টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রশ্ন রাখেন, ‘প্রস্তাবিত ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে কি সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের শতভাগ নিয়ন্ত্রণ নিতে চায়?’ ‘বাংলাদেশ সরকার ফেসবুক ও ইউটিউবের কাছে যত তথ্য চেয়েছে, তার মাত্র ৪০ শতাংশ দিয়েছে’, একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রীর উদ্ধৃতি উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান এমন প্রশ্ন রাখেন।
ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, গণমাধ্যমে যেভাবে তথ্য এসেছে, তাতে ‘ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন’–এর মধ্যে অনেক নিবর্তনমূলক ধারা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও সরকারের সমালোচনাকারীদের নির্বিচারে একহাত নেওয়ার সুযোগ তৈরি হবে।
আজ বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো টিআইবি এক বিবৃতিতে প্রস্তাবিত ‘ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন’–এর খসড়ার বিষয়ে তাদের উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। বিবৃতিতে ইফতেখারুজ্জামান এসব কথা বলেন।
প্রস্তাবিত ‘ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইন’–এর খসড়া বিরুদ্ধ মত নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে। এতে স্বাধীন মতপ্রকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে বিবৃতিতে বলা হয়।
বিবৃতিতে টিআইবি আইন–সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে নিয়ে বড় পরিসরে আলোচনা ও মতামতের ভিত্তিতে একটি প্রাগ্রসর ও সময়োপযোগী জনবান্ধব আইন তৈরির আহ্বান জানিয়েছে। আইনটি যেন কোনোভাবেই সরকারের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, দুর্নীতি, অনিয়ম নিয়ে জনমত সৃষ্টি এবং ব্যক্তির মতপ্রকাশ ও বাক্স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত না করে, সেই প্রত্যাশা জানিয়েছে টিআইবি। তা না হলে একটি ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে বলে বিবৃতিতে বলা হয়।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ব্যক্তিজীবনে ডিজিটাল স্পেসের গুরুত্ব বাড়ছে। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এসব প্ল্যাটফর্মে দেওয়া তথ্যের সুরক্ষায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও বিশ্বের অনেক দেশেই এ–জাতীয় আইন করেছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনটির মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তা নিশ্চিত করা। সেই সঙ্গে ব্যক্তি যেন ভার্চ্যুয়াল জগতে নিরাপদ বোধ করেন, তার ব্যবস্থা করা।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আমাদের ক্ষেত্রে হতাশাজনক হলেও সত্য যে ইতিপূর্বে প্রণীত “নিরাপত্তা” ও “সুরক্ষা” শব্দযুক্ত আইনগুলো মোটা দাগে নিবর্তনমূলক হিসেবেই প্রমাণিত হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যমান বিতর্কিত “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন” প্রণয়ন পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট অংশীজন যেসব আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, পরবর্তী সময়ে তার আক্ষরিক প্রতিফলন ঘটেছে।’ তিনি বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ‘নিরাপত্তার’ পরিবর্তে স্বাধীন মতপ্রকাশ ও সরকারের সমালোচনাকারীদের কণ্ঠরোধ করতে এই আইন ব্যবহার করা হচ্ছে। সরকারের অবস্থান সংহত করতে আইনটির যথেচ্ছ ব্যবহারও লক্ষ করা যাচ্ছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, সময়ের প্রয়োজনে অন্যান্য দেশের আদলে ‘পারসনাল ডেটা প্রোটেকশন আইন’–এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু শঙ্কার বিষয় হলো শাসকগোষ্ঠীর মানসিকতা, প্রবণতা ও উদ্দেশ্য। তাই প্রস্তাবিত আইনটি যাতে অধিকতর জনবান্ধব, ব্যক্তিতথ্যের সুরক্ষা এবং স্বাধীন মত ও ভাব প্রকাশের সহায়ক হয়, তা নিশ্চিতে সবার অংশগ্রহণ জরুরি। আর সবাইকে সম্পৃক্ত করতে সরকারকে আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
তথ্যসূত্রগুলো বলছে, আইনের খসড়াটি ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সির সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হলেও কেন পরবর্তী সময়ে তা সরিয়ে নেওয়া হয়। এমন লুকোচুরির কারণ ও উদ্দেশ্য নিয়েও প্রশ্ন রাখেন ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, ‘এ পদক্ষেপ আইনটি নিয়ে সাধারণের মধ্যে আলোচনা ও মতামতের সুযোগকে বঞ্চিত করার প্রয়াস বলা যায়। যদিও সাধারণের বৃহত্তর কল্যাণে আইনটি প্রণয়নের কাজে হাত দিয়েছে সরকার।’ এ নিয়ে যে সংশয় তৈরি হয়েছে, তা দূর করতে শিগগিরই খসড়া আইনটি সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। সর্বসাধারণের মতামতের জন্য প্রস্তাবিত খসড়াটি উন্মুক্ত করতে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
টিআইবি বলছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী প্রস্তাবিত আইনে জনসাধারণের তথ্যের দেখভাল করার জন্য ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান ও একজন সরকারি কর্মকর্তাকে ‘মহাপরিচালক’ হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হবে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বিশেষ বিশেষ ব্যক্তির পারিবারিক ও ব্যক্তিগত অডিও এবং ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটলেও বিদ্যমান আইনি কাঠামোতে ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো দৃষ্টান্ত নেই।
বিবৃতিতে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘প্রস্তাবিত আইনে সংশ্লিষ্ট মহাপরিচালকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের “সরল বিশ্বাসের” কর্মকাণ্ডকে নিষ্কলঙ্ক ও বিচারবহির্ভূত রাখার অসাংবিধানিক বিধান কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পাশাপাশি সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতের দ্বারস্থ হয়ে ন্যায়বিচার ও প্রতিকার চাইতে পারবে না মর্মে প্রহসনমূলক ধারার অন্তর্ভুক্তির কথা বলা হয়েছে, তা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজের আইনের অংশ হতে পারে না।’
ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, সময়ের প্রয়োজনে আইনটি যদি প্রণয়ন করা হয়, তাহলে সেটা দেখভাল করার দায়িত্ব মহাপরিচালকের অধীনে কোনো এজেন্সির হাতে দেওয়া চলবে না। বরং একটি স্বাধীন কমিশন গঠনের মাধ্যমে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সেই সঙ্গে গোপনীয়তা ভঙ্গকারী অভিযুক্ত যেকোনো পক্ষকে যাতে আইনের আওতায় আনা যায়, তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে প্রস্তাবিত আইনে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর ‘ডেটা নিয়ন্ত্রণ’ করার উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা’ নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। তাঁকে মহাপরিচালকের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতেও বলা হয়েছে। আইনি এই ব্যবস্থা গবেষণা ও অধিপরামর্শমূলক কাজকে বাধাগ্রস্ত করবে।
সূত্রঃ প্রথম আলো।
তারিখঃ সেপ্টম্বর ১৬, ২০২১
রেটিং করুনঃ ,