, স্বাধীনতার বার্তার মধ্যে দিয়ে ভারতবর্ষের সুনাম ও গৌরবের সঙ্গে তোমার নাম চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে”।
বাহাদুর শাহ জাফরের জন্মও হয়েছিল লাল কেল্লায়। ১৭৭৫ সালের ২৪ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তার মা ছিলেন সম্রাজ্ঞী লাল বাঈ। ব্যক্তিগতভাবে বাহাদুর শাহ জাফর একজন গুণী মানুষ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তিনি একজন দক্ষ ক্যালিগ্রাফার, আধ্যাত্মিক কবি ও ধর্মীয় সাধক হিসেবে সকলের শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন।
১৮৩৭ সালে তার পিতার মৃত্যুর পর নানা নাটকীয়তার মধ্য দিয়ে সিংহাসনে বসেন তিনি।
মুদ্রা থেকে সম্রাটের নাম বাদ দেওয়া, দিল্লীর নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণভাবে করায়ত্ত করা সহ ধীরে ধীরে মুঘলদের নাম সমূলে উৎখাতে সচেষ্ট হলেও সম্রাট হওয়ার পর বাহাদুর শাহ জাফর জানতেন তার সীমাবদ্ধতা। কিন্তু কিছুই করতে না পারার হতাশা আর হাহাকার ভুলে থাকতে তিনি কাব্যচর্চায় সময় কাটাতেন।
তার বয়স তখন প্রায় ৮২ বছর। পলাশীর যুদ্ধের পর কেটে গেছে ১০০ বছর। এই শত বছরে শুধুই শক্ত হয়েছে ইংরেজ শাসনের ভিত। ইংরেজদের অপশাসন, লুটপাট আর অত্যাচারে নিপীড়িত-নিষ্পেষিত মানুষের হাহাকার তখন চরমে। এমন সময় মুক্তির স্বপ্নে জেগে উঠল সিপাহী-জনতা। জ্বলে উঠল বিদ্রোহের আগুন।
বৃদ্ধ সম্রাট বয়সের কারণে প্রথমে দায়িত্ব নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। কিন্তু, ভারতবর্ষে তখন তার চেয়ে সর্বজনবিদিত কিংবা গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব পাওয়া সম্ভব ছিল না। সিপাহীদের অনুরোধে অবশেষে রাজি হন তিনি।
গভীর রাতে ২১ বার কামানের তোপধ্বনির মাধ্যমে বৃদ্ধ সম্রাটকে ভারতবর্ষের স্বাধীন সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। সিপাহীরা একত্র হয়ে স্লোগান দেন-
“খালক-ই খুদা, মুলক ই বাদশাহ, হুকুম-ই-সিপাহি।” অর্থাৎ, “দুনিয়া আল্লাহর, রাজ্য বাদশার, হুকুম সিপাহীর।”
বাহাদুর শাহ জাফর বিদ্রোহের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এ সংবাদে উজ্জীবিত হয়ে লক্ষ্ণৌ, কানপুর, বারেলি, ঝাঁসি, বাংলা অঞ্চল সহ সারা ভারতবর্ষে ওঠে বিদ্রোহের জোয়ার। এ যুদ্ধে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের তিন পুত্র- মির্জা মুঘল, মির্জা জওয়ান বখত ও মির্জা আবু বকর।
এ বিদ্রোহে তিনি সর্বতোভাবে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। সিপাহীদের খরচ মেটাতে তিনি তার সকল সম্পদ বিক্রয় করে দেন। এমনকি শেষ পর্যন্ত আসবাব-তৈজসপত্রও তিনি বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সেপ্টেম্বরের প্রথমদিকে তার পুত্র মির্জা মুঘল সিপাহীদের জন্য কিছু অর্থ চেয়ে লিখেছিলেন, তখন জাফর অসহায় হয়ে বলেছিলেন,
“মির্জা মুঘলের কাছে আমার ঘোড়ার সাজ, রূপার হাওদা, কুর্সিগুলো পাঠাও, যাতে মির্জা মুঘল সেগুলো বিক্রয় করে খরচ চালিয়ে নিতে পারে। আমার কাছে এছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।”
দেশীয় রাজন্যবর্গের অসহযোগিতা, অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্র, অর্থাভাব, সামরিক দক্ষতার অভাব সহ নানা কারণে খেই হারিয়ে ফেলে সিপাহী-জনতার বিল্পব। পাতিয়ালার রাজা কিংবা শিখদের মতো অনেকেই প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয় ইংরেজদের পক্ষে।
সম্রাট তখন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছিলেন। ক্রমাগত পরাজিত হতে থাকা পলায়নপর বিশৃঙ্খল বাহিনীর প্রতি তখন তার তেমন আস্থা ছিল না।
১৮৫৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর, দিল্লীর লাহোরী গেট, সিকলাল কেল্লা, জামে মসজিদ ইত্যাদি অবস্থানে সিপাহীদের পতন ঘটে। বাহাদুর শাহ জাফর প্রথমে নিজামুদ্দিন আওলিয়ার মাজারে অবস্থান নেন এবং পরে পরিবারের সদস্য ও প্রায় হাজারখানেক সিপাহীদের সাথে আশ্রয় গ্রহণ করেন পূর্বপুরুষ সম্রাট হুমায়ুনের সমাধিতে।
সেনাপতি বখত খান, মৌলভী সরফরাজ আলী সহ অনেকেই সম্রাটকে দিল্লী ত্যাগ করার বিষয়ে অনুরোধ করেন। সম্রাট হয়তো তা-ই করতেন, কিন্তু মির্জা ইলাহী বক্স, হাকিম আহসানুল্লাহ খান সহ ইংরেজদের হয়ে কাজ করা অনেকেই তাকে একরকম বাধ্য করেন ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে। শেষপর্যন্ত বৃদ্ধ সম্রাট ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাধ্য হলেন হাল ছেড়ে দিতে। ২১ সেপ্টেম্বর ইংরেজ সেনাপতি হডসনের নেতৃত্বে একদল ইংরেজ সৈন্য তাকে পরিবারের সদস্যসহ গ্রেফতার করে।
ইংরেজরা বাহাদুর শাহ জাফরের দুই পুত্র মীর্জা মুঘল ও মীর্জা খিজির সুলতান, তার নাতি মীর্জা আবু বকর সহ অসংখ্য মুঘল বংশধর, জাফরের দরবারের লোকজন এবং বিদ্রোহের পক্ষে থাকা সৈন্যদের নির্মমভাবে নির্বিচারে হত্যা করে। শুধু হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি তারা, বরং তার দুই পুত্রের ছিন্ন-মস্তক সম্রাটের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে নিষ্ঠুরতার নজির স্থাপন করে তারা।
বৃটিশ ফৌজি কমিশনের দ্বারা ১৮৫৮ সালের জানুয়ারিতে সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের বিচারের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়। ৯ মার্চ কমিশনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সম্রাটকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, হত্যা ইত্যাদির অভিযোগে অভিযুক্ত করে রেঙ্গুনে নির্বাসনে পাঠানোর আদেশ দেওয়া হয়।
১৮৬২ সালের ২৬ অক্টোবর তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। অবশেষে ১৮৬২ সালের ৭ নভেম্বর তিনি নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। তিনি তার মৃত্যু সম্পর্কে লিখেছিলেন,
“আমার কোনো বন্ধু আসেনি, যখন সময় এল।
মৃত্যুকে প্রশংসা করতেই হয়,
কারণ সে একাই যথাসময়ে এল,
ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।”
সিপাহী বিল্পবের ইতিহাস শেষ হয়ে যায় পরাজয়, বিষাদময় সমাপ্তিতে। এর সান্ত্বনা খুঁজতে চেয়েছিলেন হয়তো সম্রাট বাহাদুর শাহ নিজেও। শেষ সময়ে তিনি এক স্তবকে লিখেছিলেন,
“এই পৃথিবীতে আমি যদি কোনো সান্ত্বনা না পাই,
তাতে কী-ইবা আসে যায়?
এটুকু তো পেয়েছি আমি,
অর্থহীন কোনো নাম অর্জন করিনি।”
তথ্যসূত্রঃ
১/The last mughal,william Dalrymple,Bloomsbury,Berlin,2006,(page:19)
২/ দি ট্রায়াল অফ বাহাদুর শাহ জাফর- আনোয়ার হোসাইন মঞ্জু,লেখালেখি প্রকাশন,ঢাকা,২০০৯,(পৃষ্ঠাঃ১১,১২)।
সূত্র: সংগৃহিত।
তারিখ : মার্চ ১১, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,